দাও ভালবাসা সম্প্রীতি, সূর্যমুখী ফুলের ধীর, বর্ণভেদ ভুলে মানুষ ভজো, জড়াজড়ি হও বীর

সম্প্রীতিই ধর্মের সৌন্দর্য। সেটাই জেনেছে, বুঝেছে, বুঝিয়েছে বাংলা। ইদ আর দুর্গাপুজো এখানে অভিন্ন অনুভবে পালিত হয়। সেই কথাটাই বাসন্তী পুজোর আবহে পালিত ইদের আনন্দ-উৎসব মনে করিয়ে দিল। এই সংবেদনের ছবি লিখলেন পার্থসারথি গুহ

Must read

দুর্গাপুজোর মতোই শস্য-শ্যামলা বাংলা এখন ইদের আভায় প্রজ্জ্বলিত। খুশির ছটায় উদ্ভাসিত সমগ্র বাংলা তথা কলকাতা। হাটে-বাজারে চলছে স্লগ ওভারের দেদার কেনাকাটা। ধনী-দরিদ্রর বিভেদ ঘুচিয়ে ইদের খুশি যে সবার। বাঙালিকে ননস্টপ আনন্দ দিতে পবিত্র ইদের পরে পরেই বাংলা নববর্ষের আগমন। বাংলার মাটিতে বাঙালি একান্তই নিজের আনন্দে বাঁচে। উৎসব হল তার অক্সিজেন। আর সেই খুশির বাতাবরণে যাতে ছিঁটেফোঁটা অশান্তির আঁচ না লাগে সেজন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সদাসজাগ প্রশাসন।
রমজান মাসব্যাপী কঠোর নিয়মের বেড়াজাল শেষে পালা এবার খুশির ইদ-উল-ফিতরে মেতে ওঠার। ইদের পবিত্র নমাজ পাঠের পর ভক্ত, উপবাসী মানুষগুলোর শুকনো মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠার মরসুম।
এ যেন শীতের রুক্ষ-শুষ্কতা কাটিয়ে ঝরে যাওয়া পাতার নব পল্লবিত হওয়া। ঋতুরাজ বসন্তের মতো কোকিলের অমৃতকণ্ঠে বুঁদ হয়ে যাওয়ার সন্ধিক্ষণ। যাবতীয় অশুভ অমাবস্যার করাল রাত কেটে ইদের চাঁদের জ্যোৎস্নায় মাতোয়ারা হওয়া। নতুন জামা-কাপড়, সিমাইয়ের পায়েস আর কত্ত কী খানাপিনা! এলাহি আয়োজন। কোলাকুলিতে যেন বিজয়া দশমীর ছোঁয়া। এ-জন্যই তো ঠাকুর সেই কবে বলে গিয়েছেন, ‘যত মত তত পথ’। যে পথেই এগোও না কেন, অভিষ্ট ইষ্ট ধরা দেবে সে-পথেই। ইদের চাঁদ যেন এভাবেই নেমে আসে ভক্তের নাগালে।
চাঁদ দেখা গিয়েছে যে। যে সে চাঁদ নয়। এ হল ইদ কা চাঁদ। যার জন্য কতগুলো দিনরাত এক করে ব্রতী হয়েছেন ধর্মপ্রাণ মানুষগুলি। আজ ওঁদের ঝুলি পূর্ণ করে দেওয়ার পালা পরমেশ্বরের। বড়দিনের সান্টাক্লজের মতো তিনিই তো আবালবৃদ্ধবনিতার ত্রাতা।
বাংলায় দুর্গাপুজো আর ইদ বরাবর পিঠোপিঠি সহোদর। বাংলা যে আমাদের গর্বের মিনি ভারতবর্ষ। রবিঠাকুরের ভাষায়, ‘নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান। বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’ আজও লালন ফকিরের উদাত্ত কণ্ঠ শোনা যায় বাংলার অলিগলিতে।

আরও পড়ুন-পথশ্রী প্রকল্পে চা-বাগান এলাকা পেল নতুন রাস্তা

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এভাবেই মাথা তুলে বাঁচে বাঙালি। চিরকাল এমনই চলে এসেছে।
রেড রোডে ইদের নমাজ থেকে দুর্গাপুজো উদ্বোধন, নিজের বাড়ির কালীপুজোয় ভোগ রাঁধা, বড়দিনের মধ্যরাতে চার্চে প্রার্থনা থেকে ছটপুজোয় অংশগ্রহণ সবেতেই স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি বাংলার সবার প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
এমত বিবিধের মিলনস্থল বাংলার আকাশে হঠাৎ করেই কিছু মানুষরূপী চিল-শকুনের উদ্ভব হয়েছে। যাদের এক এবং অভিন্ন কর্মসূচি শান্ত পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত করে তোলা। গোধরা কিংবা গোবলয়ের জাতপাতভিত্তিক, ধর্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা এদের মডেল। অনেকটা শোলে ছবির গব্বর সিং মার্কা শোষণের মুখ। এই একাধিপত্য আটকাতেই একদা লালকৃষ্ণ আদবানির সাম্প্রদায়িক রথ থামানো লালুপ্রসাদ যাদব বলেছিলেন, ভুরাবাল (ভূমিহার, রাজপুত, ব্রাহ্মণ, লালা) সাফ করতে। লালুজি কার্যত জাতপাতের বৈষম্য দূর করার বার্তা দিয়েছিলেন। গোবলয়ের গোয়েবলসরা নয়া হিন্দুত্বের মোড়কে যে হিঁদু দেশের স্বপ্ন বেচছে তাও কিন্তু ওই জাতপাতদীর্ণ রাষ্ট্রের দুঃস্বপ্ন। যেখানে অন্য ধর্মের মানুষের জায়গায়
খুল্লেআম জাতপাত ভিত্তিক মৌরসিপাট্টা চালু হবে। উচ্চবর্ণের হাতে দলিতদের দলাইমালাই করাই এদের হিন্দুত্ব। মান্ধাতার মনুবাদের প্রত্যাবর্তন। শুধু ধর্মের নামে মেকি হিন্দুত্ব চাপিয়ে দেওয়া নয়, হিন্দির আগ্রাসনে দেশের বর্ণময় নানা ভাষাকে দাবিয়ে দেওয়া হয়ে উঠবে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
হীনমন্যতায় ভোগা তথাকথিত গুটিয়ে কিছু বাঙালি মেকি হিন্দুত্বের গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যে গপ্পো দিচ্ছে তা পুরোপুরি বাংলা সংস্কৃতির পরিপন্থী। শ্রীচৈতন্যদেব যে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন,সামাজিক সাম্যের বিপ্লব গড়ে তুলেছিলেন,স্বামী বিবেকানন্দ মুচি-মেথরকে অবহেলার প্রতিবাদ করে যে ঐক্যের বার্তা দিয়েছিলেন, নেতাজি সুভাষ সর্বদা যেভাবে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে মুখর ছিলেন সেটাই বাঙালির হিন্দুত্ব। গোবলয়ের মেকি হিন্দুত্বের সপাট জবাব।
যে পথে স্বাধীনতা লাভের অসম লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়েছেন একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমনপীড়ন নীতির বিরুদ্ধে খিলাফত আন্দোলন ও গান্ধিজির নেতৃত্বাধীন অসহযোগ আন্দোলন কার্যত মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার পরতে পরতে তাই গান্ধিজি, নেতাজি, প্যাটেল, পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে একছত্রে উচ্চারিত হয় মওলানা আবুল কালাম আজাদ, সীমান্ত গান্ধি খান আব্দুল গফফার খান, মহম্মদ আলি জিন্নাদের নাম।
বাঙালির দুর্গাপুজো নামে পাঁচদিনের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে শারদ উৎসবকে নব আঙ্গিকে চিনেছে তামাম বাংলা। মহালয়া থেকেই এখন প্রতিমা দর্শনের ঢল পড়ে যায়। আর পুজোর ভিড়ে মিস করলেও চিন্তা নেই। কার্নিভাল হ্যায় না। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবেই সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্যেও বাঙালির মধ্যে উৎসবের অনাবিল আনন্দ জাগিয়ে তুলেছেন।
দুর্গাপুজোর মতো ইদেও কম আনন্দিত-আহ্লাদিত হয় না বাঙালি। ইদের আনন্দও কিন্তু মোটেই একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একমাস ধরে কঠোর রমজান যাপন চলে। ঘড়ি ধরে সূর্য ঢলে পড়ার সঙ্গে শুরু হয় সেদিনকার মতো ইফতার পর্ব। সারাদিনের উপোসী শরীর জুড়নো কিছু ফলমূল, ছোলা আর ভাজাভুজিতে। সঙ্গে জগদ্বিখ্যাত হালিম। ইফতার পালনে বাঙালি জাতিধর্ম নির্বিশেষে যেভাবে এগিয়ে আসে তা সারা দেশের কাছে রোল মডেল হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন-গরুমারায় ফের নৌকা বিহার, খুশি পর্যটকেরা

উপোস তো হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মালম্বীরাও করে থাকেন। এই যেমন বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন উপলক্ষে কতোই না উপোস চলে। চিকিৎসকেরা পর্যন্ত এই উপবাসে সায় দিয়েছেন। শরীরের বিষবৎ টক্সিন নির্গত হয় এমনতর উপবাসের মধ্যে দিয়ে। তবে উচ্চ ডায়াবেটিস, হৃৎরোগী এবং অন্যান্য গুরুতর শারীরিক সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন তাঁদের জন্য অবশ্যই শিথিলতা রয়েছে। এ তো হল বৈজ্ঞানিক দিক। ধর্মীয় দিক থেকে রমজান মাসের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হল ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং সংযমী জীবনযাপনের নিয়মানুবর্তিতায় বেঁধে ফেলা।
মোদিজির আমলে ইতিহাস বিকৃত করে যে সংকীর্ণতামনস্ক রাজনীতির আমদানি হয়েছে তার চেয়ে পুরো উলটো পথে হাঁটছে মমতাময়ী বাংলা।
সংকীর্ণতাকে ছাপিয়ে পতপত করে উড়ছে সম্প্রীতির ধ্বজা।

Latest article