ঠোঁটকাটাদের সঙ্গে কথা বলতে যতই ভয় পান না কেন ক্লিনিকালি ক্লেফট লিপ বা ক্লেফট প্যালেট হল একটি জন্মগত ত্রুটি। চলতি বাংলায় যাকে আমরা বলি ‘গন্নাকাটা’। সেই ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা এবং সঙ্গে ক্রেনিওফেসিয়াল সমস্যা যেমন মাথার খুলি ও মুখের হাড়ের গঠনগত ত্রুটি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে জুলাইয়ে পালিত হয় ক্লেফট লিপ ও ক্রেনিওফেসিয়াল সচেতনতা মাস।
সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি ৭০০ শিশুর মধ্যে একজন ক্লেফট লিপ, ক্লেফট প্যালেটের শিকার বা একই সঙ্গে দু-ধরনের ত্রুটিরই শিকার। এই জন্মগত ত্রুটি হলে সাধারণত উপরের ঠোঁট বা তালুর একটি অংশ জন্মগতভাবেই তৈরি হয় না। ফলে গভীর এক ক্ষত তৈরি হয় মুখে।
আরও পড়ুন-গেরুয়া ত্রিপুরায় স্মার্ট মিটারের নামে প্রহসন, এক মাসে বিল বাড়ল ৬১ হাজার টাকা
ক্লেফট প্যালেট ও
ক্লেফট লিপ
গর্ভধারণের চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে মুখের অংশ তৈরি হয় মানবশিশুর। এই সময়ে ধাপে ধাপে তৈরি হয় ঠোঁট ও টাগরা। বেশ কিছু ক্ষেত্রে টাগরা সঠিক ভাবে না জুড়ে নাকের ডগা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দু’দিকের ঠোঁট ঠিকভাবে না জুড়লে নাক ও ঠোঁটের মধ্যে একটা বিশাল ফাঁক তৈরি হয় এবং বিকৃত আকার ধারণ করে। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন গঠনগত প্রক্রিয়া সঠিকভাবে না হলে এই ধরনের ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্ম নিতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘ক্লেফট প্যালেট’।
গর্ভধারণের চার থেকে সাত সপ্তাহের মধ্যে শিশুর ঠোঁট তৈরি হয়। মাথার দু-পাশের টিস্যু মুখের ঠিক মাঝখানে এসে জুড়ে ঠোঁট এবং মুখ তৈরি করে। ওই টিস্যুগুলো সম্পূর্ণরূপে না জুড়লে ঠোঁট কাটা হয়। ফলস্বরূপ, উপরের ঠোঁটের দুই পাশের মধ্যে একটি খোলা বা ফাঁক তৈরি হয়। একে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ক্লেফট লিপ।
ক্রেনিওফেসিয়াল সমস্যা
এটা হল মুখ এবং মাথার করোটি বা খুলি সংক্রান্ত ত্রুটি বা রোগ। এটা জন্মগতও হতে পারে বা কোনও আঘাত এবং টিউমার থেকেও হতে পারে, সংক্রমণ থেকেও হতে পারে। যেমন ক্রেনিওসিনয়োরোসস্টোসিস। এক্ষেত্রে মাথার খুলির হাড় একজায়গায় জড়ো হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি ফ্র্যাকচার বা টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
ট্রমা বা আঘাতের কারণে হাড় ভাঙা, নরম টিস্যুর ক্ষতি এবং স্নায়ুর আঘাত হতে পারে।
টিউমার, সংক্রমণ এবং প্রদাহজনক রোগগুলি ক্রেনিওফেসিয়াল সমস্যা বা ত্রুটি তৈরি করতে পারে।
ফেসিয়াল নার্ভ পলসি (যেমন বেল পলসি) মুখের পেশিগুলির দুর্বলতা বা পক্ষাঘাতের কারণও এই সমস্যা হতে পারে।
সমস্যার কথা
ক্লেফট লিপ যে শিশুর রয়েছে তাদের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। কারণ এই শিশুরা নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই শিশুরা জন্মেই খুব স্বাভাবিক ভাবে মাতৃদুগ্ধ পান করতে পারে না। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খেতে সমস্যা হয়, চিবোতে সমস্যা হয়। কারণ অনেক সময় খাবারটা নাকের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে।
ক্লেফট প্যালেট বা তালুকাটা শিশুরা স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না। তাদের কথা বলা নাকিসুরে হয়ে যায়। ঠিকমতো হাসতে পারে না।
ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা শিশুর কানের, দাঁতের সমস্যা দেখা দেয়। কোনও ক্ষেত্রে দাঁত ঠিকমতো গজায় না। দাঁতে, কানে সংক্রমণ হয়।
এ ছাড়া মানসিক, সামাজিক সমস্যা, আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়।
গর্ভাবস্থাতেই সতর্ক হোন
গর্ভাবস্থার আগে এবং তারপরে প্রথম তিন মাস পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড নিলে ঠোঁটকাটা ও তালুকাটার ঝুঁকি কমে।
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের মধ্যে ধূমপান এবং অ্যালকোহল নেওয়ার প্রবণতা শিশুর মধ্যে রোগের ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে তোলে।
এসময় যে কোনও ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
যদি গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস বা অতিরিক্ত ওজন থাকে তাহলে এর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
যদি পরিবারে কারও ঠোঁট কাটা বা তালু কাটার ইতিহাস আগে থেকে থাকে, তাহলে গর্ভধারণের আগেই জেনেটিক কাউন্সিলিং করিয়ে নিন।
আরও পড়ুন-শিক্ষাক্ষেত্রে ট্রাম্পের নীতিতে সায় দিল মার্কিন সুপ্রিম কোর্টও
চিকিৎসা
এই ক্ষত সারাতে হলে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রোপ্রচারই অন্যতম পথ। অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে এই ফাটল বন্ধ করা হয়, ক্লেফট লিপে সাধারণত ৩-৬ মাস বয়সে করা হয়। এরপর, কথাবলা এবং খাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে স্পিচ থেরাপি এবং অন্যান্য থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া, দাঁতের যত্নের জন্য ডেন্টিস্টের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। ক্লেফট প্যালেটে ১২ থেকে ১৮ মাস বয়সে ফাটল বন্ধ করার অস্ত্রোপ্রচার করা হয়। তবে তা সম্পূর্ণ নিখুঁত হয় না। অনেক সময় কাটা দাগ থেকে যায়।
পরবর্তীতে যাদের কথা বলতে সমস্যা হয় তাদের জন্য স্পিচ থেরাপি করানো যেতে পারে।
ক্রেনিওফেসিয়াল সমস্যার চিকিৎসা কিছু নির্দিষ্ট অস্ত্রোপ্রচার। যা মুখ, চোয়াল, মাথার খুলির গঠনগত সমস্যার সমাধান করে। এছাড়া পরবর্তীতে অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচথেরাপি, ফিজিক্যাল থেরাপিও চলে।
নতুন গবেষণা
বিগত বছরে ক্লেফট লিপ এবং প্যালেট জনিত সমাধান করতে একটি নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেছেন সুইৎজ়ারল্যান্ডের চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন জন্মগতভাবে হোক অথবা আঘাত লেগে বা দুর্ঘটনায় ক্ষত এই নতুন পদ্ধতিতে তার নিরাময় সম্ভব। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে সরিয়ে ফেলে, সেই জায়গায় নতুন কোষ প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব। এর ফলে ঠোঁটের বা তালুর খুঁত নিপুণভাবে ঢেকে দেওয়া সম্ভব হবে। সুইস চিকিৎসকদের দাবি এই পদ্ধতির কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আশা করা যাচ্ছে এই ধরনের জন্মগত ত্রুটির ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার অনেক আশার আলো দেখাবে।