মানুষ জলে সাঁতার কাটতে পারে কিন্তু বায়ুমণ্ডলে বা আকাশে পারে না, কারণ হচ্ছে ঘনত্বের পার্থক্য। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব জলের ঘনত্বের থেকে প্রায় ১০০০ গুণ কম। সেই কারণে বায়ুমণ্ডল মানুষকে ভাসিয়ে রাখতে পারে না। পাখির বায়ুমণ্ডলে ওড়ার পদ্ধতি সম্পূর্ণ সহজাত বিজ্ঞানভিত্তিক। এর প্রাথমিক প্রাকৃতিক কারণ হিসাবে বলা যায় ১) গতিশক্তি ২) গঠন, ৩) চলন পদ্ধতি ৪) ওজন। পাখির গতিশক্তি ও ওজনের অনুপাত অন্য সমস্ত প্রাণীর থেকে বেশি। তাই পাখি শুধুমাত্র নিজের শক্তি খরচ করে, অনায়াসে পাখনার সাহায্যে আকাশে উড়তে পারে। চাঁদে বায়ু নেই, তাই বায়ুমণ্ডল নেই। সেখানে পাখি (যদি কোনওভাবে বেঁচে থাকতে পারে) উড়তে পারবে না। আবার বিজ্ঞানভিত্তিক কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি নানা গ্যাসের সংমিশ্রণ এবং তরল পদার্থের গুণসম্পন্ন। অর্থাৎ এর ঘনত্ব, চাপ, বাধা দেওয়ার ক্ষমতা, প্লবতা ইত্যাদি আছে। তাই এরোপ্লেন, তরল পদার্থের গুণের ওপর ভিত্তি করে ও চলনে গঠনে পাখির মতো করে বানানো হয়েছে। এর শক্তি ও ওজনের অনুপাত গাড়ির থেকে অনেক বেশি। বলাই বাহুল্য, পাখির মতো এরোপ্লেনও চাঁদে উড়তে পারবে না। বায়ুমণ্ডলের তাপ বাড়লে ঘনত্ব কমবে, প্লবতা কমবে, ভেসে থাকার ক্ষমতা কমবে, গতির বিপরীতমুখী বাধা কমবে, ইত্যাদি ইত্যাদি যেগুলি বিমান ওঠানামা ও ওড়ার ক্ষেত্রে ভীষণ ব্যাঘাত ঘটায়। মনে রাখতে হবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর বিমান প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ধ্বংস হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সুশৃঙ্খলভাবে বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (১৯৪৭) এবং ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (২৩ মার্চ ১৯৫০) এর যৌথ উদ্যোগে প্রতিটি বিমানবন্দরে আবহাওয়ার নানারকম রিপোর্ট তৈরি ও সেগুলি বৈমানিকদের জানা বাধ্যতামূলক করা হয়। ভারতের বিমান চলাচলের নিয়ামক, ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন, ICAO এবং WMO-এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলে সহায়তা করে। বিমান চলাচল সংক্রান্ত যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর নোট টু এয়ারম্যান (NOTAM) জানানো বাধ্যতামূলক।
সম্প্রতি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর বিমান দুর্ঘটনার পূর্বের আবহাওয়ার খবর ও আলোচনা :
METAR VAAH 120800Z 25007KT 6000 NSC 37 /16 Q1000(Q1000 বায়ুমণ্ডলের বাতাসের চাপের পরিমাণ। এটি বিমানের উচ্চতা মাপার জন্য ব্যবহার হয় (NOSIG- পরবর্তী ২ ঘণ্টায় আবহাওয়ার বিশেষ পরিবর্তন হবে না।)
উপরিউক্ত এই আবহাওয়ার খবরটি তৈরি করা হয়েছে ১২ তারিখ ৮ জিএমটি অর্থাৎ ১৩টা ৩০ বা দুপুর ১টা ৩০ ভারতীয় সময়ে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ড্রিমলাইনার ৭৮৭- ৮ বিমানটি ১৩টা ৩০ বা ১টা ৩০ মিনিটে রানওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মানে আবহাওয়ার খবরটি পাইলট অবগত হয়ে বিমানটি ১৩টা ৩৪ বা ১টা ৩৪ মিনিটে চালানো শুরু করেন। ১৩.৩৮ বা ১টা ৩৮ মিনিটে ৬২৫ ফুট উঁচুতে পৌঁছে যায়। সুতরাং পাইলটরা নিয়মমতো METAR অর্থাৎ মিটিওরোলজিক্যাল এভিয়েশন রিপোর্ট পড়েছিলেন এবং বিমানে প্রয়োজনীয় ডাটা এন্ট্রি করেছিলেন।
এখানে VAAH হচ্ছে আমেদাবাদ এয়ারপোর্টের কোড নেম। যেমন কলকাতা এয়ারপোর্টের কোড নেম VECC।
25007KT এখানে বলা হচ্ছে বাতাস ২৫০ ডিগ্রি দিক থেকে আসছে। এয়ারপোর্টের রানওয়ে নম্বর ছিল ২৩। অর্থাৎ রানওয়েতে বিমান টেক অফ-এর জন্য দাঁড়ালে বিমানের নাক ২৩০ ডিগ্রি কোণের দিকে থাকবে। বাতাসের গতির প্রায় বিপরীতমুখী। সুতরাং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার একেবারে সঠিক নির্দেশ দিয়েছিলেন বিমান ওড়ানোর জন্য। সবসময় বায়ুর গতির বিপরীত দিকেই টেক অফ অথবা ল্যান্ড করা উচিত। বায়ুর গতির বাধা যেমন বিমানকে (ফ্লপ ডাউন অবস্থায়) তাড়াতাড়ি উঁচুতে উঠতে সাহায্য করবে, তেমনি ল্যান্ডিং-এর সময় (ফ্লপ গ্যাপ, ভার্টিকাল অবস্থায়) বিমানকে অল্প দূরত্ব দৌড় করিয়ে থামিয়ে দেবে।
6000 এটি বলছে, খালি চোখে দৃশমানতা। খুব ভাল, এখানেও কোনও অসুবিধা নেই। NSC নো সিগনিফিকেন্ট ক্লাউড, বলছে আকাশে কোনও অসুবিধা করতে পারে এমন কোনও মেঘ নেই । অর্থাৎ বজ্রবিদ্যুতের মেঘ বা দৃশমানতা কমিয়ে দেওয়ার মতো কোনও মেঘ নেই।
37/16 বলছে তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শিশিরাঙ্ক ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বায়ুমণ্ডলের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ভীষণ কম। ফিল লাইক তাপমাত্রা বা ভার্চুয়াল তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে সমস্যা আছে। নর্মাল বা স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখান থেকে ৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব অনেকটাই কমিয়ে দেবে। প্লবতাও সেই অনুযায়ী কমবে। এই অনুযায়ী বিমানের একটি চার্ট থাকে, যেখানে ATF (এভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল) এর ওজন, প্যাসেঞ্জার সংখ্যা, সমস্তরকম লাগেজের ওজন এবং কত দূরত্ব কত বেগে রান করলে বিমান এয়ার-বর্ন হবে, কত উলম্ব গতি পাবে যা একমাত্র অভিজ্ঞ পাইলট অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন। এখনও বিমানের ব্ল্যাকবক্স রিপোর্ট জানানো হয়নি। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, ১০০০০০ লিটার ATF নেওয়া হয়েছে। যা ১০ কিলোমিটার ওপর দিয়ে ৭০০০ কিলোমিটার পেরিয়ে লন্ডন পৌঁছতে সাধারণত প্রয়োজন। এই বিমানের রানওয়েতে নর্মাল টেক অফ ভেলোসিটি ২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। খবরে প্রকাশ, এই ভেলোসিটি ছিল ৩২০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। তার মানে পাইলট ভেলোসিটি বাড়িয়েছিলেন ধরে নেওয়া যেতে পারে। এটা হয়তো করতে চেয়েছিলেন দ্রুতবেগে আকাশে ওঠার জন্য। যেটা শেষপর্যন্ত সেটা সফল হয়নি। রান করতে করতে রানওয়ের শেষ প্রান্তের কাছে চলে এলে সাধারণত জোর করে বিমানকে এয়ার-বর্ন করানোর জন্য এটা করা হয়, কারণ তখন বিমান থামানোর কোনও জায়গা থাকে না। বিপদ শুরু হয় এর পর থেকে। বিমানের ইঞ্জিনের ক্ষমতা কমে গেলে বা বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব কমে গেলে বিমান নামতে শুরু করে। আকাশে চলার পথে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা আর্দ্রতা বৃদ্ধির জন্য বায়ুর ঘনত্ব কমে গেলে, তখন তাকে বলে এয়ার পকেট। এই রকম অবস্থা থেকেই পাহাড়ি অঞ্চলের মতো ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্স শুরু হয়। যা ভয়ানক অবস্থা। ধরে নেওয়া যেতেই পারে এমনই এক বিষম পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল প্লেনটি (Plane Crash)।
আরও পড়ুন-বকেয়া দেড় হাজার কোটি, কেন্দ্রের বঞ্চনায় রাজ্যে হচ্ছে না স্মার্ট ক্লাস