ঘুঘুর বাসা

মেজমামি কঙ্কাকে ফোন করে বলে, ‘এত সুন্দর ফ্ল্যাট কিনলি, ঝকঝকে করে সাজালি, বারো তলার উপর থেকে সব কিছু ছবির মতো লাগে

Must read

মহুয়া মল্লিক: মেজমামি কঙ্কাকে ফোন করে বলে, ‘এত সুন্দর ফ্ল্যাট কিনলি, ঝকঝকে করে সাজালি, বারো তলার উপর থেকে সব কিছু ছবির মতো লাগে। তোর ফ্ল্যাটে গেলে একটা পজেটিভ ভাইভস কাজ করে। তবু তোর মা ফ্ল্যাটটা নিজের মনে করতে পারে না। তোর মায়ের মন সেই শ্যাওলা ধরা মুকুন্দ লেনের বাড়িটাতেই পড়ে আছে।’
  অফিসটাইমে দরকারি ফোন ছাড়া অন্য ফোন আসা সে একদম পছন্দ করে না। আর মেজমামির ফোন তো একদমই না। মানুষটা জিভে বিষ নিয়ে ঘোরে। তাই সে কথা ঘোরাবার জন্য বলল, ‘মায়ের কাছে এসে ক’দিন থেকে যেতে পারো তো, তোমার যখন আমাদের ঐ পায়রার খোপ এতই পছন্দ হয়েছে।’ মেজমামি তবু চেষ্টা করে গেল, ‘তোর মা বলে কিনা কঙ্কার বাড়ি কি আর আমার বাড়ি? আমি তো বাপু নুনের কৌটো ধরতেও ভয় পাই। ও বড্ড বেশি শৌখিন। একটা জিনিস এদিক-ওদিক হলে বিরক্ত হয়। কথাতেই বলে পরভাতি হলেও পরঘরি হোয় না।’
কঙ্কা মায়ের সেই পেটেন্ট ডায়লগ শুনে হো-হো করে হেসে ফেলে। পরের কাছে ভাত খেলেও পরের বাড়িতে থেকো না, স্বাধীনতা বা মানসম্মান কিছুই থাকবে না। অথচ ডিভোর্সের পর তো মা তাকে নিয়ে মামার বাড়িতেই এতগুলো বছর কাটিয়েছে। দাদু অবশ্য পরে মায়ের নামে বাড়ির একটা অংশ লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন, মামা-মামিরা যাতে টুঁ শব্দটি করতে না  পারে। আর এই ফ্ল্যাটটা তো কঙ্কা মায়ের সঙ্গে যৌথ ভাবেই কিনেছে। পরঘরির কথা আসবে কেন? সত্যি মেজমামি পারেও পুরনো রেফারেন্স জায়গা মতো কাজে লাগিয়ে সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তুলতে। কঙ্কা ফোনটা কেটে দেয়।
বাড়ি ফেরে কিছু ফল আর একটা নামী কোম্পানির কেক নিয়ে। স্নান করতে করতেই শঙ্খধ্বনির আওয়াজ ভেসে এল। রোজ সন্ধ্যা দেবার সময় নয়নতারা ধূপের সঙ্গে একটু ধুনোও দেন, ধূপ-ধুনোর গন্ধে একটা পবিত্র আবহ রচনা হয়। নয়নতারা বেশ ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁরে, অল্প ধুনো দিলে কি তোর অসুবিধা হবে? মানে দেওয়ালের রঙ নষ্ট হবে কি?’
মাকে জড়িয়ে ধরেছিল কঙ্কা বলে, ‘উফ্ মা, আমি তো বেশিটা সময় অফিসে থাকি। অফিসের কাজে প্রায় বাইরেও যাব। তুমি নিজের মতো করে থাকবে। এত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে? এ ঘর যতটা আমার ততটাই তোমার। নয়নতারার মুখে চাঁদের আলো যেন আলপনা এঁকে দিয়েছিল।’
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েই কঙ্কা শুনতে পাচ্ছিল পেয়ালা আর চামচের সুরেলা রিনিঠিনি। সে বেরিয়ে এসে দেখে মা কফি আর কেক সাজিয়ে ব্যালকনিতে বসে আছেন। কঙ্কা একটা চেয়ার টেনে বসে যায় মায়ের পাশে। নিচে জোনাকির মতো আলোগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা নামছে।
কফির পেয়ালা এগিয়ে দিতে দিতে নয়নতারা বলেন, ‘মাথায় জল ঢাললি এখন? ইস চুল বেয়ে যে জল ঝরছে রে! কফিটা খেয়ে নে, তারপর মাথাটা মুছিয়ে দেব।’
‘তোমার আর টব লাগবে? অনলাইনে অর্ডার করে দেব তাহলে।’ কঙ্কা জানে, মা নতুন পরিবেশে মন বসাবার চেষ্টা করছেন একটু একটু করে। কয়েকটা গাছ লাগিয়েছেন। সবুজ পাতাগুলো পারলে মা নিজের হাতে মোছেন। জবা গাছ দুটোয় কুঁড়িও এসেছে। সেইসব গল্প শোনাতে শোনাতে নয়নতারা একটা নতুন কথা জানান, একটা খালি টবে ক’দিন ধরেই এক ঘুঘু-দম্পতি নজর দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই এসে বসে থাকছে। মনে হচ্ছে ডিম পাড়বে।
কঙ্কা হেসে ফেলে, ‘তুমি বুঝি দুপুরে বিশ্রাম না নিয়ে এসব দেখ? তা তুমি এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে ওদের দাম্পত্যের যে ব্যাঘাত ঘটবে মা।’ মা আর মেয়ে দুজনেই হাসতে থাকে। কখনও কখনও কারণ ছাড়াই তারা হাসে। আসলে এতকাল তো হাসিকান্না সবই তাদের মেপে করতে হত। এখন আর আড়াল লাগে না প্রাণ খুলে দুজনে হেসে ওঠার জন্য।
কঙ্কার গনগনে মুখটার দিকে তাকিয়ে নয়নতারা বলেন, ‘চায়ের সঙ্গে নারকেল কোরা দিয়ে একটু মুড়ি মেখে দেব?’ কঙ্কা হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। ব্যালকনিতে এসে বসে। এখানে বসলেই মন ভাল হয়ে যায়। মায়ের যত্নে গাছগুলো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠেছে। বেশ কয়েক প্রজাতির ইনডোর প্ল্যান্ট তাদের লাল, গোলাপি পাতার মাধুর্যে ব্যালকনিটা রঙিন করে তুলেছে। ঘুঘুদেবী দুটি ডিম পেড়েছে। দেবা-দেবী পালা করে তা দিচ্ছে ডিমে। মা নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারে কে বাবা পাখি আর কে মা। কঙ্কা রোজ অফিস থেকে ফিরে ওদের গল্প শোনে। আজও ওদের গল্প শুনতে শুনতে বলে ফেলে, ‘মামার বাড়িতে তোমার অংশের তালাটা খুলে দিয়ে আসতে পারো তো! ওরা গাদাগাদি করে থাকে, তোমার অংশটা পেলে ওদের সুবিধা হবে।’
মেয়ের মুখভারের কারণ আন্দাজ হয় এবার। নিশ্চয় মেজবউ ফোন করে ওকে কিছু বলেছে। নয়নতারা জেদি ঘোড়ার মতো মাথা টানটান করে রাখেন। উনি কি ঐ অংশটাতে থাকতে যাচ্ছেন? তালা খুলে দিয়ে আসবেন নিজেই ভাবছিলেন। কিন্তু মেয়েটাকে এ-সবের মধ্যে ফেলছে কেন? জেদ বেড়ে যায় নয়নতারার। কঙ্কার চা বিস্বাদ লাগে। আজ আর মা-মেয়ের আড্ডা এগোয় না।
নয়নতারা কখন যেন মরশুমি ফুলের চারা বুনেছিলেন। লাল, নীল, গোলাপি, বেগুনি ফুলে ব্যালকনিটা ভরে গেছে। কঙ্কা দেখে কোণের দিকে টবটা ফাঁকা। মা, মা করে ডাকে সে। আজ রবিবার, নয়নতারা এই একটা দিনই মেয়ের জন্য জম্পেশ করে রান্না করেন। কাল নিজে ইলিশ কিনে এনেছেন। ইলিশের একটা পদ রান্না করে, ভাপাটা বসাবেন-বসাবেন করছিলেন। মেয়ের ডাক শুনে আঁচলে হলুদ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। ‘মা, নতুন একজোড়া ঘুঘু এসেছিল, ডিম পেড়েছিল ক’দিন আগেই দেখলাম। টব তো ফাঁকা।’
নয়নতারা ইশারায় সাদা পায়রাটাকে দেখান। ঘুঘু নেই তো কী হয়েছে? ওদের ডিম দুটো ভেঙে গিয়েছিল বলে চলে গেছে। পায়রাটা মনে হয় টবের দখল নেবে। ওরাও জেনে গেছে এই নিরাপদ মেটারনিটি হোমের কথা। ঘুঘুর বাসা হয়ে আর কাজ নেই। পায়রা বরং লক্ষ্মীমন্ত। ওরা বাসা বাঁধুক।
কঙ্কা বুঝে উঠতে পারে না দুটো ডিমই ভেঙে গেল কীভাবে? গতবার তো কী সুন্দর একজোড়া বাচ্চা বেরোল ডিম ফুটে। কঙ্কার থেকে নয়নতারার উৎসাহ ছিল দেখার মতো। ঘুঘু-দম্পতির রোজনামচা তিনি মুখস্থ করে ফেলেছিলেন প্রায়।
মেজমামি ফোন করে, ‘যাই বলিস, তোর মা কিন্তু বাপের বাড়ি আর মুকুন্দ লেনের ঐ শ্যাওলা ধরা বাড়িটাকেই নিজের মনে করে। এত করে বললি, তবু তো তালাটা খুলে দিয়ে গেল না। ঘর দুটো পেলে বাবুল বউ-ছেলে নিয়ে উঠে যেত ঐ অংশটাতে। তোর বাবার সঙ্গে কতদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তবু তোর বাবাই তার মন জুড়ে রয়ে গেছে। তুই মাকে হাতের চেটোয় আগলে রাখিস, তবু তোর কথা ভাবে না। সেদিন আদিখ্যেতা করে ঘুঘুর বাসা দেখাতে নিয়ে গেল ব্যালকনিতে। দেখেই আমি আঁতকে উঠে বলেছিলাম, ভাই নয়ন, ঘরে ঘুঘুর বাসা ভাল না গো। গৃহকর্তার অমঙ্গল হয়। তা গৃহকর্তা মানে তো হেড অফ দ্য ফ্যামিলি। সেটা তোকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিলাম, তুই রোজগেরে মেয়ে— দায়দায়িত্ব সব সামলাচ্ছিস। ওমা, তোর মা অস্ফুটে বলে ওঠে, তাই আমাদের কঙ্কার বাবা এত ভুগছে। যমে মানুষে টানাটানি হল।
কঙ্কার মাথায় আগুন জ্বলে। মা অধিকার ছাড়ে না বাপের বাড়ির, কারণ ওটাই নিজের বাড়ি মনে করে। তার এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা মায়ের কাছে কিছুই না? যে-স্বামী এক কাপড়ে বার করে দিয়েছিল একটা ছোট্ট মেয়ের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে তাকে মা সংসারের হেড অফ দ্য ফ্যামিলি ভাবেন? শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে কঙ্কা। ফুটপাথ ধরে এলোমেলো হাঁটতে থাকে। একটা খাঁচায় বিক্রির জন্য রাখা রঙবেরঙের পাখি। পাখি বিক্রি তো বেআইনি, তাহলে? বিক্রেতা চোখ মটকে বলে, এই শহরে সব চলে মেমসাহেব। এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে পার্স থেকে টাকা বার করে কঙ্কা। পাখিগুলো দেখলে মা খুশিই হবেন। ছোট ছোট মুনিয়া পাখি।
অসময়ে দরজা খুলে কঙ্কাকে দেখে অবাক হন নয়নতারা। মেয়ের হাতে খাঁচাটা দেখে আরও অবাক। খোঁপা করতে করতে হাই তোলেন, ‘তাড়াতাড়ি এসে ভাল করেছিস। আজ একবার ও-বাড়ি যাব, ঘরটা খুলে দিয়ে আসব। ও-বাড়ি আর আমাদের দরকার নেই। কী বলিস?’
কঙ্কা টের পায় তার বুকের মধ্যে তৈরি হওয়া ঘুঘুর বাসাটা ভেঙে যাচ্ছে ঝুরঝুর করে। ওদিকে নয়নতারা খাঁচাটা নিয়ে ব্যালকনিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। একসময় খাঁচার দরজাটা খুলে দিলেন। ছোট্ট পাখিগুলো হঠাৎ মুক্তির স্বাদ পেয়ে দিশাহারা হয়ে গেছে। তারপর রঙিন ডানা ঝাপটে রেলিংয়ের ফাঁক গলে উড়ান দিচ্ছে। যেন ফাগ উড়ছে, রঙিন হয়ে উঠছে মা ও মেয়ের দৃষ্টিপথ। কঙ্কা মাকে জড়িয়ে ধরেছে। এই তো মা দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে নতুন জীবনে। ঘুঘুর বাসাটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে অনেক কিছু যেন ফিরিয়ে দিয়ে গেল তাদের জীবনে। নয়নতারার দুচোখ বেয়ে দু ফোঁটা আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ল।
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article