গঙ্গা আমার মা

এ-শুধু একটা নদীর আত্মকথা নয়। সভ্যতা গড়ে ওঠার ধারাবিবরণ। পরিবারে মায়েদের মতো সভ্যতাকেও এগিয়ে নিয়ে যান মা গঙ্গা। তাঁকে নিয়েই আমাদের নানা উদযাপন। নানা অহংকার। নানা অভিমান। কিন্তু আজ মা গঙ্গা দূষণের চক্রব্যূহে দাঁড়িয়ে পথ খুঁজছেন বেরনোর। কীভাবে বেরোবেন মা গঙ্গা? সেই পথ দেখানোর চেষ্টা করলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

চেনা গঙ্গার ছবি
রেডিওতে তখনও মহিষাসুরমর্দিনী বাজছে। ভোরের আলো ফোটেনি। ঘরে ঘরে ঘুম-জড়ানো শ্রোতারা শুনছে জাগো দুর্গা। আর ঠিক সেই সময় গঙ্গার ঘাটে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের ভিড়। কাদামাখা হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে তাঁরা পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করছেন। করজোড়ে বলছেন পিতৃপুরুষের অমরত্ব প্রাপ্তির কথা, সুখে থাকার কথা। কাদাজলে ভেসে চলেছে ফুল ভরা প্লাস্টিক, মিষ্টির প্যাকেট, ধূপের প্যাকেট। আধো আলোতে মহিলারা গঙ্গার পাড়ে আত্মার প্রিয় পুরুষ হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে। মা গঙ্গাকে স্পর্শ করে তর্পণ করার অধিকার তাঁদের নেই। অথচ মা গঙ্গা দু’হাত ভরে গ্রহণ করছেন যা কিছু ভাল যা কিছু খারাপ। নিঃশব্দ অভিমানে বয়ে চলেছে দূষণের অন্য ধারা। ভোরের আলোয় গঙ্গার পবিত্র-অপবিত্র বয়ে চলা।
ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে মোহিনী। কয়েক মিনিট আগেই মাকে ছুটি দিয়েছেন, হাতে মাটির সরায় কাদার ঢিলের মধ্যে মায়ের পিণ্ড ভাসাতে হবে গঙ্গার জলে। ছোটবেলায় মা-ই তাঁকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে গঙ্গা পরিষ্কার রাখতে হয়। গঙ্গা পরিষ্কার থাকলে আমাদের কতটা উপকার হয়। এতে পরিবেশ বাঁচে, মানুষ বাঁচে। সেই গঙ্গাকে আমরা দেবতা করে তুললাম। কিন্তু সত্যি ভালবাসতে পারলাম না।

আরও পড়ুন-আজ শুরু ইউরো কাপ, ঘরের মাঠে নতুন পরীক্ষা জার্মানির

একরাশ মুগ্ধতার নাম গঙ্গা
গঙ্গা শুধু একটা নদী নয়। এ-যেন বহমান ভারতবর্ষ। এর পরতে পরতে, বাঁকে বাঁকে ইতিহাস, ধর্ম আর বিশ্বাস। নিঃশব্দে বহুযুগ ধরে গঙ্গাই যুগিয়ে চলেছে বহু মানুষের পেটের ভাত। তার দু’পার ভারতবর্ষের বহু মানুষের কর্মক্ষেত্রের লীলাভূমি। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় শিল্প এই গঙ্গা হাজার হাজার মানুষকে দু’মুঠো খেতে দেয়। ঠিক যেন আমাদের বাড়ির মায়েদের মতো। তাই আমরা পুজো করি আবার দিনে দিনে অসম্মানের মাত্রা বাড়াই তাকে প্রাণভরে দূষিত করে। এই সংঘাত, এই বঞ্চনা মেনে নিয়ে নীরবে আপন বেগে বয়ে চলে মা গঙ্গা। কেউই ভাবে না গঙ্গা বাঁচলে আমরা বাঁচব। কেউই ভাবে না গঙ্গার দূষণ কমলে আসলে তা আমাদের সকলের ভাল থাকার ডিভিডেন্ড দেবে।
অথচ গঙ্গা মানেই ছিল একরাশ মুগ্ধতা, পবিত্রতা। হৃষীকেশে হালকা নীলাভ স্বচ্ছ জলের গঙ্গাকে দেখে মুগ্ধতা বাড়ে। কিন্তু কলকাতায় গঙ্গা তার বিশালতা নিয়ে হাজির হলেও তার জল ঘোলা। কিন্তু হৃষীকেশে গঙ্গা তেমন একটা চওড়া নয়। তাকে দেখে দুরন্ত জলের ধারা বলেও মনে হয় না। বরং সেখানে ধীরে ধীরে বয়ে যাওয়া গঙ্গাকে মনে হয় এক শুদ্ধ ও টলমল স্রোতস্বিনী। কেন হৃষীকেশে গঙ্গার এই নীলাভ জল বেশি দূর পর্যন্ত তার টলমলে নীলাভ রং ধরে রাখতে পারেনি তার ব্যাখ্যা ভূগোল বা ভূতত্ত্বে পাওয়া যাবে। কিন্তু গঙ্গা জলের শুদ্ধতা কেন হৃষীকেশের মতো কানপুর, এলাহাবাদ, বারাণসী, পাটনা আর কলকাতায় নেই তা অবশ্যই আমাদের ভাবনার বিষয় কারণ গঙ্গা জলের দূষণের দায় বেশির ভাগই যে তার দু’পারের বাসিন্দাদের সেটা বলার জন্য গবেষণার দরকার পড়ে না। তবু গঙ্গা পাড়ের মানুষজন শিল্প কারখানাকে দায়ী করে নিজেরা সুখী থাকতে চান, স্বস্তি পেতে চান। কিন্তু বিভিন্ন সময় একাধিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে খালি মানুষ বর্জ্যই এই গঙ্গাদূষণের জন্য সিংহ ভাগ দায়ী। বাকিটা কারখানার শিল্প-বর্জ্য, চাষাবাদে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, নানা কঠিন বর্জ্য, গঙ্গায় ভেসে যাওয়া মানুষ ও পশুপাখির মৃতদেহ থেকে হয় বলে মনে করে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।

আরও পড়ুন-শুরু হজ, ১৫ লক্ষ তীর্থযাত্রী এবার মক্কায়

নগরের হৃৎপিণ্ড
শুধু দেশের নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত নদীর নাম গঙ্গা। তবে দূষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আজ নয়, বহুদিন আগে থেকে। বৈদিক যুগ থেকেই তীরবর্তী মানুষ গঙ্গাকে দূষিত করতে শুরু করেছে, তার পরম্পরা বয়ে চলেছে আজও। সেদিনকার গঙ্গাপাড়ের মানুষ ভক্তিভরে পুজোর বাসি ফুল, বেলপাতা গঙ্গায় ফেলার পাশাপাশি স্বজনের অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন করত এই গঙ্গাপাড়েই এবং যার বর্জ্যের শেষ গন্তব্য ছিল পবিত্র এই নদী। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল মানুষের যা কিছু বর্জ্য তা গঙ্গায় ফেলার অভ্যাস। কালে কালে গাঙ্গেয় ভূমিতে জনসংখ্যা বেড়েছে। গঙ্গাপাড়ে গড়ে উঠতে শুরু করেছে একের পর এক জনপদ। আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নাগরিক বর্জ্য থেকে অন্যান্য সব ধরনের বর্জ্য ফেলার পরিমাণ। আজও গঙ্গাপাড়ের অধিকাংশ বাসিন্দা নোংরা ফেলার সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজলভ্য জায়গা হিসেবে গঙ্গাকেই বেছে নেয়।

আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতের সর্বস্তরে পরিষেবা দিতে চালু কর্মশ্রী পোর্টাল

সংকটে সংকোচে গঙ্গা
খুব বেশি দিন নয়, ৭০-এর দশক থেকে গঙ্গাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে মানুষ। গঙ্গা তার বয়ে যাওয়া প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পথে সবচেয়ে বেশি দূষিত হয় গাঙ্গেয় সমভূমিতেই। যতক্ষণ হিমালয় চত্বরে গঙ্গা বয়ে চলেছে ততক্ষণ তার জল প্রায় দূষণশূন্য বললেই চলে। পাহাড় থেকে নামার পর সাগর পর্যন্ত বয়ে চলার সময় তার দু’পাশের জমিকে ঊর্বরতায় ভরিয়ে তুলেছে নদী। বিস্তীর্ণ এলাকাকে করে তুলেছে শস্যশ্যামল। ফলে এই চলার পথে হাজার হাজার জনপদ গড়ে উঠেছে ইতিহাসের কোন কাল থেকে। দু’পাশে রয়েছে হাজার হাজার সমৃদ্ধ গ্রাম। গড়ে উঠেছে ছোট-বড় শতাধিক শহর, নগর, মহানগরও। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বয়ে যাওয়া ২,৫২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রাপথে গঙ্গার দু’পাশে ২৯টি প্রথম শ্রেণির শহর (যে শহরগুলির জনসংখ্যা ১ লক্ষ বা তার উপর), ২৩টি দ্বিতীয় শ্রেণির শহর (যে শহরগুলির জনসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষের মতো), এবং ৪৮টি মফস্সল (যার জনসংখ্যা ৫০ হাজারের মধ্যে)। এ ছাড়াও রয়েছে কলকাতার মতো মহানগরী, যার জনসংখ্যা ১ কোটিরও উপর। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, গঙ্গা উপত্যকার এই দু’পাশের শহর-নগরের মনুষ্য-জীবনই গঙ্গাকে সবচেয়ে বেশি দূষিত করে চলেছে তার নাগরিক বর্জ্য দিয়ে। কী ভয়ানক ভাবে গাঙ্গেয় সমভূমির নাগরিকরা গঙ্গার দূষণ প্রতিদিন বাড়িয়ে চলেছে, তা বোঝা যায় নিম্ন অববাহিকায় গঙ্গা যেখানে হুগলি নদী নামে পরিচিত, শুধুমাত্র সেই এলাকার মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্য যা নদীকে দূষিত করে চলেছে, সেদিকে নজর দিলে। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গায় প্রতি ১০০ মিলিলিটার জলে ব্যাক্টিরিয়া অর্থাৎ কলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়ার পরিমাণ ১ লক্ষ ৬০ হাজার।’ এত কিছুর পর মা গঙ্গা বয়ে চলেছেন আপন অভিমানে এ যেন আমাদের ‘ঘরের মা’। হাজার অপমান বঞ্চনা সহ্য করেও নীরবে সন্তানের মঙ্গলকামনা করে চলেছে।

আরও পড়ুন-মিষ্টি হাতে বিজেপি কর্মীদের কাছে বোস! কটাক্ষ তৃণমূলের

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
মা গঙ্গাকে দূষণমূক্ত রাখার অভিযান শুরু হয়েছে অনেক আগেই। কখনও গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান (১৯৮৬) কখনও নমামি গঙ্গে (২০১৪) এইসব একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য। তা সত্ত্বেও রোধ করা যাচ্ছে না গঙ্গার দূষণ। বিশেষ করে জাহাজ এবং ভেসেলগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য গঙ্গায় মিশছে। সম্প্রতি এই সমস্ত জাহাজ এবং ভেসেল থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ করতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহণ দফতর। এই সমস্ত বর্জ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ যান আনা হবে। সেই যান জাহাজ এবং ভেসেল থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করবে। তারপরে সংগ্রহ করা বর্জ্য নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়া হবে। তাতে কিছুটা হলেও দূষণ কমবে। এর পাশাপাশি পুজোয় বেসরকারিভাবে গঙ্গায় ভ্রমণ নিয়েও প্রস্তাব পেয়েছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। এবারের দুর্গাপুজোকে মাথায় রেখে গঙ্গা ভ্রমণের উপর বিশেষ জোর দিতে চাইছেন বেসরকারি ভেসেল মালিকরা। দক্ষিণেশ্বর-বেলুড়, মায়াপুর-নবদ্বীপ, ফলতা-জিওনখালি রুটে পরিষেবা শুরু হতে চলেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবার পুজোয় বেসরকারি উদ্যোগে গঙ্গাভ্রমণ হবে। এর পাশাপাশি, নদী কেন্দ্রিক পর্যটন, ট্যুরিজমে কর্মসংস্থান, নতুন রুট তৈরি করা, ভুটভুটির নিরাপত্তার ভাবনা রয়েছে।
পথ বলে দাও তুমি
তবে এগুলো দিয়ে মা গঙ্গাকে পবিত্র করা যাবে না। রুজি রোজগারের পথ বেরোবে। গঙ্গার দু-পার সৌন্দর্যায়ন হবে। কিন্তু দূষণমুক্ত গঙ্গা পাওয়া যাবে না। গঙ্গা দূষণমুক্ত করার আন্দোলন শুরু হয়েছে বহুদিন আগেই কিন্তু কোনও পথ বেরোয়নি। বরং মানুষের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে— আন্দোলন, অনশনে গঙ্গা মুক্তি পায়নি। দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে মা গঙ্গারও গঙ্গাপ্রাপ্তি শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে আশার কথা যে কিছু নেই এমন নয়। গঙ্গার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির কারণে মাছেদের নিরাপদ ভূমি হয়ে উঠছে গঙ্গা। জাতীয় স্বচ্ছ গঙ্গা মিশন প্রকল্পের অধীনে ২০১৭ সাল থেকে গঙ্গা নদীতে নতুন করে মাছ ছাড়ার কাজ শুরু হলেও গত দু’-তিন বছরে এই কাজ অনেক গতি পেয়েছে। এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে গঙ্গা নদীতে ১ কোটি মাছ ছাড়া হয়েছিল। তার মধ্যে এক লক্ষ ইলিশ মাছও ছিল। গঙ্গানদীর জলের গুণমান যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার প্রমাণ এই নদীতে ডলফিনের সংখ্যা ২০০০ থেকে বেড়ে ৫ হাজার হয়েছে। গঙ্গাকে মানুষ পুজো করে তার স্বচ্ছতার জন্যে, তার নির্মলতার জন্য, সে-কারণেই গঙ্গার জলকে পবিত্রজ্ঞানে পুজো করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রথমে সিন্ধু নদী তারপর গঙ্গানদী ভারতবর্ষের নদীমাতৃক সভ্যতার দ্যোতক। গঙ্গার জল পান, কৃষিতে ব্যবহার, নিত্যদিনের নানা কাজে সেই জলের ব্যবহার, গঙ্গাই সভ্যতার চালিকা শক্তি তাই তাঁকে পুজো করা। কিন্তু আজ তো গঙ্গার জল পানের অযোগ্য শুধু নয়, স্নানেরও অযোগ্য বলে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ঘোষণা করেছে।
২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ দেশের নদীগুলির দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করে এক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তাতে গঙ্গাদূষণ সম্পর্কে যা তথ্য রয়েছে তা ভয়াবহ। উৎসস্থল উত্তরাখণ্ড থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে গঙ্গা যত এগিয়েছে ততই মারাত্মকভাবে বেড়েছে দূষণ।

আরও পড়ুন-রাজ্যের কারিগরদের তৈরি হস্তশিল্প এবার মিলবে দুবাইয়ে

অতুল্য গঙ্গা সাইক্লোথন
আজ গঙ্গা দূষিত। যখন গঙ্গাপূজা শুরু হয়েছিল তখন মানুষের জীবন নদী-নালা, খাল-বিলের সাথে ছিল সম্পৃক্ত। শিল্পবিপ্লব-নগরায়ণের পরে এসব থেকে এসেছে বিচ্ছিন্নতা, তখন নির্মল— পবিত্র গঙ্গার উদ্দেশ্যেই পূজার্চনা করা হত; শিল্পবিপ্লব-নগরায়ণের পরে ধীরে ধীরে গঙ্গা অপরিষ্কার-অপবিত্র হতে শুরু করে। আজ তার চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। আজ প্রতিটি ধার্মিক মানুষের এই আর্তি, ‘গঙ্গার নির্মলতা– পবিত্রতা ফিরিয়ে দাও’, তাহলেই তার উদ্দেশ্যে পূজার্চনা সার্থক হবে। মা গঙ্গাকে বাঁচাতে পারলেই আসলে সম্মান করা হবে প্রকৃতিকে, সম্মান করা হবে নারীকে।
গঙ্গাকে বাঁচাতে দূষণমূক্ত করতে আমরা নানান অভিনব প্রয়াস নিয়েছি। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে ২৮ দিনের অতুল্য গঙ্গা সাইক্লোথন-এর আয়োজন হয়েছে গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত। গঙ্গোত্রী থেকে গত ১ মার্চ শুরু করে ১৪ জন সাইকেল আরোহী ২৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ২৮ মার্চ গঙ্গাসাগরে এসে পৌঁছেছেন।

আরও পড়ুন-পরিস্থিতি অনুকূল মঙ্গলেই বর্ষার প্রবেশ দক্ষিণে

ভয় নয়, জয় হবেই
গঙ্গা আমাদের মা তাকে বাঁচাতে পারলেই আমরা বাঁচতে পারব সভ্যতা বাঁচতে পারবে। তাই অতুল্য গঙ্গা প্রকল্পে গঙ্গা নদীর ২২৫টি জায়গায় দূষণ ম্যাপিং করা হয়েছে। শুধু প্লাস্টিকের ব্যাবহার কমানো নয় দু-পাশে গাছ লাগানোর উপরও জোর দেওয়া হয়েছে। শুধু আমরা নয়, যাদের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ গঙ্গাদূষণের, এখন তাঁরাই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। জেহাদ ঘোষণা করেছেন গঙ্গাকে বাঁচানোর জন্যে- দুর্গাপুজোয় পুজোর বাসন ধোয়া, কলাবউ স্নান— এসব হবে কলের জলে। আর কোনও মণ্ডপের সামনে পুকুর বা নদী থাকলে ব্যবহার করতে হবে সেই জল | তা ছাড়াও কাজে লাগানো হবে বৃষ্টিধারার জল| এতে জল অপচয়ও কম হবে। এর আগে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে মূর্তি বিসর্জন বা ক্রমাগত আবর্জনা ফেলার ফলে গঙ্গা নদী তার স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলছে। এই দূষণ যে কী মারাত্মক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, সেটা গবেষকদের কল্যাণে আমরা জানতে পারছি। আর শিউরে উঠছি এই ভেবে যে, প্রকৃতির দেওয়া সেই স্বচ্ছ, পবিত্র নদীটি কোথায়! কলুষিত হতে হতে গঙ্গার জল এখন এমন অবস্থায় চলে এসেছে যে তার মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন এক প্রজাতির জিন। যা বিভিন্ন জলজ ব্যাক্টিরিয়ার জীবনচক্রে মিশে গিয়ে সেগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে তুলছে বলে দাবি করলেন একদল গবেষক। ব্রিটেনের নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লি আইআইটি-র বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান পত্রিকা ‘জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি’তে। গবেষকদের দাবি, গঙ্গার উজানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জলের নমুনা সংগ্রহ করে তাঁরা জিনটি খুঁজে পেয়েছেন। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসব ব্যাক্টিরিয়ার জীবনচক্রে সেটি প্রবেশ করে, অ্যান্টিবায়োটিক তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

আরও পড়ুন-যোদ্ধা মায়ের অভিযান

স্বপ্ন দেখা গঙ্গা
এখানেই শেষ নয়। অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়াগুলো একবার মানুষের শরীরে ঢুকলে স্থায়ীভাবে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে। অন্ত্রে বাসা বেঁধে বংশবিস্তার করে। এবং মলবাহিত হয়ে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে, সেখান থেকে আরও মানুষের দেহে। তারা জিন সঞ্চারিত করে অন্য অপ্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়াকেও অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে তোলে। যে প্রক্রিয়া জারি থাকলে গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর গবেষকদের অনেকে। সুপ্রিম কোর্ট বলতে বাধ্য হয়েছে, ২০০ বছরেও গঙ্গাশোধন হবে না। আমরা মঙ্গল গ্রহে যেতে সফল, কিন্তু গঙ্গাদূষণ নিয়ন্ত্রণে? যা ৫০ কোটি ভারতীয়ের জীবনরেখা? গঙ্গাদূষণ নিয়ন্ত্রণ আর কতদিন রাজনীতিক বা রাষ্ট্রনায়কদের মুখের বুলি হয়ে থাকবে? না। বৃথাই আমরা বলি— গঙ্গা আমাদের মা!

Latest article