ঋত্বিক মল্লিক: আজ বাদে কাল বাপের বাড়ি থেকে উমা রওনা দেবেন সুদূর কৈলাসে। হিমালয় থেকে কৈলাসে যাওয়ার পথে উত্তরবঙ্গের পাহাড়-জঙ্গল দিয়ে যাওয়ার সময়ে গ্রাম্যবধূর ছদ্মবেশে একটু জিরিয়ে নেন, আর রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ান জঙ্গলে। এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একবার মায়ার ছলনায় পথ হারালেন তিনি। জঙ্গল থেকে ভেসে আসা কান্না শুনে অকুস্থলে হাজির হলেন রাজবংশী সমাজেরই কিছু বাসিন্দা। তাঁকে নিয়ে গেলেন নিজেদের গ্রামে। একটি রাত দেবী সেই গ্রামে কাটিয়ে একাদশীর দিন ফিরে চললেন কৈলাসে। সেই রাতে দেবী আসল মূর্তি ধারণ করেন। রাত্রিবেলা আশ্রয় দেওয়ার জন্য বর চাওয়ার আদেশ দেন তিনি। তাঁরা বলেন, ঘন জঙ্গলে চাষ করতে পারে না কেউই। তাই খাদ্যাভাবে ভুগতে হয়। তাই তাঁরা চান গোটা এলাকা শস্যে ভরে উঠুক। এই কথা শোনামাত্রই দেবী তুষ্ট হয়ে বর দেন। পরদিন সকাল থেকেই তিস্তার ওপারের এলাকা শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে। সেই থেকেই বনদুর্গার পুজোর সূচনা। বনদুর্গার আরেক নাম দেবী ভাণ্ডানি। এখানে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী নন। সাধারণ এক নারী। সিংহের বদলে বাঘের উপর অধিষ্ঠিতা। সঙ্গে থাকেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, মালবাজার— সেইসঙ্গে আলিপুরদুয়ার এবং পার্শ্ববর্তী কোচবিহার জেলার বেশ কিছু গ্রামে সমৃদ্ধির দেবী ভাণ্ডানির পুজো ঘিরে ফের জমে ওঠে উৎসবের (Fulpati utsav) আমেজ।
আরও পড়ুন- বাংলার বকেয়া নিয়ে কেন্দ্রের রাজনীতি, পাল্টা অভিষেক
পাহাড়ের দুর্গাপুজো সাধারণভাবে যে খুব আলাদা তা নয়। মোটামুটি সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা এখানেও পালিত হয়। তবু ইতিহাসের দিক থেকে কয়েকটি পুজোর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। ব্রিটিশ আমলে সমতলবাসী প্রচুর বাঙালি জীবিকার কারণে শৈলরানি দার্জিলিঙে এসে আর ফিরে যাননি। আর যেখানে বাঙালি সেখানেই দুর্গাপুজো। এঁদের উদ্যোগেই তৈরি হয় বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন। ১৯১৪ সাল থেকে দার্জিলিং পাহাড়ে দুর্গাপুজার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন। দার্জিলিং থানার পাশেই মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ হল। আগে হলটির নাম ছিল বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন হল। পরে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের নামে হলটির নাম পাল্টে হয় নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হল। হলের জমিটি মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে দান হিসেবে পেয়েছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। হলটি প্রথমে ছিল সম্ভবত কাঠের, আগুনে সেটি ভস্মীভূত হলে বর্ধমানের মহারাজা ও অন্যান্য ধনাঢ্য বাঙালিদের অর্থানূকুল্যে বর্তমান ভবনটি নির্মিত হয়। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গাপুজো বরাবরই আড়ম্বরের সঙ্গে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। দার্জিলিং শহরের বাঙালিহিন্দু সম্প্রদায় পুজোর আয়োজক হলেও এতে হাত মেলান নেপালিভাষীরাও। সেই আমলে দার্জিলিং বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিমা আসত শিলিগুড়ি থেকে টয়ট্রেনে চেপে। ঢাকিরা আসতেন নদীয়া জেলা থেকে। পুজোর সামগ্রী কেনাকাটা করতে নামতে হত সমতলে। মহাষ্টমীর পুজো শেষে নৃপেন্দ্রনারায়ণ হলের অন্নভোগ ছিল রীতিমতো বিখ্যাত। ভোগের খিচুড়ি পেতে পুজোস্থলে ভেঙে পড়ত গোটা শৈলশহরের মানুষ। প্রসাদ বিতরণে হাত লাগাতেন বর্ধমানের মহারাজা হরেকৃষ্ণ মহতাব ও তাঁর সহধর্মিণীও। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গা পুজোর বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানও ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। হল থেকে প্রতিমা কাঁধে নিয়ে শোভাযাত্রা করে শহর পরিক্রমা শেষে সবাই যেতেন কাকঝোরাতে। ঝোরার জলে প্রতিমা নিরঞ্জনপর্ব সাঙ্গ করে হলে ফিরতেন সকলে মিলে। সেখানে বিজয়া সম্মিলনীতে কোলাকুলি, শুভেচ্ছা-বিনিময় শেষে চলত মিষ্টিমুখের পালা।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম পার্ষদ ও সন্ন্যাসীশিষ্য স্বামী অভেদানন্দ ১৯২৫ সালে দার্জিলিঙে রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। চার বছর বাদেই মঠে শারদীয়া দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। এই পুজোয় স্বামী অভেদানন্দের নির্দেশে সন্ন্যাসী এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ এক পঙ্ক্তিতে বসে প্রসাদ গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়।
শৈলশহর দার্জিলিঙের সবথেকে বড় সর্বজনীন দুর্গাপুজোটি হয় শহরের কেন্দ্রস্থল ম্যালে। ১৯৯৯ সাল থেকে ম্যালের স্থায়ী মঞ্চে এই পুজোর শুরু। পাহাড়ে তখন সুবাস ঘিসিংয়ের জমানা। প্রথমদিকে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল ও দার্জিলিং পুরসভার হাতে ছিল পুজোর দায়িত্ব। একসময় প্রতিমা পুজো বন্ধ করে পাথর পুজো করার নির্দেশ দেন ঘিসিং। সুবাস ঘিসিংয়ের এই তুঘলকি কাণ্ডকারখানাকে মন থেকে মেনে নেননি নেপালি-বাঙালি নির্বিশেষে পাহাড়ের কোনও সম্প্রদায়ের মানুষই। বিমল গুরুং জমানায় রাজনৈতিক অশান্তির জেরে ম্যালের পুজো কয়েক বছর বন্ধ ছিল। ২০১৭-তে বিনয় তামাং জিটিএ-র শীর্ষে বসার পর ম্যালে ফের সাড়ম্বরে দুর্…