অর্ধেক মেকআপ
পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কিশোরকুমার এবং সেইসব চরিত্র ছিল বেশ মজাদার। যেমন ‘মিস্টার এক্স ইন বম্বে’ ছবিতে কুমকুমের বিপরীতে তিনি অভিনয় করছিলেন। ১৯৬৪ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। পরিচালক তাঁর সহকারীকে পাঠালেন মেকআপ রুম থেকে কিশোর কুমারকে ডেকে আনার জন্য। শট রেডি।কিন্তু কিশোর কুমার মেকআপ রুম থেকে বেরোবেন না, সহকারী সেকথা এসে পরিচালককে জানালেন। তখন বাধ্য হয়ে পরিচালক শান্তিলাল সোনি মেকআপ রুমে গেলেন। ঢুকে তিনি তাজ্জব হয়ে গেলেন। দেখলেন কিশোর কুমার অর্ধেক মুখটা মেকাপ করে রেখেছেন। বাকি অর্ধেকটা তাঁর নরমাল। কারণ জিজ্ঞেস করায় কিশোর কুমার জানালেন অর্ধেক টাকাই পেয়েছেন এই ছবিতে অভিনয় করার সুবাদে। তাই অর্ধেক মেকআপ। বাকি টাকাটা পেলে তিনি বাকি মুখটাও মেকআপ করে নেবেন। হাফ পেমেন্ট। তাই হাফ মেকআপ। তখন শান্তিলাল সোনি ছুটলেন প্রযোজকের কাছে যে এক্ষুনি কিশোরকুমারকে বাকি পেমেন্ট করে দেওয়া হয়।
ডিগবাজি
জনপ্রিয় পরিচালক এম ভি রামন শ্যুটিং করছিলেন ‘ভাই ভাই’ বলে একটি ছবির। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। তাতে অভিনয় করেছিলেন অশোক কুমার, কিশোর কুমার, নিরূপা রায়, নিম্মি। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ ৫ হাজার টাকায় মন ভরছিল না কিশোর কুমারের। কিশোর কুমার কিছুতেই কাজটা করতে চাইছিলেন না। তখন তাঁর বড়দা অশোক কুমার তাঁকে অনেক অনুরোধ করলেন। কিশোর কুমার কাজটা করতে নামলেন ঠিকই কিন্তু দুষ্টুবুদ্ধি তাঁর মাথায় ছিল। পরিচালকের নির্দেশ মতো তিনি একটি দৃশ্যের শ্যুটিংয়ে যেখানে অশোককুমার এবং কিশোর কুমার দুজনেই রয়েছেন, কিশোর কুমারের চলে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি খানিকটা গিয়ে ডিগবাজি খেলেন তখন কিন্তু শ্যুটিং চলছে। ক্যামেরা অন। ফিল্মের দাম অনেক ফলে ক্ষতি হল কিন্তু তাতে কী। অত কম টাকায় চুক্তিবদ্ধ করিয়েছেন যেমন এবার ঠ্যালা বুঝলেন পরিচালক ।
পরীক্ষা হলে বাল্যকালের কিশোর
পড়াশোনাতে তেমন ভাল কোনওকালেই ছিলেন না কিশোর কুমার। একবার ক্লাস ফাইভের অংকের পরীক্ষার দিন তিনি দেখলেন যা যা প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে তার একটারও তিনি উত্তর দিতে পারবেন না। অথচ পরীক্ষার প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে বেরোনোর কোনও উপায় নেই। তখন তিনি পরীক্ষার খাতা জুড়ে কৌতুক নকশা লিখলেন। ছোট ছোট অদ্ভুত কবিতা লিখলেন। মিষ্টি মিষ্টি মুখের ছবি আঁকলেন। সেইভাবে খাতা সম্পূর্ণ করে তিনি জমা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস রুম থেকে। পরীক্ষকের কী দশা হয়েছিল সেটা অবশ্য জানা যায়নি।
আরও পড়ুন-রাজ্যের বাসিন্দাদের ফেরাতে তৎপরতা
পাঁচ রুপিয়া বারা আনা
কিশোর কুমার জন্ম ইন্দোরে হলেও । পরবর্তীতে মুম্বইয়ের কলেজে পড়াশোনা করতেন সেখানে তাঁর প্রিয় আড্ডাখানা ছিল ক্যান্টিন। সেই ক্যান্টিন থেকে শেষবার বেরোনোর সময় ক্যান্টিনের ম্যানেজার জানিয়ে ছিলেন যে তাঁর বাকি রয়ে গেছে পাঁচ রুপাইয়া বারা আনা। এই সংখ্যাটা তাঁর মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রযোজক ছবি ‘চলতি কা নাম গাড়ি’তে তিনি এই গানটিকে ব্যবহার করেছিলেন ‘পাঁচ রুপাইয়া বারা আনা’। ছবির পরিচালক সত্যেন বসু। সুরকার শচীন দেববর্মণ। তিনি যে কলেজ ক্যান্টিনের কাছে ঋণী ছিলেন ওই টাকার জন্য, সে কথাটাই গানের মধ্যে দিয়ে যেন উঠে এল।
মাথার খুলি ও হাড়গোড়
কিশোরকুমার বরাবরই একা থাকতে ভালবাসতেন। কেউ তাঁকে বিরক্ত করুক এটা তিনি কখনওই চাইতেন না। ঘনঘন যে বিভিন্ন পত্রিকা থেকে বা মিডিয়া থেকে তাঁর ইন্টারভিউ নিতে আসবে এটাও তিনি পছন্দ করতেন না। তাই কিশোর কুমার তাঁর নিজের ঘরেতে মাথার খুলি ও হাড়গোড় ঝুলিয়ে রাখতেন। শুধু তাই নয় ঘরের মধ্যে লালবাতি জ্বালিয়ে একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। এটা মূলত অন্যদের ভয় দেখানোর জন্যই যাঁদের তিনি পছন্দ করেন না। অথচ তিনি নিজেও কিন্তু ভূতের ভয় পেতেন!
আজব শর্ত
নানা রকম দুষ্টু বুদ্ধি তো সারাক্ষণই ঘুরত কিশোর কুমারের মাথায়। কিশোর কুমারের দাদা অশোককুমার এবং বি আর চোপড়া অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন। পারিবারিক সমস্যার জন্য কিশোরকুমার একবার বি আর চোপড়ার কাছে টাকা ধার চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বি আর চোপড়া একটা শর্ত রেখেছিলেন। তখন কিশোর কুমার বলেছিলেন যে, ‘এখন আপনি শর্ত রাখলেন, যখন আমার সময় আসবে তখন আমিও কিন্তু শর্ত রাখব।’ এ-কথা সবাই ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিশোর কুমার ভোলেননি। একবার যখন বি আর চোপড়া তাঁর নতুন ছবিতে গান করানোর জন্য কিশোর কুমারের কাছে খবর পাঠালেন তখন কিশোর কুমার একটা শর্ত দিয়ে দিলেন। বলেছিলেন, বি আর চোপড়া যেন ধুতি পরে তাঁর কাছে আসেন। পায়ে মোজা দিয়ে জুতো পরে মুখে পান খেয়ে মুখ লাল করে তাঁর কাছে আসেন। মজার কথা হল বি আর চোপড়া কখনও ধুতি পরতেন না আর কখন পান খেতেন না।
সাবধান বাণী
সাধারণত যেসব বাড়িতে কুকুর পোষা হয় সেখানে বাড়ির গেটের সামনে লিখে রাখা হয় ‘কুকুর হইতে সাবধান’। কিন্তু কিশোর কুমার নিজের গেটের সামনে লিখে রেখেছিলেন— ‘কিশোর কুমার থেকে সাবধান’। একবার ডিরেক্টর মোহন সায়গল যখন ছবি করেছিলেন ‘নিউ দিল্লি’, কিশোর কুমারকে তাঁর বাকি টাকাটা দিতে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন। টাকা দেওয়ার পর মোহন সায়গল যখন হ্যান্ডশেক করার জন্য কিশোর কুমারের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তখন কিশোর কুমার তাঁর হাত কামড়ে দিয়েছিলেন। পরিচালক তো ঘাবড়ে গেলেন। তিনি বুঝতেই পারলেন এর কারণ কী। তখন কিশোরকুমার জানালেন, ‘আপনি কি দেখেননি যে আমার গেটের কাছে লেখা রয়েছে কিশোর কুমার থেকে সাবধান!’
আরও পড়ুন-শনিবার থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি, রাজ্যে কমবে বৃষ্টি
তাজ্জব করা ঘটনা
১৯৬২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাফ টিকিট’ ছবিটিকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে নায়ক-নায়িকা হলেন কিশোর কুমার এবং মধুবালা। এ ছবির পরিচালক কালিদাসের সঙ্গে কিশোর কুমারের এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আদালত থেকে জানানো হয়েছিল যে পরিচালকের নির্দেশ কিশোরকুমারকে মেনে চলতে হবে।
এই সুযোগটা কিশোর কুমার তাঁর শ্যুটিংয়ের মধ্যে বদলা হিসেবে নিয়েছিলেন। একটি দৃশ্যের টেকিং শুরু হয়ে গেছে। কিশোর কুমার গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসা এবং পরিচালক ‘স্টার্ট সাউন্ড অ্যাকশন’ বলার পর গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ি চলছে তো চলছেই এবং পরিচালকের দৃষ্টির বাইরে গাড়ি চলে যায়। গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো একেবারে খান্ডালায়। পরে যখন কিশোর কুমার ফিরে এলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন যে সে গাড়ি নিয়ে খানিকটা গিয়ে নেমে এল না কেন? তখন পরিচালককে কিশোর কুমার জানালেন যে পরিচালক শট-এর পরে কাট বলেননি। পরিচালকের নির্দেশ মেনে তিনি খান্ডালা পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন।
গাছের প্রতি টান
খুব শখ ছিল গাছ নিয়ে। কিশোর কুমারের নিজের বাড়িতে নানান রকমের গাছ পুঁতে ছিলেন। প্রত্যেকটা গাছের তিনি আলাদা আলাদা করে নাম রেখেছিলেন। সেই নাম ধরে ডাকতেন। অনেকেই লক্ষ্য করেছেন যে কিশোর কুমার সেইসব গাছের সঙ্গে কথাও বলছেন— যেন কতদিনের সখ্যতা।
গান রেকর্ডিংয়ে দেরি করে আসার কারণ
কলকাতার বাঙালি পরিচালক অসিত সেন তখন বোম্বেতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর পর পর ছবি হিট করছিল। সেই সময় তিনি তাঁরই বাংলা হিট ‘চলাচল’-এর হিন্দি করলেন ‘সফর’। যেখানে তিনি অভিনেতা হিসেবে নিয়েছিলেন রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুর এবং ফিরোজ খানকে। সেখানে রাজেশ খান্নার লিপে এক অদ্ভুত সুন্দর গান ছিল ‘জিন্দগি কা সফর’। এই গান রেকর্ডিংয়ের দিন স্কোরিংরুমে অসিত সেন-সহ সুরকার মিউজিশিয়ানরা সবাই অপেক্ষা করছেন। কিশোরকুমারের দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। ফলে তাঁকে ধরাও যাচ্ছিল না। যখন প্যাকআপের সময় হয়ে গেছে সেই সময় কিশোরকুমার ছুটতে ছুটতে হাজির হলেন। জানালেন তাঁর এই দেরির মূল কারণ হল দর্জিওয়ালা। সবাই তো অবাক হয়ে গেলেন। দর্জিওয়ালার সঙ্গে এখানে কী সম্পর্ক? তখন কিশোর কুমার জানালেন— এই যে একটা দুঃখ-বেদনার গান তিনি গাইবেন তার জন্য তিনি একটি পাঞ্জাবি বানাতে দিয়েছিলেন হলুদ রঙের, কিন্তু সেটি হয়ে গিয়েছিল অশোক কুমারের সাইজের। সেটা কাটিয়ে ছোট করে পরে আসতে সময় লেগে গেল। বোঝাই গেল এর মধ্যে সত্যতাটা কমই আছে। কিন্তু তিনি এসে গেছেন, সুন্দর করে গান রেকর্ডিং হয়েছে, তাই সেটা নিয়ে আর কিছু কথা ওঠেনি। এই মজাদার ঘটনার কথা অসিত সেন নিজে আমাকে জানিয়ে ছিলেন যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম কলকাতা দূরদর্শনের ‘ক্লোজআপ’ অনুষ্ঠানে।
আরও পড়ুন-ড্র করেও শীর্ষে ডায়মন্ড হারবার, শেষ মুহূর্তের পেনাল্টিতে হাতছাড়া জয়
মহানুভবতার পরিচয়
বিরাট স্টার কাস্টিং-এর ছবি ‘শোলে’। ‘মেহেবুবা ও মেহেবুবা’ গানটি প্রথমে গাইবার কথা ছিল কিশোর কুমারের। তাঁর বাড়িতে গানটি তৈরি হয়েছিল। ছবির সুরকার রাহুল দেব বর্মন (ডাকনাম পঞ্চম)। যেভাবে পঞ্চম গাইছিলেন কিশোর কুমার ঠিক সেইভাবে গাইতে পারছিলেন না। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর হঠাৎ কিশোর কুমার বলে উঠলেন ‘যাই বলো আর তাই বলো এই গানটা আমার থেকে তোমার গলায় অনেক অনেক ভাল লাগবে। এটা তুমিই গেয়ে দাও।’ তারপরের ঘটনা সবার জানা। একটি ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল গানটি নিয়ে। এমনই একটি ঘটনা ঘটলো, ‘ক্যারাভান’ ছবির ক্ষেত্রেও। জিতেন্দ্র, আশা পারেখ অভিনীত ওই ছবিতে একটি গান ছিল, ‘পিয়া তু আব তো আজা’। এই গানটি প্রথমে গাওয়ার কথা ছিল কিশোর কুমার এবং আশা ভোসলের। গানটির মধ্যে একটা শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার বিরাট ব্যাপার ছিল। সেটা কিছুতেই কিশোর কুমার আয়ত্ত করতে পারছিলেন না। শেষে তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে পঞ্চমকে বললেন, ‘বুঝলে এটা তুমি গেয়ে দাও।’ অতঃপর এই গানটা গাইলেন পঞ্চম অর্থাৎ রাহুল দেব বর্মন এবং আশা ভোসলে। আরও একটা গান ছিল ‘দিল সে দে’ এই গানটিও কিশোরকুমারের গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিশোর কুমারের অনুরোধে সেই গানটিও গেয়েছিলেন রাহুল দেব বর্মন। এখনকার দিনে কেউ এভাবে নিজের গান অপরের জন্য কি ছেড়ে দিতে পারেন? সে-কাজটা কিন্তু কিশোর কুমার করেছিলেন।
আরও পড়ুন-আর্জেন্টিনাকে হারাল ফ্রান্স
মঞ্চের মাপ
কিশোর কুমার যখন কোনও বিচিত্রানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে যেতেন তখন সেখানে মঞ্চটাকে একটু বড় করেই সাজাতে হত। কারণ তিনি নানান রকম মজাদার কাজকর্ম করতেন মঞ্চে উঠে। সেইভাবেই স্টেজটাকে সাজানো হত। বনশ্রী সেনগুপ্ত তাঁর একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উত্তরবঙ্গের একটি অনুষ্ঠানে কিশোর কুমার স্টেজে উঠছেন, কিশোর কুমারের গান গাইবার কথা। তিনি স্টেজে উঠলেন হামাগুড়ি দিয়ে। পুরো স্টেজটা হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরলেন। তারপরে তিনি মাইক ধরলেন। বনশ্রী সেনগুপ্তের হেসে খুন হওয়ার জোগাড়। যাঁরা সেদিন অনুষ্ঠান দেখতে গেছিলেন তাঁদেরও সেই একই দশা ঘটেছিল। জীবন যাঁরা পূর্ণ মাত্রায় উপভোগ করতে জানেন কিশোর কুমার তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য।