বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণের এক বিশেষ অনুষঙ্গ হল চড়ক। বাঙালি জীবনের সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বাংলা বর্ষশেষের এই বিশেষ উৎসবটি লোকায়ত প্রাঙ্গণকে অতিক্রম করে, ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অস্বীকার করে, বাঙালি জীবনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে। যুগ যুগ ধরে বহুত্ববাদী বাঙালি সংস্কৃতি যা ভারতীয় সংস্কৃতিতে পুষ্ট করার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে নিজের ধারাবাহিক ঐতিহ্য বজায় রেখেছে, তারই অঙ্গীকার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশে হিন্দু বাঙালির উৎসব হয়েও, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে অতিক্রম করে এই চড়ক এক মানুষের মেলায় নিজেকে রূপান্তরিত করেছে।
বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে চড়ক পুজো, নীল, হাজরহা, হরব পুজো ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত। পৌরাণিক সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অতিক্রম করে একটা সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হিসেবে নিজেকে জোরদারভাবে তুলে ধরেছে এই উৎসব। লিঙ্গ পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ইত্যাদিতে চৈত্র মাসের শিব-আরাধনাকেন্দ্রিক নাচ-গান ইত্যাদির বেশ কিছু উদাহরণ আমরা পাই। তবে পৌরাণিক উপাদানে এই উদাহরণগুলো কখনওই ‘পুজো’ নামে কিন্তু উল্লিখিত হয়নি।
গোবিন্দানন্দের লিখিত গ্রন্থ ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদি’ এবং রঘুনন্দনের ‘তিথিতত্ত্ব’, যেগুলি পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে রচিত হয়েছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন, সেইসব গ্রন্থে কিন্তু আমরা কখনও এই চড়কের বিবরণ পাই না। তবে বাঙালির জীবনের নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখতে পাওয়া যায় যে,পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে অতি-প্রাচীন কালে এই উৎসবের প্রচলন ছিল। যদিও এই উৎসবের প্রচলন কিন্তু সীমাবদ্ধ ছিল মূলত নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে। উচ্চবর্ণের মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করত না।
চড়ককে ঘিরে বর্ণহিন্দুদের খুব একটা হেলদোলও ছিল না। আজ যেমন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা চড়কপুজোতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও মেলা ইত্যাদি অনুষঙ্গে তাদের অংশগ্রহণ দেখতে পাওয়া যায়, তার ইতিহাসটা কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে একজন রাজা এই চড়কপুজো প্রথম শুরু করেছিলেন বলে একটা প্রবাদ আছে। তবে সেই প্রবাদের পেছনে ইতিহাসগত সমর্থন যে খুব বেশি আছে এমনটা জোর করে বলতে পারা যায় না। যদিও মিথলজিতে আমরা এই বর্ণনা পাই যে, চড়কের দিনে শিব উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধিপতি কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, মহাদেবের প্রীতিকামনায়, অমরত্ব লাভের ইচ্ছায় ভক্তিসূচক নাচ-গান এবং নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে শিবকে তুষ্ট করার সাধনায় ব্রতী হন। সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। সেই স্মৃতিতেই নাকি শিবের উপাসকেরা পরবর্তীকালে এই উৎসবের আয়োজন করেছেন।
তবে এই যে চড়কের উপাচারে বঁড়শিতে গেঁথে সন্নাসীদের ঘোরানোর দৃশ্য প্রাচীন সাহিত্যে রয়েছে বা উনিশ শতকের একদম শেষ ভাগ পর্যন্ত যার বিবরণ ইতিহাসগত ভাবে আমরা পাই, তার একটি সামাজিক দিক হল; যেসব কৃষকরা জমিদারের ঋণ শোধ করতে পারত না, সেইসব কৃষককে চৈত্র মাসের শেষ দিনে বঁড়শিতে বেঁধে ঘোরানো হত। ১৮৯০ সাল পর্যন্ত এইভাবে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের উপর অত্যাচারের ইতিহাসগত প্রমাণ আমাদের কাছে আছে (বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ : দুলাল চৌধুরী। আকাদেমি অফ ফোকলোর। কলকাতা ৯৪, প্রথম প্রকাশ ২০০৪। পৃষ্ঠাসংখ্যা ২১৮-২১৯)
উত্তরবঙ্গের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই শিবের গাজনেরই একটা বিবর্তিত রূপ হিসেবে আমরা গম্ভীরাপুজো দেখতে পাই। মালদা, রাজশাহি অঞ্চলের একটা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে গম্ভীরাপুজোর প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে নীলপুজোর যে প্রচলন রয়েছে, তা মূলত নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উচ্চবর্ণের লোকেদের ভিতরে এই পুজোর প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় না। জলভরা একটা পাত্রে শিবলিঙ্গ রেখে, তাতে সিঁদুর দিয়ে কোনও কোনও জায়গায় অর্চনা করা হয়। আবার কোনও কোনও জায়গায় সিঁদুরমাখানো একটা লম্বা কাঠের তক্তা, যার প্রচলিত নাম, ‘শিবের পাটা’ রাখা হয়। এটা আবার কোনও কোনও জায়গায় বুড়োশিব নামেও পরিচিত।
এই নীলপুজোয় যে ব্রাহ্মণেরা অংশগ্রহণ করেন তাঁরা কিন্তু বর্ণশ্রেষ্ঠ বলে দাবিকরা ব্রাহ্মণ সমাজের অন্তর্গত নন। শ্মশানে দাহকার্যের সময়ে যে ব্রাহ্মণদের দেখতে পাওয়া যায় বা আদ্যশ্রাদ্ধতে পিণ্ডভক্ষণের জন্য যে অগ্রদানী ব্রাহ্মণদের দেখতে পাওয়া যায়, এঁরা সেই ব্রাহ্মণসমাজের অন্তর্গত। মণ্ডল কমিশনের প্রতিবেদন মোতাবেক এঁরা ওবিবিসির অন্তর্গত। এই নীলপুজো হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটা, ছুরির উপর দিয়ে লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে ঝোলা ইত্যাদি দেখা যায়।
আবার কোনও কোনও জায়গায় চড়ক ‘হাজরাপুজো’, ‘দানো-বারনো’ নামেও পরিচিত। দেখতে পাওয়া যায় চড়ককে কেন্দ্র করে যে প্রথাগত আচার-আচরণ রয়েছে, তাতে কিন্তু পুনর্জন্মবাদ ভূত-প্রেতে বিশ্বাসের জায়গাটা খুব তীব্র। প্রাচীন সমাজে যে নরবলির প্রচলন ছিল, তার কোনও বিবর্তিত রূপ নিম্নবর্গীয় হিন্দুসমাজের চড়কপুজোর আচার আচরণের মধ্যে অন্তর্গত হয়েছে কিনা তা নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকদের ভিতর যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা হয়। চড়ক (Charak) গাছে ঘোরানোর যে রীতি একটা সময় বাংলায় প্রচলিত ছিল, গাজনের সন্ন্যাসীদের লোহার শলা দিয়ে চড়কগাছের সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানোর যে প্রচলন ছিল, তাঁদের পিঠে, হাতে-পায়ে-জিভে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে শলাকা ইত্যাদি বেঁধানোর যে প্রচলন ছিল, জ্বলন্ত লোহার শলাকা গায়ে ছুঁড়ে দেওয়ার যে রীতি ছিল, সেইসব প্রথাগুলিকে ১৮৬৩ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন মোতাবেক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
তবে আইন করে এগুলো নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বহুকাল এসবের প্রচলন দেখতে পাওয়া গিয়েছে। আজ থেকে পঁচিশ-তিরিশ বছর আগেও গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই উপলক্ষে সন্ন্যাসীদের ভেতর থেকেই একজনকে হনুমানের মতো সাজিয়ে লম্বা লেজ দিয়ে রামকাহিনিতে বর্ণিত হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত আনার দৃশ্য অভিনীত হতে দেখেছি। স্থানীয় ভাষায় হুগলি জেলায় এগুলোকে বলা হয় গিরিসন্ন্যাস। আবার দেখেছি, এই গাজনের সন্ন্যাসীরা মহাসমারোহে আম গাছ থেকে ফলন্ত ডাল পেড়ে আনছেন। সেগুলিকেও স্থানীয় কথ্যভাষায় গিরিসন্ন্যাস নামে অভিহিত করা হয়। আবার কোনও কোনও জায়গায় দেখেছি, ফলসমেত আমগাছের ডাল ভেঙে আনার এই যে রীতি তাকে বাবরসন্ন্যাস বলা হয়।
আগের দিন নীলচণ্ডিকার পুজো হয় যেটি গ্রামবাংলায় নীলপুজো নামে অভিহিত, সেদিন সন্ন্যাসীরা গোটা অঞ্চল জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। তাঁদের দলে একজন শিব সাজেন। তাঁর সঙ্গে থাকেন দুজন শিবসঙ্গী। কোনও কোনও জায়গায় এঁদেরকে নীলপাগলের দল বলা হয় । বাড়ি বাড়ি ঘুরে এঁরা গাজনের গান করেন। গান পরিবেশনের জন্য গৃহস্থ নানাধরনের উপহারসামগ্রী তুলে দেয় এঁদের হাতে।
সেই রাতে হাজরাপুজো হয় কোনও কোনও জায়গায়। সেখানে শিবের উদ্দেশ্যে খিচুড়ি, শোলমাছ নিবেদনের পদ্ধতিও দেখেছি। গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্থানে এই সময়কালে শিবের ভর হওয়ার এক ধরনের প্রচলন গ্রামবাংলায় আজও আছে। অনেকেরই বিশ্বাস, সেই সময় ভক্তরা তাঁদের জীবনের নানা সমস্যা ঘিরে যা যা প্রশ্ন করেন এবং সন্ন্যাসীরা তার যথাযথ উত্তর বা দিশা দিয়ে থাকেন।
চড়ককে (Charak) কেন্দ্র করে বাণসন্ন্যাস, বেত্রসন্ন্যাস, বঁড়শিসন্ন্যাস ইত্যাদি নানা ধরনের শব্দাবলি আজও গ্রামবাংলায় প্রচলিত আছে। লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক এই ‘চড়ক’। কলকাতা থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও মহাসমারোহে চড়কপুজো অনুষ্ঠিত হয়।