জানুয়ারি হল আন্তর্জাতিক গ্লুকোমা-সচেতনতা মাস। চোখের এই রোগের কোনও প্রতিকার নেই তাই জরুরি সচেতনতা এবং সতর্কতা কারণ দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে তবেই দৃষ্টিশক্তি হ্রাস রোধ করা সম্ভব। আর রোগ ধরা পড়ার পথ হল ঠিকঠাক চোখের পরীক্ষা।
বিশ্বে প্রায় ৮০ মিলিয়ন মানুষ গ্লুকোমায় আক্রান্ত, যা অন্ধত্বের দ্বিতীয় প্রধান কারণ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১১০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হতে হতে একটা সময় সম্পূর্ণ চলে যেতে দেখা যায় বহু মানুষকেই। একেই বলে গ্লুকোমা। ভারতবর্ষেও গ্লুকোমার পরিসংখ্যান ভয়াবহ। আমাদের দেশে এই রোগাক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ১২ লক্ষেরও বেশি। তার মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগীর অনেক দেরিতে গ্লুকোমা রোগ ধরা পড়ে। এর ফল খারাপ হয়।
গ্লুকোমা একটি চোখের রোগ। যা হলে চোখের অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চোখের ভেতরে ক্রমাগত জলীয় তরল তৈরি হয় এবং নিষ্কাশিত হয়। এই তরলের নাম অ্যাকুয়াস হিউমার। এই তরল পদার্থটি আমাদের চোখের কর্নিয়া ও লেন্সকে পুষ্টি সরবরাহ করে। যদি কোনও কারণে এই অ্যাকুয়াস হিউমারের নিষ্কাশন পথ বন্ধ হয়ে যায় বা ঠিকমতো কাজ না করে, তখন সেই ফ্লুইড বা তরল চোখে জমে যায় এবং চোখের পিছনের পর্দা অপটিক নার্ভে চাপ বেড়ে যায়। একে ‘ইন্ট্রা-অকুলার প্রেশার’ বলা হয়। যা অপটিক স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে এবং যত চাপ বাড়ে তত চোখের দৃষ্টি কমতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সেই মানুষটির জীবনে অন্ধত্ব নেমে আসে। গ্লুকোমায় আক্রান্ত হলে একেবারে শুরুর দিকে রোগীর ‘সাইড ভিশন’ অর্থাৎ পাশের জিনিস দেখার ক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে। যদি কোনও পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি বলেন পাশের দিকে দেখতে পারছেন না তাহলে সাবধান হতে হবে অর্থাৎ কারও যদি ‘সাইড ভিশন’ ঝাপসা হতে শুরু করে একমুহূর্ত দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, দেরি হলে জটিলতা বাড়তে পারে। তবে যেহেতু কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াও গ্লুকোমা হতে পারে সেটাই মূলত ভয়ের তার কারণ প্রায় ৯০% গ্লুকোমা রোগী অজ্ঞ বা তাঁদের রোগ নির্ণয় সঠিক সময় হয় না, আর প্রাথমিক পর্যায়ে এই চোখের রোগের কোনও লক্ষণই থাকে না এবং সেই সঙ্গে সচেতনতার অভাব তো রয়েছেই। গবেষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে এশিয়াতে গ্লুকোমায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরও প্রায় ২৭.৮ মিলিয়ন বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যার একটি বড় অংশ ভারত ও চিনের জনসংখ্যায় দেখা যাবে।
আরও পড়ুন-আখলাক হত্যা মামলা: আদালতে জোর ধাক্কা খেল যোগী সরকার
গ্লুকোমার কিছু লক্ষণ
চোখে খুব ব্যথা বা চাপ।
মাথার খুব যন্ত্রণা।
লাল বা চোখে রক্তজমাট বেঁধে যাওয়া।
দু-রকমের ভিশন বা দৃষ্টি।
ব্লারি ভিশন বা ঝাপসা দৃষ্টি।
টানেল ভিশন অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা যেখানে আপনি আপনার চারপাশের সবকিছু দেখতে না পেয়ে শুধুমাত্র সরাসরি সামনের দিকে একটি সংকীর্ণ বৃত্তাকার অংশ দেখতে পান, ঠিক যেন একটি টানেলের মধ্যে দিয়ে দেখছেন! অনেক সময় পেরিফেরাল ভিশন লস বা পার্শ্ববর্তী দৃষ্টিশক্তি হারানোর ফলে হয়।
কিছুক্ষেত্রে গ্লুকোমার গুরুতর লক্ষণ দেখা দিতে পারে যা বিপজ্জনক। যেমন—
চোখের পাতা অসম্ভব ফুলে ওঠে।
চোখের আইরিস বা সাদা অংশে রক্ত জমাট বাঁধা । কোনও কারণে চোখে চাপ বাড়লে এমনটা হয় যা হালকা হতে পারে কিন্তু আবার গুরুতর হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
বমি-বমি-ভাব বা চোখের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি-ভাব।
চোখের আলোর চারপাশে রঙিন রামধনুর মতো বলয়।
মায়োডেসপসিয়া বা আই ফ্লোটার বা চোখে ভাসমান বিন্দু বা ভাসমান কিছুর উপস্থিতি।
হঠাৎ দৃষ্টিতে ঝলমলে আলো দেখা বা ফটোপসিয়া।
ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা হল গ্লুকোমার সবচেয়ে সাধারণ ধরন। গ্লুকোমা জন্মগত হয় এছাড়া গ্লুকোমার আরও দুটো ধরন হয় ক্লোজার গ্লুকোমা ও সেকেন্ডারি গ্লুকোমা। সাধারণত ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে গ্লুকোমা হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। উচ্চরক্তচাপ এবং উচ্চমাত্রায় ডায়াবেটিস থাকলে গ্লুকোমার সম্ভাবনা থাকে। যাঁদের অতিরিক্ত মাইনাস পাওয়ার থাকে তাঁদেরও গ্লুকোমা থাকে। তবে অল্পবয়সিদের মধ্যেও এই রোগের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোনও সময়ে চোখে গুরুতর চোট বা আঘাত লেগে থাকলে পরবর্তীতে সেই ক্ষতস্থান থেকেও গ্লুকোমা হতে পারে। যাঁরা নিয়মিত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ বা ইনহেলার নেন তাঁদেরও গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
আরও পড়ুন-পাঁচবার বৈঠকের পরও অনুমোদন দিল না কেন্দ্র, মনীষী ও বিপ্লবীদের শ্রদ্ধায় সাজানো বাংলার ট্যাবলো
গ্লুকোমা নির্ণয়ে
গ্লুকোমা নির্ণয়ে জরুরি পরীক্ষাগুলো হল চোখের চাপ মাপা (টোনোমেট্রি), অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি পরীক্ষা (ডাইলেটেড টেস্ট), পেরিফেরাল দৃষ্টি পরীক্ষা (ভিজ্যুয়াল ফিল্ড টেস্ট), চোখের ড্রেনেজ কোণ দেখা (গনিওস্কোপি) এবং কর্নিয়ার পুরুত্ব মাপা (প্যাকিমেট্রি) ইত্যাদি। এই পরীক্ষাগুলো চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ, অপটিক স্নায়ুর অবস্থা এবং দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এর থেকে অনেকটাই ধরা পড়ে।
চিকিৎসা
বিভিন্ন ধরনের আই ড্রপ, ওরাল মেডিকেশন ও লেজার ট্রিটমেন্ট গ্লুকোমার ক্ষেত্রে মূল চিকিৎসা কিন্তু এতে কাজ না হলে সার্জারির প্রয়োজন হয় তখন সার্জারির মাধ্যমে চোখে স্টেন্ট বসানো হয়। এ-ছাড়া রয়েছে গ্লুকোমা ড্রেনজ ইমপ্লান্ট অর্থাৎ চোখের ভিতর ছোট টিউব বসানো হয় এই চিকিৎসায়।

