প্রথম বিধবা বিবাহ

১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। অর্থাৎ আজকের দিনেই, কলকাতায় রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসেছিল ভারতের প্রথম বিধবা বিবাহের আসর। মূল উদ্যোক্তা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঐতিহাসিক এই ঘটনার পিছনে ছিল তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম, হার না-মানা মানসিকতা, অসীম সাহস এবং জেদ। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

চণ্ডীমণ্ডপে মুখোমুখি
পল্লিগ্রামের নিঝুম সন্ধ্যা। জ্বলছে ধূপ-দীপ, বাজছে শাঁখ। উড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকির দল। নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে কয়েকটি শেয়াল। সেই সময় বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে মুখোমুখি আলাপচারিতায় মগ্ন দুই পুরুষ। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র। পিতা এবং পুত্র। তাঁরা আলোচনা করছিলেন নানা বিষয়ে। সেই সময় ধীর পায়ে উপস্থিত হন ভগবতী দেবী। তিনি পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে সরাসরি জানতে চান— ‘‘তুই এতদিন যে শাস্ত্র পড়লি, তাতে বিধবাদের কোনও উপায় আছে?’’
বিদ্যাসাগর উত্তরে বলেন, ‘‘শাস্ত্রমতে বিধবা নারীর সামনে দুটি পথ খোলা—হয় ব্রহ্মচর্য, নয় সহমরণ।’’
এইকথা শুনে ঠাকুরদাস তোলেন রাজা রামমোহন রায়, কালীনারায়ণ চৌধুরী ও দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখের প্রসঙ্গ। স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁদের চেষ্টা ও পরামর্শে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক সহমরণ প্রথা নিবারণ করেছিলেন। তিনি এও বলেন, কলিতে ব্রহ্মচর্য সম্ভব নয়। সুতরাং বিধবাদের পক্ষে বিবাহ-ই একমাত্র উপায়।
বিদ্যাসাগর উত্তর দেন, তাঁর নিজেরও তাই ধারণা, এমনকী তিনি এও মনে করেন যে, শাস্ত্র খুঁজলে এই ধারণার সপক্ষে স্বীকৃতিও পাওয়া যাবে। তবে তার সঙ্গে এও যোগ করেন— ‘‘কিন্তু এ বিষয়ে পুস্তক করলে অনেকেই নানা প্রকার কুৎসা ও কটু বাক্য করবে। তাতে আপনারা পাছে দুঃখ পান, সেজন্য নিবৃত্ত আছি।’’
এই কথা শুনে ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবী দু’জনেই বিদ্যাসাগরকে আশ্বাস দেন, তাঁরা সকল কুৎসা ও সমাজের কটু বাক্য সহ্য করতে রাজি আছেন, বিদ্যাসাগর নির্ভয়ে এই কাজে হাত দিতে পারেন। এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে বিদ্যাসাগরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের লেখায়।

আরও পড়ুন-ঝাঁটা হাতে রাস্তায় নামলেন সপারিষদ পুরপ্রধান সুনীল

ডিরোজিওপন্থীদের উদ্যোগ
কেমন অবস্থা ছিল তৎকালীন বিধবাদের? অষ্টাদশ শতকে বিজয়রাম সেন বঙ্গবিধবাদের কাশীবাসের কথা লিখে গিয়েছেন, ‘কাশীর মধ্যেতে আছেন বিধবা জতেক/ সবাকারে দিলা কর্তা তঙ্কা এক এক।’ এই কর্তা হলেন জয়নারায়ণ ঘোষাল। বালবৈধব্য যন্ত্রণা, মদনদেবতার শর সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় ‘গর্ভ’ হয়ে পড়া এবং তা ‘নষ্ট’ করতে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া ছিল সেই কালের নিত্যকার ঘটনা। বঙ্গবিধবারা এগুলোকে অবশ্য ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন।
নিজের শিশুকন্যার বালবৈধব্য ঘোচাতে রাজা রাজবল্লভ অনেককাল আগে বিধবা বিবাহ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কিন্তু নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজের বিরোধিতায় সেটা বাস্তবায়িত হয়নি।
বাংলায় বহু আগেই নবজাগরের জোয়ার এসেছে। ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী চেয়েছিলেন যত দ্রুত সম্ভব বাংলার হিন্দু সমাজকে বাল্যবিবাহ ও কৌলীন্যপ্রথা মুক্ত করতে, বিধবা বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা চালু করতে। তাঁদের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সাধু ছিল। কিন্তু সাফল্য আসেনি। কারণ, ধৈর্যের অভাব। উৎসাহ থাকলেও, যথার্থ তেজ এবং জেদ তাঁদের ছিল না। তাই কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে দীর্ঘ সময় যা কিছু প্রতিবাদ, সবটাই হয়েছে কাগজ কলমে।
ডিরোজিওপন্থীদের উদ্যোগের কথা ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪২ সালে। তার পর প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে যায়।
দিনের আলোর মতো স্পষ্ট
ডিরোজিওপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বিদ্যাসাগরের। ছাত্রজীবনে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’-র তিনি সদস্য ছিলেন। সেই সূত্রে প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, গোবিন্দচন্দ্র বসাক, শিবচন্দ্র দেব, কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। ছাত্রজীবনেই বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ রদ করা উচিত, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ঘটানো উচিত এবং সমাজে বিধবা বিবাহ চালু করা উচিত। তিনি এও বুঝেছিলেন, এইসব বিষয়ে কাগজে প্রবন্ধ লেখা এক জিনিস, সেটা বাস্তবায়িত করতে যাওয়া আরেক জিনিস। রক্ষণশীল সমাজ কিছুতেই মেনে নেবে না। চিন্তাভাবনার বাস্তবায়ন ঘটাতে গেলে বিপজ্জনক কিছু ঘটে যেতে পারে। গোঁড়া হিন্দু সমাজ যেভাবে রাজা রামমোহন রায়ের পিছনে পড়েছিল, তা কারও অজানা নয়। শুধুমাত্র কুৎসা নয়, রামমোহনের প্রাণহানির চেষ্টাও হয়েছিল। এই সবকিছুই বিদ্যাসাগরের জানা।

আরও পড়ুন-রো-কো আর যশস্বীতে মুঠোয় সিরিজ

মুখ বন্ধ করার জন্য
পিতা-মাতার সম্মতি পাওয়ামাত্রই বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় সম্মতি খুঁজে বের করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি শাস্ত্রে বিধবা বিবাহের পক্ষে সমর্থন নিজের বিবেকের জন্য খুঁজছিলেন না। শাস্ত্র যা-ই বলুক, সমাজে বিধবা বিবাহ যে হওয়া উচিত, এইকথা তিনি অনেক আগে থেকেই সঠিক বলে বিশ্বাস করে এসেছেন। আসলে সেই সময়ে, সেই যুগে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্র সন্ধান ছিল গোঁড়া হিন্দু সমাজপতিদের মুখ বন্ধ করার জন্য। নিজের বিশ্বাসের সমর্থনের জন্য নয়। পরাশর সংহিতার একটি বিখ্যাত শ্লোক— ‘নষ্টে মৃতে/ প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।/ পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।’ ঈশ্বরচন্দ্র এই শ্লোকের ব্যাখ্যা করলেন– ‘পতি যদি নষ্ট, মৃত, সন্ন্যাসী, ক্লীব বা পতিত হয় তবে স্ত্রী অন্য পতি গ্রহণ করতে পারেন।’ এই ব্যাখ্যার জোরেই শেষ পর্যন্ত বিধবা বিবাহ স্বীকৃত হলেও, আসলে কিন্তু ভারতের অধিকাংশ পণ্ডিতের স্বীকৃত ব্যাখ্যা এটা ছিল না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর পুস্তক ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ জুড়ে আলোড়ন পড়ে যায়। বিদ্যাসাগরের পুস্তকটি সেই আমলে ১৫ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। এই জনপ্রিয় পুস্তকের যুক্তিজাল খণ্ডন করে একের পর এক পুস্তিকা লেখা হতে থাকে। বিদ্যাসাগরের যুক্তি যাঁরা খণ্ডন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন নবদ্বীপের ভট্টপল্লিনিবাসী পঞ্চানন তর্করত্ন। ভট্টপল্লির ব্রাহ্মণরা ব্যবস্থাপক সভায় বিধবা বিবাহ প্রচলনের বিপক্ষে যে আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন, তাতে স্পষ্ট অভিযোগ ছিল, বিদ্যাসাগর আদতে শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করে নব্যসম্প্রদায়ের কতিপয় যুবককে নাচিয়ে এই বিষয়টি খুঁচিয়ে তুলেছেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মধ্যে এই নিয়ে কোনও দ্বিমতই নেই যে বিধবা বিবাহ শাস্ত্র স্বীকৃত নয়।
পাল্টা যুক্তি প্রয়োজন ছিল
শাস্ত্রে কী বলে তা দিয়ে বিদ্যাসাগরের কিছুই যেত-আসত না। ‘অসহনীয় শাস্ত্র বিধান ও লোকাচার প্রতিপালন’-এর বোঝাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য, যত দুর্বলই হোক, শাস্ত্র থেকে উঠে আসা একটা পাল্টা যুক্তি তাঁর প্রয়োজন ছিল। হাতিয়ার হিসেবে তিনি পরাশর সংহিতার শ্লোকটিকে জনমত তৈরিতে এত নিপুণভাবে ব্যবহার ও প্রতিবাদী মতগুলিকে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক দ্বিতীয় সম্বাদ’ নামক পুস্তকে এমন দক্ষতার সঙ্গে খণ্ডন করেছিলেন, যে তাঁকে হত্যা করার জন্য কলকাতার এক বিত্তবান প্রভাবশালী ব্যক্তি ভাড়াটে গুন্ডা লাগিয়েছিলেন। যদিও এই কাজে সেই বিত্তশালী ব্যক্তি সফল হননি। কিন্তু কী বিপদ মাথায় নিয়ে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে বিদ্যাসাগর এই কাজে এগিয়েছিলেন, ঘটনাটি থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়।

আরও পড়ুন-চরম বিশৃঙ্খলা, যাত্রী- হয়রানি, বেলাগাম টিকিটমূল্য: মনিটরিং কোথায় কেন্দ্রের?

ছোঁড়া হয় কুরুচিপূর্ণ কাদা
বিদ্যাসাগরের পুস্তক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গসমাজ স্পষ্টতই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। যদিও সংখ্যাগুরু অংশ ছিলেন বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধী। কলকাতার রাধাকান্ত দেবের ধর্মসভা, যশোহরের হিন্দুধর্ম সংরক্ষণী সভা ইত্যাদি সংস্থা বিদ্যাসাগরের ভয়ঙ্কর বিরোধিতা করে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সম্বাদ ভাস্কর-এর মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ সংবাদপত্রই দাঁড়ায় বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে। কুরুচিপূর্ণ কাদা ছোঁড়া হয় তাঁকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু বিদ্যাসাগর স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই এইসবে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না।
১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র লন্ডনে ভারতের ব্যবস্থাপক সভার বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত, প্যারীচরণ সরকার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ তৎকালীন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
এর বিপক্ষে রাধাকান্ত দেব আরেকটি পাল্টা আবেদনপত্র পাঠান। তাতে স্বাক্ষর ছিল ৩৬,৭৬৩ জনের। এই আবেদনপত্র ছাড়াও বিধবা বিবাহের বিপক্ষে ত্রিবেণী, ভাটপাড়া, নদিয়া, বাঁশবেড়িয়ার মতো অঞ্চল থেকে বেশ কিছু আবেদনপত্র পাঠানো হয়, যার মিলিত স্বাক্ষর ছিল প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মতো।
যুক্তিকে গুরুত্ব
অবশ্য ব্যবস্থাপক সভায় স্বাক্ষরের সংখ্যার থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল আবেদনে থাকা যুক্তিকে। আদতে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রের যুক্তির আড়ালে ছিল তাঁর অখণ্ড মনুষ্যত্বের যুক্তি। এই যুক্তি ছিল বিধবা নারীর ভয়াবহ জীবন যন্ত্রণাকে লাঘব করার সপক্ষে এবং স্বামীর মৃত্যুতে দুঃস্থ, দুর্বিষহ, পরনির্ভর জীবনযাত্রার বিধানের বিপক্ষে প্রদত্ত সাধারণ মানবিকতার প্রতি আপিল। শুষ্ক শাস্ত্রের যুক্তির মারপ্যাঁচের বিপরীতে এই আপিলই জয়যুক্ত হয়েছিল ব্যবস্থাপক সভার বিবেচনায়।
এর ভিত্তিতেই ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই ভারতে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়। সমাজের যাঁরা গোষ্ঠীপতি, যাঁরা বিত্তবান, তাঁরা বিদ্যাসাগরকে প্রতিহত করতে কোনও উপায়ই বাদ দেননি। তবে বাংলার শ্রমজীবী মানুষ কিন্তু সমর্থন করেছিল বীরসিংহের সিংহশিশুকেই।
রচিত হয়েছিল ইতিহাস
বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলন করাকে তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম বলে চিহ্নিত করেছিলেন। শুধু আইন হয়েই যাতে তা না থাকে, তার জন্য করেছিলেন আপ্রাণ প্রচেষ্টা। ১৮৫৬-র ২৬ জুলাই অনুমোদিত হয় বিধবা বিবাহ আইন। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মাসত্রয় অতীত হইতে না হইতেই এ বৎসরের অগ্রহায়ণ মাসের ত্রয়োবিংশ দিবসে বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।’
১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর, রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতার অন্তঃপাতি সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবন’-এ পটলডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায় ও লক্ষ্মীমণি দেবীর বিধবা কন্যা কালীমতী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয় প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশ ও সূর্যমণি দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের। এটাই ছিল ভারতের প্রথম বিধবা বিবাহ। পাত্র মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিত, যশোরের খাটুয়া গ্রামের বাসিন্দা। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের ঘোর সমর্থক। পাত্রীর বাড়ি বর্ধমানের পলাশডাঙা গ্রামে। ৪ বছর বয়সে কালীমতী দেবীর প্রথম বিবাহ হয়েছিল ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ২ বছর পরে মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। ১০ বছর বয়সে তাঁর দ্বিতীয়বার বিবাহ হয়।
পাত্র এসে উঠেছিলেন বউবাজারের রামগোপাল ঘোষের বাড়িতে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে। বরযাত্রী হয়ে এসেছিলেন রামগোপাল ঘোষ নিজে, হরচন্দ্র ঘোষ, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, দ্বারকানাথ মিত্র, জয়নারায়ণ তর্ক পঞ্চানন, ভরতচন্দ্র শিরোমণি, প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, প্যারিচাঁদ মিত্র, কালিপ্রসন্ন সিংহ, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রাজা দিগম্বর মিত্র। বরযাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে পালকি চেপে পাত্র কিছু আগেই চলে এসেছিলেন রাজকৃষ্ণর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে। বেশ বড় বাড়ি। চিলেকোঠাটি বাদ দিলে একটু সেকেলে ধরনের একখানা দোতলা বাড়ি। দোতলায় টালি-ছাওয়া বারান্দা, নিচে গ্যারাজ। গৃহকর্তা রাজকৃষ্ণ ছিলেন বিদ্যাসাগরের পরম বন্ধু। বউবাজারে থাকাকালীন হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পৌত্রটির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচয়। তাঁর কাছেই রাজকৃষ্ণর সংস্কৃত শিক্ষা।
বিধবা বিবাহ নিয়ে গোলমালের আশঙ্কায় আগে থেকেই প্রার্থনা করা হয়েছিল পুলিশের সাহায্য। ইংরেজ সরকার সেই ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। দু’পাশে হাজার হাজার নরনারী। সুকিয়া স্ট্রিটে সেদিন যেন জনসমুদ্র।
এই বিধবা বিবাহের আসরে উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বয়ং। বলা যায়, তিনিই ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। এই অসাধ্যসাধনের পিছনে ছিল তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম, হার না-মানা মানসিকতা, অসীম সাহস, জেদ।
‘সংবাদ প্রভাকর’-এ এই বিবাহ এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। লক্ষ্মীমণি করেছিলেন কন্যা সম্প্রদান। মন্ত্রপাঠ, উলুধ্বনি, দ্বারষষ্ঠী, স্ত্রী আচার, ঝাঁটা প্রণাম, নাক মোলা, কান মোলা সবই হয়েছিল। সেইসঙ্গে ছিল ভূরিভোজের এলাহি আয়োজন। এই বিবাহের মধ্যে দিয়ে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস।
বিদ্যাসাগর প্রথম বিধবা বিবাহের জন্য প্রায় দশ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন। ১৮৬৭ সালের মধ্যে ৬০টি বিধবা বিবাহের জন্য তিনি মোট ব্যয় করেছিলেন প্রায় বিরাশি হাজার টাকা।

আরও পড়ুন-চিতা-মানুষ সংঘাত ঠেকাতে বসছে বিশেষ জালের বেড়া

বিরক্ত বিদ্যাসাগর
উনিশ শতকের ষাটের দশকে বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রাথমিক ভাবে যে উৎসাহ দেখা দিয়েছিল, সেটা ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। মনে হয়েছিল, সমাজ ক্রমশ এমন বিবাহ মেনে নিচ্ছে। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। প্রাথমিক আইনি পরাজয়ে পিছু হটলেও অচিরেই সমাজপতিরা প্রত্যাঘাত হেনেছিলেন। হিন্দু রক্ষণশীলতার এক নতুন জোয়ার দেখা দিয়েছিল ষাটের দশকের শেষ ভাগ থেকে। সনাতন ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার্থে বিধবা বিবাহের বিপক্ষে প্রবল প্রচার শুরু হয়েছিল। বিধবা বিবাহ দেওয়ার জন্য বরিশালের দুর্গামোহন দাসকে বয়কট করেছিলেন তাঁর মক্কেলরা। এমনকী প্রথম যিনি বিধবা বিবাহ করেছিলেন, সেই শ্রীশচন্দ্র স্ত্রী কালীমতীর মৃত্যুর পর পণ্ডিতদের দিয়ে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম করে আবার জাতে ফিরেছিলেন।
এইসব দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায়কে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’
শুধুমাত্র বাইরেই নয়, নিজের ঘরেও বিধবা বিবাহের আয়োজন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৭২ সালে তাঁর একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবা নারীর বিবাহ দিয়েছিলেন। এটা ছিল সমাজের বিরুদ্ধে এক বিরাট পদক্ষেপ। ঈশ্বরসম মহামানব স্থাপন করেছিলেন ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।

Latest article