বাঘে উৎসর্গ পঞ্চাশটি বছর

বাঘেদের বন্ধু বাল্মীক থাপার। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, দৃঢ় সংরক্ষণবাদী। প্রকাশ করেছেন বাঘের উপর বই। নির্মাণ করেছেন তথ্যচিত্র। ২০২৫-এর ৩১ মে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে লিখলেন শীলা রাজবংশী

Must read

যেমন বাপ তেমন বেটা
কথাটি কেউ এমনি এমনি বলেনি। অবশ্য কর্মই শেষ কথা। তবে থাপারের সম্পর্কে বলতে গেলে যে তাঁর বংশ পরিচয় একটু দিতেই হয়। বাল্মীক থাপারের দাদু দয়ারাম থাপার ছিলেন একজন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল অফিসার এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী মেডিক্যাল সার্ভিসেসের মহাপরিচালক। অন্যদিকে দয়ারাম থাপারের ভাই জেনারেল প্রাণনাথ থাপার ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্থ সেনাপ্রধান। এতেই শেষ নয়, ছেলে রমেশ থাপার অর্থাৎ যিনি বাল্মীক থাপারের বাবা তিনিও বিখ্যাত সাংবাদিক। অপরদিকে বাল্মীক থাপারের পিসি রোমিলা থাপারও নামকরা ভারতীয় ইতিহাসবিদ। বাল্মীকি থাপার ছিলেন বাঘ সংরক্ষণবাদী, একাধারে লেখক এবং ভারতের বন্য ঐতিহ্যের আজীবন রক্ষক। এই সম্পর্কের স্রোত কোথা থেকে বইছে সহজেই বোঝা যায়।

আরও পড়ুন-আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান, মান্য কার্যবিধি প্রকাশ নবান্নের

বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই প্রবাদটি আমাদের অনেকের জীবনেই দাগ কেটেছে। কতজনই বা এই দাগের যথার্থ মর্ম বুঝেছেন, তা অমরা থাপারের লড়াই দেখেই বুঝতে পারি। যদি কথাটির প্রকৃত অর্থ আমরা বুঝতেই পারতাম তাহলে বাঘের লোক হওয়ার প্রয়োজন থাপারের ছিল কি?
শতকোটি স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে এই পৃথিবী। সেই স্বপ্ন পূরণের দিশায় আলোড়ন ওঠে বারংবার। সেই স্বপ্নের পথে অনেক সময় বাধা হয়ে ওঠে বনের প্রাণী। তারা তাদের জগতে থাকলেও সেই জগতের অংশীদার হতে আমাদের লোভ থাকে ষোলো আনা। এই যে জরাজীর্ণ, সংকীর্ণ মানসিকতায় ভরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এর প্রভাব কিন্তু মন্দ নয়। ভাল-মন্দের বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে কখন কখন কাজ করতে হয়। শুধু নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকলে চলে না। যারা অন্যের জন্য বাঁচে, অন্যকে বাঁচায়, তাদের কর্মে বা বুদ্ধিতে তারাই আসল অংশীদারি ইতিহাসের পাতায়। কংক্রিটে মোড়ানো শহরেও নতুন চারা জন্ম নেয়। তেমনি এই স্বার্থের পৃথিবীতে জন্ম নেয় বাল্মীক থাপারের মতো মানুষেরা। সত্যিই মানুষ নিজেদের কৃষ্ট-নিকৃষ্ট চাহিদা পূরণে জন্য ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। বন উজাড় হচ্ছে, হচ্ছে বনালয়ে কলকারখানার আধিপত্য। গ্রাস করছে শহুরে ঘিঞ্জি আবহাওয়া। ফলত বন্যরা তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। তখন বাল্মীক থাপারের মতো মানুষ একমাত্র ভরসা।
প্রথম বন্য বাঘের মুখোমুখি
চেতনে-মননে শুধুই বাঘ। মানুষ আজকাল মানুষকে ভালবেসে উঠতে পারে না। সেই জায়গায় বাঘের প্রতি মানুষের মানবিক প্রেম দেখে মন হয় উচ্ছসিত। মিঃ থাপারের যখন বয়স ১০ বছর, তখন তিনি হিমালয়ের নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত করবেট জাতীয় উদ্যানে একটি হাতির উপরে থেকে প্রথম বন্য বাঘের মুখোমুখি হন। তিনি একটি বাঘিনিকে তার দুটি শাবক নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে হাতির দিকে গর্জন করতে দেখেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘‘আমি কোনও পণ্ডিত নই, আমি শুধু বাঘকে নিয়ে বিশাল এক জগতের সামান্য ছোঁয়াটুকু পেয়েছি। বিশ্বাস করুন, বাঘের যে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে, তা এশিয়ার প্রায় প্রতিটি সমাজেই গভীরভাবে বিদ্যমান। আমি কেবল তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখেছি। বহু বছর আগে এই যাত্রা শুরু করি, কারণ বাঘ আমাকে মোহিত করেছিল। তার মধ্যে এক অনন্য শক্তি ও রহস্যময়তা ছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, মানুষের উপর বাঘের এই প্রভাব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে– প্রাগৈতিহাসিক মানুষের গুহাচিত্রে হোক কিংবা প্রাচীন রোমান গ্ল্যাডিয়েটরের আখড়ার সঙ্গে যুদ্ধরত বাঘের উপস্থাপনায়, এসব শিল্প কোথা থেকে ছড়িয়েছে, কীভাবে বিস্তার লাভ করেছে তা আমি জানার চেষ্টা করেছি।’’
১৯৭০ সালে তাঁর জীবন নয়া মোড় নেয় রণথম্ভোরের জঙ্গলের হাত ধরে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে, তিনি বাঘ সংরক্ষণের জন্য কাজ করছেন। ফতেহ সিং রাঠোরের স্নেহধন্য ছিলেন বাল্মীক থাপার। বাঘকে কেন্দ্র করে কতই না দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছর কাটিয়েছেন, বিরল আচরণ রেকর্ড করেছেন, অবিশ্বাস্য ফুটেজ নথিভুক্ত করেছেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, ব্যবস্থাপনা কৌশল তৈরি এবং বাস্তবায়ন করেছেন যা রণথম্ভোরকে আজকের প্রধান বন্যপ্রাণী গন্তব্যস্থলে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ২০টি গাড়িকে ধাক্কা কন্টেনারের, মৃত ১, আহত ১৮

বইয়ের পাতায় বাঘের কথা
বাঘবন্ধুর লেখা বইয়ের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। মিঃ থাপার ভারতের বন্যপ্রাণীর উপর ৫০টিরও বেশি বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর অন্যান্য বইগুলির মধ্যে রয়েছে ‘দ্য টাইগার্স ডেসটিনি’ (১৯৯২); ‘ওয়াইল্ড টাইগার্স অফ রণথম্ভোর’ (২০০০); ‘টাইগার: দ্য আল্টিমেট গাইড’ (২০০৪) এবং ‘টাইগার ফায়ার: ৫০০ ইয়ার্স অফ দ্য টাইগার ইন ইন্ডিয়া’ (২০১৭)-এর মতো প্রশংসিত বই। অত্যন্ত সহজ সরল করে বইয়ের পাতায় গেঁথে দিয়ে গেছেন বাঘ রক্ষার মূল মন্ত্র। বইটিতে যেমন মনোমুগ্ধকর আখ্যান রয়েছে, তেমনি পরিবেশগত অন্তর্দৃষ্টি বুননের দক্ষতা। তিনি আরও জানান, ‘‘মুঘল যুগের মিনি চিত্রকলায় বাঘ, ব্রিটিশদের সময় বাঘ নিয়ে শিল্পকর্ম—সব মিলিয়ে এই বিষয়টি এতটাই সমৃদ্ধ যে আমি ভাবলাম, এ নিয়ে একটি বই লিখতেই হবে।’’
তিনি শুধুমাত্র বইগুলো বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে। যাতে নির্বোধ জাতি তাদের বোধ ফিরে পায়। বাঘের প্রতি ভয় নয় যেন জন্ম নেয় ভালবাসা। ভারতীয় এলিট ক্লাস বুদ্ধিদীপ্তরা বন্যপ্রাণীদের কোন চোখে দেখেন, তাও খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর বইয়ের পাতায়।
বাঘ-মানুষের সহাবস্থান
আপনি চান বা না চান আপনাকে আলোচনা বা সমালোচনার সম্মুখীন কখনও না কখনও হতেই হয়। তাছাড়া আপনি যখন স্রোতের বিপরীতের মানুষ, তখন সমালোচনার ঝড় উঠবে বারংবার। মিঃ থাপারও ব্যতিক্রম নন। এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তাঁকেও হতে হয়েছে। তিনি এই বিষয়ে অটল ছিলেন যে, বাঘ সংরক্ষণের জন্য কঠোর সীমানা প্রয়োজন। তিনি যে দলের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তা ছিল টাইগার টাস্ক ফোর্স নামে একটি সরকারি সংরক্ষণ প্রচেষ্টা, যদিও তিনি ২০০৫ সালে এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তীব্র মতবিরোধ প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে দেখা গেছে যে, বাঘ মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে। ফলে সমালোচনার ঝড় উঠতে বিলম্ব হয়নি।
স্বভাবসুলভ স্পষ্টবাদিতার সঙ্গে বজ্রপাতের মতো কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠস্বর উঠেছে বাঘেদের জন্য। ভারতে চিতা পুনঃপ্রবর্তনের পরিকল্পনাটি করদাতাদের অর্থের অপচয়। এই কথাটি অত্যন্ত সাবলীল ভাবে জানাতে দ্বিধাবোধ করেননি।

আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক লজ্জা : মুখ্যমন্ত্রী, বিশ্ব মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টেও বিজেপির বাংলা-বিদ্বেষের কথা

স্যাঙ্কচুয়ারির আত্মার অংশ
জীবন উৎসর্গ শব্দটি বহুবার শুনেছি। চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হয় যখন এক একটি থাপারের জন্ম নেয়। বিশ্বের বেশিরভাগ বন্য বাঘের আবাসস্থল ভারতে, ১৯৫০-এর দশকে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৪০,০০০ থেকে কমে ২০০৬ সালে ১,৪১১-এ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সংরক্ষণ প্রচেষ্টার ফলে ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ৩,৬৮২-এ দাঁড়িয়েছে। রাজস্থানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যের রণথম্ভোর টাইগার রিজার্ভে, সেখানে সংখ্যাটি ২০০৬ সালে প্রায় ১৫ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে প্রায় ৭০-এ দাঁড়িয়েছে।
বাঘের মানববন্ধু থাপার যেমন রণথম্ভোর ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তেমনি বাঘ সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সরকারগুলিকে পরামর্শ দিয়েছেন এবং ন্যাশনাল বোর্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ সহ ১৫০টিরও বেশি নীতি প্যানেল এবং টাস্ক ফোর্সে অংশগ্রহণ করেছেন।
১৯৮১ সালে ফতেহ সিং স্যাঙ্কচুয়ারি এশিয়ার সূচনা করলেও, বাল্মীকই এর সহস্র দরজা খুলে দিয়েছিলেন, বিষয়বস্তু কৌশলগতভাবে তৈরি করেছিলেন এবং জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত স্যাঙ্কচুয়ারির মিশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি স্যাঙ্কচুয়ারিকে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দূরদর্শনে প্রদর্শিত ভারতের প্রথম ১৬টি তথ্যচিত্রের সিরিজ ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ তৈরিতেও সাহায্য করেছিলেন, যার দর্শক নেহাত মন্দ নয়। সংখ্যা ছিল ৩ কোটি। তিনি সর্বদা স্যাঙ্কচুয়ারির আত্মার অংশ হয়ে থাকবেন।
থাপার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, বিবিসি, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট এবং ডিসকভারি চ্যানেলের জন্য বেশ কয়েকটি বন্যপ্রাণী তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় তথ্যচিত্র সিরিজগুলির মধ্যে একটি ছিল ‘ল্যান্ড অফ দ্য টাইগার’, যা ১৯৯৭ সালে বিবিসি দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল৷
একটি জীবন বাঘের নামে
ভারতে বাঘেদের কণ্ঠস্বর বাল্মীক ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টভাষী লেখক এবং চোরাশিকারিদের প্রভাব, আবাসস্থলের ক্ষতি এবং সরকারি নীতিমালার বিরুদ্ধে তাদের রক্ষা করার জন্য কাজ করা একজন দৃঢ় সংরক্ষণবাদী। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি না হলেও তাঁর জ্ঞান, সংবেদনশীলতা এবং যোগাযোগের ক্ষমতার কারণে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন।
এই পৃথিবীতে সবাইকে নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হয়। কিন্তু অবলা জীবরা কি আমাদের স্বার্থের চক্ষু থেকে আড়াল হতে পারে? যদি পারত তাহলে বাঘবন্ধুর জন্ম হলেও তাকে অস্তিত্ব সংরক্ষণের লড়াইয়ে নামতে হত না। লড়াই হোক, লড়াই চলুক। বারবার ফিরে আসুক বাল্মীক থাপার।

Latest article