১৯৩৯ সাল। হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে মুক্তি পেল দুটি গান। একটি ব্রহ্মসংগীত ‘জাগো পুরবাসী’। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কথায় এবং সুরে। অন্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও’। দুটি গান সমবেত কণ্ঠে গেয়েছিলেন সুজিতরঞ্জন রায়, হরিপদ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দুলেখা ঘোষ, বিজয়া দেবী এবং সুপ্রভা রায়।
আরও পড়ুন-বাংলা ভাঙার পুরনো ছক
এই সুপ্রভা রায় হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্রবধূ, সুকুমার রায়ের স্ত্রী এবং সত্যজিৎ রায়ের মা।
জানা যায়, সুপ্রভার গানের গলা ছিল চমৎকার। কাজের ফাঁকে সারাদিন গুনগুন করতেন। তবে নিজেকে খুব বেশি আলোকিত করেননি। বলা ভাল, মেলে ধরার তেমন সুযোগ পাননি।
বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারের বধূ। সংসারের প্রতি ছিল দায়বদ্ধতা। তাই নিজেকে কিছুটা আড়ালেই রেখেছিলেন সুপ্রভা। অবশ্য নিজে আড়ালে থাকলেও, তাঁর দক্ষ অভিভাবকত্বেই একমাত্র পুত্র হয়ে উঠেছিলেন মানিক থেকে সত্যজিৎ, এক বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব।
আরও পড়ুন-উচ্চমাধ্যমিক-পরবর্তী পর্যায়ে জীবনের দিক-নির্দেশনা
একটু পিছনের দিকে যাওয়া যাক। ১৮৯২ সাল। জন্ম হল সুপ্রভার। যেমন তেমন পরিবারে নয়, বিখ্যাত জমিদার পরিবারে। ছোট্ট মেয়েটিকে পেয়ে বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে উঠলেন জমিদার কালীচরণ গুপ্ত। মেয়ে তো কী হয়েছে? উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যা সুপ্রভা ম্যাট্রিক পাশ করলেন ঢাকা ইডেন গার্লস হাইস্কুল থেকে। পরে ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে। পড়াশোনা শুরু করলেন কলাবিদ্যা নিয়ে। গান তো বহু আগেই কণ্ঠে উঠেছে তাঁর। এইভাবেই কাটছিল দিনগুলো। ধীরে ধীরে কখন যে বড় হয়ে গেলেন, খেয়াল করেননি।
একুশ বসন্ত ছুঁয়ে যেতেই একদিন বেজে উঠল সানাই। সুপ্রভার বিয়ে। পাত্র বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ছেলে সুকুমার। কবি ও চিত্রশিল্পী। ১৯১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। চার হাত এক হয়ে গেল।
পৃথিবীটা আরও বড় হয়ে গেল সুপ্রভার। বিখ্যাত স্বামীর সহধর্মিণী। তাঁর মতো সুখী কে আছেন! সুকুমার লেখেন কবিতা, ছড়া, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ। আঁকেন ছবি। মেতে থাকেন ইউ রায় অ্যান্ড সন্স ছাপাখানা এবং পারিবারিক ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নিয়ে। সুপ্রভা সামলান ঘরসংসার, পাশাপাশি করেন গান।
উপেন্দ্রকিশোরের বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। কবিগুরুর স্নেহ পেয়েছিলেন সুপ্রভাও। ‘মায়ার খেলা’য় অভিনয় করেছিলেন তিনি। এ-সবকিছুই একটা সময় তাঁর কাছে ছিল স্বপ্নের মতো।
কিন্তু এত সুখ সইল না কপালে। দাম্পত্য জীবনের দশ বছরের মাথায়, ১৯২৩ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন সুকুমার। তাঁদের একমাত্র সন্তান সত্যজিৎ তখন নেহাত শিশু। অথৈ জলে পড়লেন সুপ্রভা!
আরও পড়ুন-শিক্ষাবিদদের মতামত নিয়ে হবে নয়া সিলেবাস
শোনা যায়, উপেন্দ্রকিশোর নাকি বিধবাদের সাদা থানের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর শাশুড়িমাকেও নাকি অনুরোধ করেছিলেন, যেন সাদা থান না পরেন। অথচ বিখ্যাত এই পরিবারের পুত্রবধূ সুপ্রভার জীবন মাত্র একত্রিশ বছর বয়সেই বিবর্ণ হয়ে গেল! সুকুমারের অকালপ্রয়াণের পর সুপ্রভা হাতে একটি আংটি ছাড়া আর কোনও গয়না পরেননি। বাকি জীবনে স্পর্শ করেননি আমিষ।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন অতীব সুন্দরী সুপ্রভা। পরিবার ছিল সচ্ছল। ভাগ্যের কী পরিহাস। সেই তাঁকেই একদিন পড়তে হল চরম অর্থকষ্টে। তবে দমে যাননি সুপ্রভা। শ্বশুরবাড়ি এবং কিছুদিন বাপের বাড়িতে থেকে চালিয়ে গেছেন একক লড়াই।
পুত্রকে নিজেই পড়াতেন। অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল। দুটো পেট চালানোর জন্য বিক্রি করতেন নিজের তৈরি হস্তশিল্পসামগ্রী, ভাস্কর্য। জানা যায়, তিনি মৃৎশিল্প শিখেছিলেন নিতাই পালের কাছে। সুপ্রভার রান্না এবং সেলাইয়ের হাতও ছিল চমৎকার। এমব্রয়ডারি, চামড়ার কাজ, সেলাইয়ের কাজ করেও তিনি অর্থ উপার্জন করতেন।
আরও পড়ুন-‘সুস্বাদু’ পাওভাজিতে মজেছেন কামিন্স
লেখক পরিবারের বধূ। নিজে লিখতেও পারতেন। সুপ্রভার সামান্য কিছু চিঠিপত্র সেই প্রমাণ দেয়।
প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী, মুক্তমনা ছিলেন এই নারী। কখনও কোথাও মাথা নিচু করেননি। তাঁকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন পরিবারের প্রত্যেকেই। দেওর সুবিমল রসিকতা করে বলতেন ‘বজ্রবৌঠান’। এই বজ্রকঠিন মানসিকতা নিয়ে সুপ্রভা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন। মানুষের মতো মানুষ করেছেন পুত্রকে। তাঁর জন্যই সারা পৃথিবীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল সত্যজিতের। পুত্রকে দিয়েছিলেন অগাধ স্বাধীনতা। কোনওদিন চাকরির জন্য চাপ সৃষ্টি করেননি।
সত্যজিৎ বিয়ে করেছিলেন বিজয়াকে। দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। এই বিয়েতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি সুপ্রভা। এতটাই আধুনিক মনের ছিলেন তিনি। পুত্রবধূকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন পারিবারিক ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন-১৩০ মিটারের ছক্কা মারতে চান পাওয়েল
‘পথের পাঁচালী’র পথ কিন্তু একেবারেই মসৃণ ছিল না। টাকার অভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শ্যুটিং। প্রথম ছবির কাজ হঠাৎ থমকে যেতে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলেন সত্যজিৎ। সেটা বুঝতে পেরেছিলেন সুপ্রভা। শেষমেশ তিনিই করেছিলেন মুশকিল আসান। গিয়েছিলেন শৈশবের বন্ধু বেলা সেনের কাছে, ছেলের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করতে। বেলা সেন ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আত্মীয়া। বিধানচন্দ্র হতাশ করেননি। ‘পথের পাঁচালী’ প্রযোজনা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বাকিটা ইতিহাস!
এই ছিলেন সুপ্রভা রায়।