মনোজ মিত্রর ‘সাজানো বাগান’ গল্প নিয়ে ছবি করবেন ‘বাঞ্ছারামের বাগান’। জমিদার, ও জমিদারের ভূতের চরিত্রে নির্বাচন করলেন উত্তমকুমারকে। তপন সিংহ উত্তমকুমারের অত্যন্ত স্নেহভাজন। নিজের প্রোডাকশনের জতুগৃহতে তপনবাবুকে পরিচালক করছিলেন উত্তমকুমার। এইবারে ভূতের চরিত্র করতে হবে শুনে খুব খুশি। বাড়িতে বসে স্ক্রিপ্ট পড়ার অসুবিধা। তিনি বেলভিউ নার্সিংহোমে একটা স্যুট ভাড়া নিলেন স্ক্রিপ্ট পড়ার জন্য। দু-মাস বাদে শ্যুটিং। কিন্তু এর মধ্যে তপনবাবু লোক মারফত বেণুদির কাছ থেকে স্ক্রিপ্টটা চেয়ে পাঠালেন। কারণ উত্তমকুমারের জন্য দু-মাস অপেক্ষা করা সম্ভব নয় ওঁর পক্ষে। তাহলে যে বাগানটা তৈরি করা হয়েছিল সেটার মরশুমি ফুলগুলো শুকিয়ে যাবে। তাই অন্য নায়ক নিয়ে কাজ হবে। উত্তমকুমার শুনে ভেঙে পড়লেন। ওই সময় নিজের দুর্বল আর্থিক অবস্থাতেও বেলভিউর মতো নার্সিংহোমের স্যুট ভাড়া করেছিলেন স্ক্রিপ্ট পড়ার জন্য যাতে স্নেহের তপনের ছবিতে কোনও খামতি না থাকে। কিন্তু তাঁর একই ব্যবহার। আজ আর হয়তো তাঁর নামে বক্স অফিস হিট হয় না কিন্তু তবুও তিনি উত্তমকুমার। আরও একটা বিষয়ে অত্যন্ত আঘাত পেলেন। যিনি নতুন নায়ক নির্বাচিত হলেন তিনি সব জেনেশুনেও একবারও এলেন না তাঁর কাছে। বিষয়টা গড়াল আদালত অবধি। বিচারক তপন সিংহকে জিজ্ঞেস করলেন, উত্তমকুমারকে পাওয়ার জন্য দু’মাস অপেক্ষা কি খুব বেশি সময়? তপন সিংহ জানালেন তিনি চাইলে ওরকম ১০০টা উত্তমকুমারকে নিয়ে আসতে পারেন কিন্তু দুমাস পরে মরশুমি ফুলগুলো শুকিয়ে গেলে আর নিয়ে আসতে পারবেন না। এই কথা শুনে উত্তমকুমার হতবাক। বুঝলেন আজ শেষবেলায় এই উপেক্ষা, অবহেলাই হয়তো প্রাপ্য ছিল তাঁর। তবু স্নেহের তপনের সঙ্গে আর মামলা-মকদ্দমা করতে মন চাইল না। একটা সময়ের ভাল স্মৃতিগুলোই থাক দুজনের কাছে। চিরক্ষমাশীল উত্তমকুমার মামলা তুলে নিলেন।
আরও পড়ুন-সামনে ২৮ অগাস্ট প্রশিক্ষণ শিবির টিএমসিপির
এর পরে এল সেই কালান্তক ২৩শে জুলাই ১৯৮০। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র শ্যুটিং চলছে টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। উত্তমকুমার মেকআপ নিতে ঢুকছিলেন তাঁর নিজস্ব মেকআপ রুমে। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। জানানো হল, ভেতরে বম্বেরর নায়িকা মেকআপ করছেন ওই রুমে। এখন ঢোকা যাবে না। তখন এই অবহেলা-উপেক্ষা গা-সওয়া হয়ে গেছে। অবহেলিত অপমানিত উত্তমকুমার চলে গেলেন এনটি-১এ তাঁর নিজস্ব মেকাপ রুমে। একটা সময় যাঁরা উত্তমকুমারের মেকাপ রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত শুধু একটু দেখা করার জন্য আজ তারাই ওঁকে ফিরিয়ে দিল গেট থেকে। এটাই বোধ হয় ভবিতব্য। আজ তোমার কী মূল্য দর্শকদের কাছে, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সেটাই একমাত্র বিচার্য। আগে কী করেছ, কাকে কী সাহায্য করেছ সেটা ভুলে যেতে এক মুহূর্ত লাগে না এই ইন্ডাস্ট্রির মানুষের। পেশাগত জীবনে অবহেলা, উপেক্ষা তাই বারে বারে আঘাত করেছে উত্তমকুমারকে।
আরও পড়ুন-উদাসীন কেন্দ্র বিপন্ন কপিল মুনির আশ্রম
কিন্তু এর বাইরে নিজের পরিবারের কাছ থেকেও পেয়েছেন চরম অবহেলা। একটা সময় উত্তমকুমার নিজের পরিবারের কাছে হয়ে উঠেছিলেন শুধু আর্নিং মেশিন। কেবল টাকা আর সেলেব্রিটি ইমেজ যার কাঁধে ভর দিয়ে দিয়ে নিজেও খবর হওয়া যায় এই ছিল তাঁর পরিবারের কয়েকজনের মানসিকতা। সেই মানুষটার চাওয়া পাওয়ার কোনও দাম ছিল না তাঁদের কাছে। এই জন্যই শেষ অবধি ঘর ছাড়া। গিরিশ মুখার্জি রোড থেকে ময়রা স্ট্রিটের এই পথে সুদীর্ঘ কালের অবহেলা, উপেক্ষার ইতিহাস আত্মগোপন করে আছে।
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই বাঙালি সিনেমাপ্রেমী মানুষের কাছে একটা কালো দিন। সেদিন আপামর বাঙালিকে কাঁদিয়ে চলে গেছিলেন বাঙালির নয়নের মণি বাংলা ছবির রাজপুত্র উত্তমকুমার। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি যার কাছে চিরদিন ঋণী থাকবে। সমস্ত কলকাতা সেদিন তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তায় নেমে এসেছিল তাঁদের প্রাণের মহানায়ককে শেষবার দেখার জন্য। আর সংস্কৃতির ধারক মনে করা বামপন্থীরা কী করলেন? আলিমুদ্দিনের ঠান্ডা ঘরে দামি সিগারের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে বামফ্রন্ট সরকার, (যার তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) সিদ্ধান্ত নিলেন যে উত্তমকুমারের শেষযাত্রায় সরকার বা বামপন্থী নেতারা কোনওভাবে নিজেদের যুক্ত করবেন না। এই সিদ্ধান্তের ফলে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম শাসকের গদিতে বামপন্থী সরকার থাকা সত্ত্বেও উত্তমকুমারের মরদেহ কিন্তু রবীন্দ্রসদনে রাখা গেল না। যুক্তি দেখানো হল ভিড়ের। কিন্তু সত্যি কি তাই? এই উত্তমকুমারের মরদেহ নিয়ে যখন রাসবিহারী রোড দিয়ে গিয়েছিল তখন কি ভিড় কিছু কম হয়েছিল? আসলে উত্তমকুমারের চরিত্রে বামপন্থী ইমেজটা ছিল না। আর সেই জন্যই উত্তমকুমারকে ইন্টেলেকচুয়াল তকমা দিতে দ্বিধা ছিল জ্যোতি বসুর নেতৃত্বধীন বামফ্রন্ট সরকারের। তাঁদের কাছে উত্তমকুমার মানে কমার্শিয়াল ফিল্ম লাইনের একজন অভিনেতা বা বলা ভাল বুর্জোয়া শ্রেণির শিল্পের একজন কারিগর। যাকে নিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল ফিল্ম ক্রিটিকরা স্পিলবার্গ, গদার, ত্রুফোর মতো আলোচনা করেন না। যাঁকে বামপন্থীদের নয়নের মণি ইন্টেলেকচুয়ালিটির সর্বোচ্চ প্রতিভূ মৃণাল সেন বলেন, ‘লিপস্টিক হিরো’।
আরও পড়ুন-সামনে ২৮ অগাস্ট প্রশিক্ষণ শিবির টিএমসিপির
বাংলার দারিদ্র্য, দুঃখকে বিদেশের বাজারে পণ্য করে যাকে দিয়ে অন্য ভাবধারার ছবি বানানো যায় না। তাই মৃত্যুর পরে অসংখ্য ভক্তর শেষ দেখা দেখার জন্য সরকারি জায়গায় তাঁকে স্থান দিতে নারাজ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বামপন্থী সরকার। অথচ এই উত্তমকুমারকে পাশে বসিয়ে একদিন ক্রিকেট খেলা দেখেছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ১৯৭৮ সালে পুজোর আগে ভয়ঙ্কর বন্যায় যখন কলকাতা-সহ প্রায় সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ প্লাবিত হয় তখন এই উত্তমকুমারকেই সরকার পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় ত্রাণ সংগ্রহে যাবার জন্য। আর মৃত্যুর পরে তিনি হয়ে গেলেন বুর্জোয়া শ্রেণির সংস্কৃতির মানদণ্ড, সময়ের খেলাওয়ালা কমার্শিয়াল ফিল্মের একজন অভিনেতা মাত্র, বামপন্থী ইন্টেলেকচুয়ালিটিতে যিনি ব্রাত্য, উপেক্ষিত। পেশাগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে বা মৃত্যুর পরেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবহেলা উপেক্ষা কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে উত্তমকুমারের ভাবমূর্তিকে কোনওভাবে ম্লান করতে পারেনি। বামপন্থী তকমা আঁটা, মানিকবাবুর ইন্টালেকচুয়াল নায়ক-নায়িকারাও কিন্তু আজও সাধারণ সিনেমাপ্রেমী দর্শকের কাছে উত্তমকুমারের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেননি। তাই মৃত্যুর ৪৪ বছর পরে আজও উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবি তৈরি হয়, আজও উত্তমকুমারকে আধুনিক প্রযুক্তিতে পর্দায় ফিরিয়ে এনে বক্স অফিস হিট করাতে চান পরিচালক-প্রযোজকরা। এখানেই মহানায়কের জয় সম্পূর্ণ হয়। কয়েকজন পরিচালক প্রযোজকের প্রফেশনাল জেলাসি, বা ইন্টালেকচুয়াল বামপন্থী সরকারের বয়কট তাঁর জনপ্রিয়তায় কোনও দাগ কাটতে পারেনি— পারে না।