উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের বংশের উত্তরসূরি হয়ে সত্যজিৎ রায় শুধুই সিনেমা করবেন আর ছবি আঁকবেন, ছোটদের জন্য কিছু লিখবেন না এই ব্যাপারটা বোধহয় তিনি নিজেও মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারতেন না। ১৯৬১ সালে তাঁর জন্মমাসে তিনি বন্ধু, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে ‘সন্দেশ’ বার করতে শুরু করলেন। তার ষষ্ঠ সংখ্যাতেই সৃষ্টি করলেন প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর চরিত্র— গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’। তার বছর কয়েকের মধ্যেই আত্মপ্রকাশ ফেলুদার— বিশিষ্ট বাঙালি গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ১৯৬৫ সালে প্রথম ফেলুদা-কাহিনি ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’, ১৯৬৯ সালে প্রথম ফেলুদা-গ্রন্থ ‘বাদশাহী আংটি’, ১৯৭৪ সালে প্রথম ফেলুদা-সিনেমা ‘সোনার কেল্লা’।
আরও পড়ুন-লালুকে হেনস্তা
ক্রমশ কাল্পনিক চরিত্রের দূরত্ব সরিয়ে ফেলুদা বাঙালি পাঠিকা-পাঠকের নিকটমানুষ হয়ে উঠল। কেউ কেউ বললেন, আরে এ তো স্বয়ং মানিকবাবু! বাস্তবিক ফেলুদার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের অনেক মিল। তাঁর মতোই ফেলুদার উচ্চতা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, নানা বিষয়ে গভীর জ্ঞান, বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতি আন্তরিক টান, সুভদ্র রসবোধ। ফেলুদার বালক বয়সে তার বাবা মারা যান, ‘অসুখটাও নাকি আজকের দিনে কিছুই না’। মনে পড়বেই কালাজ্বরে সুকুমার রায়ের অকালমৃত্যুর দীর্ঘশ্বাস।
আরও পড়ুন-সেনার সাফল্য, এই প্রথম দেশে তৈরি জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র
অবশ্য লেখালেখির জগতে স্রষ্টার সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মিল মোটেও কোন নতুন কথা নয়। তাই সেই বাহ্যিক সাদৃশ্য অন্বেষণে কাজ নেই, বরং সরাসরি বলা যাক, সত্যজিৎ রায়ের মতোই ফেলুদা বাংলা রেনেসাঁসের শেষ প্রতিনিধিদের একজন। তার মধ্যে অবাধ জ্ঞানচর্চা আর শারীরিক সক্ষমতার এক আশ্চর্য ভারসাম্য। ফেলুদা ভাল পোর্ট্রেট আঁকতে পারে, রাইফেল শুটিংয়ের চ্যাম্পিয়ন, যোগব্যায়াম করে শরীরটা এমন তৈরি রেখেছে যে লালমোহনবাবু রসিকতা করেন, ‘গোয়েন্দাগিরিতে ফেল করলে সার্কাসে চাকরি বাঁধা’, গাড়ির নাম আর কুকুরের জাত দেখলেই বলে দিতে পারে, স্লো স্পিন বোলার হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় টিমে খেলেছে, বাংলা স্বরলিপি ও সব রাগ-রাগিণীর নাম জানে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফেলুদা নিজেই একবার বলেছিল যে ও নিজেকে একটি মেনি পয়েন্টেড স্টার বা জ্যোতিষ্ক বলে মনে করে। কথাটা একেবারেই বাড়িয়ে বলা নয়, ফেলুদার গুণমুগ্ধ পাঠক সেকথা এক বাক্যে স্বীকার করবেন।
আরও পড়ুন-কোনও অন্যায় কাজে থাকবেন না: অনুব্রত
কিন্তু এত গুণাবলির বিরল সমাবেশ হওয়া সত্ত্বেও ফেলুদা কোনও দূরের মানুষ হয়ে থাকে না। তার কোল্ট পয়েন্ট থ্রি টু আগ্নেয়াস্ত্র সরিয়ে রেখে ঘরোয়া পাজামা-পাঞ্জাবি পরে সে কার্শিয়াংয়ের মকাইবাড়ি টি এস্টেটের ফুরফুরে গন্ধওয়ালা চায়ে চুমুক দেয়, সঙ্গে নিউ মার্কেটের কলিমুদ্দির দোকান থেকে আনা ডালমুট। এত প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও সে বাস করে তার কাকা, অর্থাৎ তোপসের বাবার সঙ্গে যৌথ পরিবারে। বাংলা সম্পর্কে তার অভিমত, ‘এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট অফ জিওগ্রাফি। শস্য-শ্যামলাও পাবে, রুক্ষতাও পাবে, সুন্দরবনের মতো জঙ্গল আবার গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার মতো নদী পাবে, আবার উত্তরে হিমালয় কাঞ্চনজঙ্ঘা।’ ধর্ম বা রাজনৈতিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে দুই বাংলার বাঙালির তাই ফেলুদাকে আপন করে নিতে কোনও দ্বিধা হয় না।
আরও পড়ুন-জলমগ্ন ত্রিপুরা, দুর্গতদের পাশে তৃণমূল
বাঙালি চিরকাল যেসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে শ্রদ্ধা করে এসেছে, সম্পদ হিসেবে মনে করেছে ফেলুদার মধ্যে তা প্রভূত পরিমাণে উপস্থিত। প্রথমত, ফেলুদা নির্লোভ। সে নিজেই বলে, ‘প্রচুর টাকা রোজগার করব, খুব পয়সাঅলা রিচম্যান হব, এমন লক্ষ্য আমার কোনও কালেই নেই।’ ভুবনেশ্বরের রাজা-রানি মন্দিরের যক্ষীর মাথা বিদেশে পাচারের ব্যাপারে তদন্ত করতে ফেলুদা আওরঙ্গাবাদ অবধি গিয়েছিল নিজের খরচে, শুধুমাত্র দেশীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের তাগিদে। দ্বিতীয়ত, আত্মসমালোচনায় কোনও কুণ্ঠা নেই ফেলুদার। নিজের দুর্বলতায় ‘বাক্স রহস্য’ সমাধান করতে গিয়ে অনবধানতায় বিপদ ডেকে এনে সে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে, ‘অটোগ্রাফ নেবার লোভের চেয়ে অটোগ্রাফ দেবার লোভটা মানুষের মধ্যে কিছু কম প্রবল নয়।’ অধিকাংশ এক-চরিত্র-কেন্দ্রিক সিরিজের মতো এক সময় ফেলুদা-কাহিনিও পৌনঃপুনিকতায় আক্রান্ত হয়; তখন ফেলুদা নিজেই তার ভক্তদের কাছে কবুল করে, ‘বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পাঠকের কাছ থেকে গুনে গুনে সবশুদ্ধ ছাপান্নখানা চিঠি পেয়েছিলাম।
আরও পড়ুন-কংগ্রেসের আশা নেই, গুজরাত–হিমাচলের ভোট নিয়ে মত পিকের
সবাই ঘুরে ফিরে সেই একই কথা লিখেছে, ফেলু মিত্তিরের মামলা আর ঠিক জমাটি হচ্ছে না।’ আর এই সূত্রেই ফেলুদা এক দুঃসাহসী মন্তব্য করে বসে, ‘জনপ্রিয় লেখকের এক বড় শত্রু তার প্রকাশক’। নিজের মত প্রকাশে এমন সৎসাহস অবশ্য ফেলুদা বারবার দেখিয়েছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকগোষ্ঠীর চোখের উপর চোখ রেখে ফেলুদা জানিয়েছিল, শহিদ মিনারের চুড়ো লাল রং করা ঠিক হয়নি; বলেছিল, ‘আজকাল কলকাতার রাস্তায় ঘাটে চলতে গেলে যে বিপদ, তেমন বিপদ এক যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও নেই’; বলেছিল, ‘এই গরম আর এই লোডশেডিংয়ে আইনস্টাইনেরও মাথা খুলত কিনা সন্দেহ।’ তার মূল্যবোধের সর্বোচ্চ প্রমাণ বোধহয় মিলেছিল ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’য়। সেখানে তাকে যিনি দুষ্প্রাপ্য কিছু বই উপহার দিয়েছিলেন তিনিই ফেলুদার তদন্তে খুনি প্রমাণিত হওয়ায় ফেলুদা ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই মহার্ঘ্য উপহার।
বাঙালির পাঠকবৃত্তে আছে আরও বেশ কিছু দেশি-বিদেশি গোয়েন্দার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁরা অনেকেই ফেলুদার চেয়েও ক্ষুরধার, ফেলুদার চেয়েও বেপরোয়া। কিন্তু তাঁরা কেউ ফেলুদার মতো আমাদের ঘরের মানুষ নন। ফেলুদাকে আমরা ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি, ভরসা করি। ফেলুদা বাঙালির আইকন। তার মধ্যে দিয়েই আজকের বাঙালির ইচ্ছাপূরণ।