প্রতিহিংসার রাজনীতিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েও সুবিধা করতে পারেনি। পেট্রোল- ডিজেল-গ্যাসের লাগামছাড়া দাম বৃদ্ধিতে মানুষ তিতিবিরক্ত। কী করবে বুঝতে না পেরে গেরুয়া পক্ষ বিধানসভায় গুন্ডামি করতে নেমেছে। লিখছেন সাংসদ ডাঃ শান্তনু সেন
এক সময় জাতীয় কংগ্রেস ভারতবর্ষের সংসদে প্রায় ৪৫০ আসন পেয়ে দেশ শাসন করত। সেই কংগ্রেস টুজি, থ্রিজি, কোলগেট, কমনওয়েলথ ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে মানুষের বিশ্বাস না হারালে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে দেশের মানুষ ভুলবশত এই সাম্প্রদায়িক, বিভেদকামী, দেশ বিক্রিকারী রাজনৈতিক দলকে কখনওই ক্ষমতায় আনত না।
আরও পড়ুন – বামেদের বকেয়া ১৮ কোটি
পাঁচ বছরের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি যখন মানুষ ধরে ফেলল ঠিক তখন ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ভেক দেশপ্রেম ও মিথ্যা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা খেলে দেশের মানুষকে আরও একবার বোকা বানিয়ে ক্ষমতায় এল মোদি সরকার।
পশ্চিমবাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) হারানোর জন্য বামপন্থীদের ভোট গেল বিজেপির ঝুলিতে, আর কংগ্রেসের আরও শক্তিক্ষয় হল, যার ফলে বিজেপি বাংলায় ১৮টি লোকসভার আসন পেল। এরপর স্বপ্ন দেখতে শুরু করল বাংলায় তারা সরকার গঠন করবে। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ-সহ একঝাঁক বড়-মেজ-সেজ-ছোট ও চুনোপুঁটি নেতারা ডেলি প্যাসেঞ্জারের মতো বাংলায় এসে ও ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থেকে সমস্ত এজেন্সিকে নিজেদের কাজে লাগিয়ে, কলের জলের মতো পয়সা খরচ করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা খবর প্রচার করে, একশ্রেণির সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করে ও ইলেকশন কমিশনকে নিজেদের মতো চালনা করে তৃণমূল-নিধনে উদ্যত হয়েছিল বিজেপি।
আরও পড়ুন – কল্পতরু রাজ্য সরকার
কিন্তু বাংলার মানুষ দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করে আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) নেতৃত্বাধীন উন্নয়নমুখী বাংলাই দেখতে চান। তাই ধর্ম ও জাত-পাতের নামে বিভেদকারী বিজেপিকে উচিত শিক্ষা দিয়ে আগেরবারের থেকেও বেশি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসকে জয়ী করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী করে এক নজির সৃষ্টি করেন।
এই শোচনীয় পরাজয়ের ঘা এখনও শুকোয়নি। মানুষের রায় এখনও বিজেপি হজম করতে পারেনি। তার ওপর অন্তর্দ্বন্দ্বে জীর্ণ রাজনৈতিক দল আজ তাসের ঘরের মতো ভাঙছে।
লোডশেডিংয়ে জেতা বিরোধী দলনেতা, বর্তমান রাজ্য সভাপতি, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও অন্যান্য নেতা ওই দলে যখন-তখন একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন এবং প্রয়োজনে বনভোজনে গিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন। বিরোধী দলনেতাকে পোস্ট ডেটেড anti-defection চিঠি তৈরি করে রাখতে হচ্ছে, কারণ আরও কত বিধায়ক আগামী দিনে দল ত্যাগ করবেন, সেটা উনি খুব ভালই বুঝতে পারছেন।
এমতাবস্থায় একদিকে সারাদেশ যখন পেট্রোল, ডিজেল, গ্যাস, কেরোসিন-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিস গগনচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির শিকার, তখন সেই দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য এবং শান্ত বাংলাকে অশান্ত করার চেষ্টা করার জন্য কলঙ্কিত করল বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত বিধানসভাকে।
মানুষের রায়ে নির্বাচিত বিধায়করা বর্বরোচিত আক্রমণ করল তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) শান্ত বিধায়কদের। পার পেলেন না তৃণমূল কংগ্রেসের মহিলা বিধায়কেরাও। এক অন্যতম শান্তিপ্রিয় বিধায়ক অসিত মজুমদারের নাকের হাড় ভেঙে রক্তাক্ত করল। এরপর নাটক করে নিজেদের জামা ছিঁড়ে প্রমাণ করতে চাইল তারাও আক্রান্ত। বিরোধী দলনেতার নেতৃত্বে কিছু বিধায়ক কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে ছুটে গেল, কারণ তার আগেই তাঁরা জানতে পেরেছেন যে, বিধায়ক অসিত মজুমদারের নাকের হাড় বিরোধী দলনেতার মারের ফলে ভেঙে গিয়েছে এবং তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। অ্যাপোলো হাসপাতালে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে অন্যায় ভাবে জোর করতে থাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বিধায়কদের ভর্তি করার জন্য। বিজেপির মুখ্য সচেতক দাবি করেন, তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙেছে! অথচ পাঁজরের হাড় ভাঙলে যে পরিমাণ ব্যথা হওয়ার কথা তার সামান্যতমও ছিল না। চিকিৎসকেরা বারংবার পরীক্ষা করে বলেন— সাম্প্রতিক কোনও আঘাতের প্রতিফলন নেই। এমনকী বিধায়কদের কাউকেই ন্যূনতম ড্রেসিং করারও প্রয়োজন পড়েনি। হাসপাতালে ডাইরেক্টর অফ মেডিক্যাল সার্ভিস, রিটায়ার্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডাক্তার ভাটিয়া তাঁদের বুঝিয়ে বলেন, ভর্তি করার মতো কোনও কারণই পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর বিজেপির বিধায়কেরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লাইসেন্স বাতিল করার ও হাসপাতাল ভাঙচুর করার হুমকি দিয়ে সেখান থেকে চলে যান। এরপর নাটক করে তাঁদের মুখ্যসচেতককে AIIMS-এ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
প্রচারসর্বস্ব ও মিথ্যাচারী রাজনৈতিক দলের মুখ্য উদ্দেশ্য, বাংলা তথা ভারতের মানুষের কাছে আজ পরিষ্কার। দীর্ঘ ৩৪ বছর সিপিআইএমের রাজত্বে কংগ্রেস ও পরবর্তী ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা সবথেকে বেশি আক্রান্ত ও নিহত হয়েছে। আর শাসন ক্ষমতায় ১১ বছর থাকার পরে যে কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীর থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীর আক্রান্ত ও নিহত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি, কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না।
আরও পড়ুন – সন্তান প্রসবে সিজার বন্ধে উদ্যোগ রাজ্যের
সদ্যসমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে আগের থেকে আসন অনেক কমলেও বিজেপি জয়ী হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, আর এই বাংলায় রাজ্যপালকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি তৃণমূলকে সাঁড়াশি আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। বাংলার মানুষের কাছে চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থীরা ও কংগ্রেস বিজেপিকে সুযোগ করে দিচ্ছে।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের ১৩৮ কোটি মানুষকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য এবং তাদের এই স্বৈরাচারী বিজেপি সরকারের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সমস্ত বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আরও একবার আবেদন করেছেন। তিনি আগেও বলেছেন, এই ঐতিহাসিক লড়াইয়ে প্রয়োজনে তিনি একজন কর্মীর ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হতে পারেন। ভারত আজ বিপদে, তাই সমস্ত বিরোধী শক্তির উচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ঐতিহাসিক ডাকে সাড়া দেওয়া।