মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ইন্দর সিং পারমার। বিরসা মুন্ডার জন্মতিথিতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেছেন—“ব্রিটিশ শাসকেরা হিন্দু ভারতীয়দের আস্থা বদলানোর কুচক্র চালাত…তারই অংশ ছিলেন ইংরেজদের দালাল রাজা রামমোহন রায় (Raja Rammohan Roy)।” এর আগে অসমের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইবার জন্য দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। অর্থাৎ বিজেপি এইবার সরাসরি আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করেছে ভারতীয় ‘নবজাগরণে’র পথিকৃৎ একের পর এক বাঙালি মনীষীর বিরুদ্ধে। ওরা বাংলার মাটির দখল নিতে চায়। অথচ ওদের ডিএনএ-তে জমা বাঙালি-বিরোধিতা প্রকট হচ্ছে প্রতিদিন। কয়েকবছর আগে বাংলার প্রাক্তন বিজেপি রাজ্য সভাপতি তথাগত রায় প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন—“বাঙালিকে র-সু-ন সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে হবে।” ‘র-সু-ন সংস্কৃতি’ বলতে তথাগতবাবু ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, আজ বাঙালির কাছে তা একটুও অজানা নয়। এ হল রবীন্দ্রনাথ-সুকান্ত-নজরুল সংস্কৃতি, যা বাংলার চেতনাকাঠামোকে নির্মাণ করেছে। বিজেপির পক্ষে উদার মানবতাবাদী, চরম অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথ, বামপন্থী সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং নিজে মুসলিম হয়েও আজীবন অন্ধ, গোঁড়া মৌলবাদের বিরোধিতা করে যাওয়া কাজী নজরুল ইসলামকে মেনে নিতে অসুবিধা হওয়াটাই স্বাভাবিক। গত কয়েকবছরে উত্তরপ্রদেশ, অসম-সহ বেশ কয়েকটি বিজেপিশাসিত রাজ্যে স্কুলপাঠ্য সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা। সম্প্রতি কর্নাটকের বিজেপি সাংসদ বলেছেন—“ব্রিটিশদের খুশি করতেই রবীন্দ্রনাথ জনগণমন গানটি লিখেছিলেন।” যে সংঘ ও হিন্দু মহাসভা গোটা স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্যায়ে কখনও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নেয়নি, বরং বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাদের কাছ থেকে আজ দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট নিতে হবে রাজা রামমোহন রায় (Raja Rammohan Roy) এবং রবীন্দ্রনাথকে?
এই প্রেক্ষিতেই উনিশ শতকের সেই সময়টিকে আরেকবার মনে করা যাক। ১৮১৮ সাল থেকেই রাজা রামমোহনকে সতীদাহের মতো একটি বর্বর মধ্যযুগীয় প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে উদ্যোগী হতে দেখা যায়। একদিকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয়সভা’য় এই ঘৃণ্য প্রথার অমানবিকতা নিয়ে আলোচনা চলছে, পাশাপাশি রামমোহন একাধিক বাংলা ও ইংরেজি পুস্তিকা লিখে সতীপ্রথার অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করে চলেছেন। মিশনারি পত্রিকা ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’র পৃষ্ঠায় তাঁর এই উদ্যোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ১৮২৯-এর জুলাই মাসে রাজা রামমোহন বেন্টিঙ্কের সঙ্গে সরাসরি দেখা করলেন। ৪ ডিসেম্বর, ১৮২৯ তারিখে প্রিভি কাউন্সিলে সতীপ্রথা ‘Illegal and punishable by the criminal courts’ হিসেবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কেবল বাংলার মাটিতে জনমত সংগ্রহই নয়, রামমোহন ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরেও সতী নিবারণ আইন যাতে বলবৎ থাকে, তার জন্য লর্ড ল্যান্সডাউনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
আরও পড়ুন-বাংলার শ্রমিকদের অঙ্গীকার, ২৬শে দিদির সরকার
কিন্তু আজকের হিন্দুত্ববাদী ব্রিটিশের দালাল সংঘ ও বিজেপির পূর্বসূরিরা সেদিনও বাংলার মাটিতে সক্রিয় ছিল। সতীদাহ প্রথা যাতে রদ না হয়, তার জন্য রাজা রাধাকান্ত দেব, মহারাজ কালীকৃষ্ণ, গোপীমোহন দেব, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধর্মসভা’ উঠেপড়ে লাগে। তারা গভর্নর জেনারেলের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সতী সমর্থকদের পক্ষ থেকে ১১৪৬ জনের স্বাক্ষরযুক্ত দুটি আরজি পেশ করেন। বেন্টিঙ্ক তাঁদের বললেন ব্রিটেনের ‘প্রিভি কাউন্সিল’-এ আবেদন করতে। ‘ধর্মসভা’র পক্ষ থেকে আবেদনপত্রটি ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি ফ্রান্সিস বেথিকে নিযুক্ত করা হল। ২৭ জুলাই, ১৮৩০-এ তিনি ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন। অবশেষে ১১ জুলাই ১৮৩২-এ প্রিভি কাউন্সিল-এ রক্ষণশীলদের আবেদন খারিজ হয়ে গেল। কলকাতায় প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘রিফর্মর’ পত্রিকা, ইয়ংবেঙ্গল ও রামমোহনপন্থীরা যখন উল্লাস প্রকাশ করছেন, তখন হতোদ্যম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় লিখছেন—‘এ প্রকার ধর্মের প্রতি ব্যাঘাত হওয়াতে অবশ্য কহিতে হইবেক পৃথিবী হইতে বিচার মহাশয় লোকান্তর গমন করিয়াছেন। এক্ষণে হিন্দুসকল এই সম্বাদ পাইয়া হাহারবে ক্রন্দন করিবেন তাঁহাদিগের অক্ষিসলিলে যে নদী বহিবেক তাহা কে দৃক্পাত করিবেক”। (হিন্দুগণের মনস্তাপবিষয়ক, ‘সমাচার চন্দ্রিকা হইতে পুনর্মুদ্রিত’, ‘সমাচার দর্পণ’, ১৪ নভেম্বর, ১৮৩২)। সতীদাহ প্রথা রদ হওয়ার পর রামমোহনের প্রাণসংশয় হয়েছিল। তিনি রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে শারীরিক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সশস্ত্র রক্ষীপরিবৃত হয়ে চলতেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষ্যে—‘গাড়িতে যাইবার সময় কোনও কোনও দিন লোকে ইট পাথর কাদা ছুঁড়িয়া মারিত ও বাপান্ত করিত; তিনি নাকি হাসিয়া গাড়ির দরজা টানিয়া দিতেন ও বলিতেন “কোচম্যান হেঁকে যাও” (রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, পৃ. ১০৪)।
সেদিন যারা রামমোহনকে হত্যা করতে চেয়েছিল, আজ বিজেপিশাসিত ভারতে তাদের উত্তরসূরিরাই গুলি চালিয়ে খতম করেছে গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারেকে। তাদের উত্তরসূরিরাই প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক মনীষীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছে। সংঘ এবং বিজেপি আসলে তীব্রভাবে নারীবিদ্বেষী। ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের এক অখ্যাত গ্রামের অষ্টাদশী কন্যা রূপ কানোয়ার ‘সতী’ হয়েছিল। সেদিন ভারতীয় পার্লামেন্টে এই বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে নতুন করে আইন পাশের প্রস্তাব উঠলে বিজেপির সহসভাপতি বিজয়রাজে সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল ‘সতীপ্রথা’র উপর আক্রমণ আসলে ‘সনাতন’ হিন্দুধর্মের উপর আঘাত। কিছুদিন আগে বিজেপির আরেক প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ মন্তব্য করেছিলেন—“শ্রীরামচন্দ্রের ঊর্ধ্বতন চোদ্দো পুরুষের নাম পাওয়া যায়। দুর্গার কোনও পিতৃপরিচয় নেই। কে দুর্গা?”
রাজা রামমোহনের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ আসলে বাঙালির মনন, বাঙালি নারীর সম্মান ও বাংলার মনীষার বিরুদ্ধে বিজেপির দীর্ঘলালিত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। ২০২৬-এর নির্বাচনে বাঙালি এই ঘৃণার পাল্টা জবাব দেবে।

