সমাজে ভাল ও খারাপ দু-ধরনের মানুষ থাকে। কিন্তু সন্দেহ নেই ভাল মানুষের তুলনায় খারাপের সংখ্যা নগণ্য, তাই পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর। মানুষের পেশা, ধর্ম, কর্ম অনুযায়ী সমস্ত কমিউনিটিতেই এই ভাল ও খারাপ যে সহাবস্থান করে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। লোভ, হিংসা, ঈর্ষার মতো রিপুগুলি আদি অনন্ত কাল থেকে মানুষের মধ্যে নিহিত আছে। কিন্তু যেদিন থেকে আমরা সমাজবদ্ধ হয়েছি সেদিন থেকে আমরা সমষ্টিগত মানুষ হিসেবে মানুষের ভাল থাকার উপায় বের করার চেষ্টা করেছি। কোনটা ঠিক কোনটা করা উচিত, কোনটা ভুল কোনটা করা উচিত নয় আমরাই ঠিক করে আমারই আমাদের ওপর অর্পণ করেছি। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাষ্ট্র সেই সকল দেশের মানুষজনের আচরণবিধি নির্ধারণ করেছে তাদের মতো করে। সেগুলির মান নিয়ে তুল্যমূল্য বিচার হতেই পারে, কিন্তু সামাজিক মানুষ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই সর্ব দেশে সর্ব স্তরেই একটা জীবন যাপনের নির্দেশিকা তৈরি করে নিয়েছে। যদিও জাতি নির্বিশেষে আচার আচরণের পার্থক্য থাকলেও এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যেদিন থেকে আমরা সমাজবদ্ধ হলাম সেদিন থেকেই আমাদের ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমার স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হল। কারণ আমি সমাজবদ্ধ, আমাকে কিছু সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। আমি মুক্ত স্বাধীন নই। কারণ আমি জঙ্গলের জীবন ছেড়ে এই সভ্যসমাজ গড়ে তুলেছি। ফলে আমার ব্যক্তি-ইচ্ছা সরিয়ে রেখে আমাকে সাধারণের ইচ্ছাকেই গ্রহণ করতে হয়েছে। ব্যক্তি মানুষকে এখানে কিছুটা কম্প্রোমাইস করতেই হয়েছে এ-কথা সত্য। কারণ একা বেঁচে থাকা যায় না।
আরও পড়ুন-নারীশক্তির জাগরণী নবরাত্রি
আমাদের দেশের একটা সংবিধান আছে। সেই সংবিধানের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে যেমন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক্ স্বাধীনতা আছে পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আছে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের পছন্দমতো দলের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তুলে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সে সরকারে থাকুক কিংবা বিরোধী দলে থাকুক, তাঁকে শপথ নিতে হয় যে, দেশের সংবিধানকে সে মান্যতা দিয়ে চলবে। এই পর্যন্ত কোনও জটিলতা আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু আমরা যারা রাজনীতি করি সে দলেরই হই না কেন, মনে রাখা উচিত আমাদের রাজনৈতিক লড়াই অন্যায়ের বিরুদ্ধে হতে পারে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে হতে পারে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে হতে পারে কিন্তু তার পাশাপাশি খেয়াল রাখা উচিত আমাদের ভাষ্য, আমাদের আন্দোলন যেন সামাজিক স্থিতি নষ্ট না করে। কোনও কমিউনিটি, কোনও জাতিকে আঘাত না করে।
ভাল মানুষ খারাপ মানুষ সব কমিউনিটির মধ্যেই আছে কিন্তু একজনের বা কয়েক জনের অপরাধের জন্য সমগ্র কমিউনিটিকেই দোষারোপের মধ্যে ফেলা অনুচিত শুধু নয় সামাজিক স্থিতি নষ্ট করার চেষ্টা বলে গণ্য হতেই পারে।
আরও পড়ুন-যৎকিঞ্চিৎ
পুলিশ মানেই ঘুষখোর, শিক্ষকরা স্কুলে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত, ডাক্তার সে তো প্যাথলজি সেন্টার ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর স্বার্থে প্রেসক্রিপশন লেখে, সরকারি কর্মচারী মানেই ফাঁকিবাজ— এমন একটা ধারণা সাধারণের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে ধীরে ধীরে। কিন্তু আমরা কখনোও ভবি না এই ধারণাগুলির একটি উল্টো দিকও আছে এবং সেটাই সত্য সেটাই সার্বিক। আমরা কতটুকু ভেবে দেখি যে, আজও শিক্ষকরাই আমাদের সন্তানদের জ্ঞানের আলো দেখানোর প্রবহমানতা বজায় রেখেছেন। না হলে আজকের প্রজন্মের কোয়ালিটি অফ এডুকেশন বৃদ্ধি পায় কেমন করে!
বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সুকৌশলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে চলেছে, যা সামাজিক স্থিতিকে নড়িয়ে দিতে পারে। পুলিশ মানেই সব খারাপ। পুলিশের দিকে ইট মারো। তার চোখ যাক, মাথা ফাটুক, সম্মান হানি করো— তা হলেই কেল্লা ফতে। সামাজিকভাবে ঘৃণ্য করে তুলতে হবে তাঁকে, তাহলেই রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে আর সাধারণ মানুষ সরকার-বিরোধী হতে থাকবে।
আরও পড়ুন-মাত্র দুটি সংসদীয় কমিটির শীর্ষে মহিলা কেন? প্রশ্ন ডেরেকের
যে পুলিশ উৎসবের দিনে তাঁর পরিবারকে বাদ দিয়ে দিবারাত্রি আমাদের উৎসব আনন্দের নিরাপত্তা দেয়। যে পুলিশ জীবনের ঝুঁকি অস্বীকার করে লাগাতার সমাজবিরোধীদের কোণঠাসা রাখে আমাদের রাতদিন নিরাপত্তার জন্য, মহিলাদের নিরাপদ শহর হিসেবে এই মহানগর কলকাতাকে দেশের মধ্যে সেরা শহরের স্বীকৃতি এনে দেয়, সেই পুলিশকেই আসামির কাঠগড়ায় তুলতে হবে একটি দুর্ঘটনাকে সামনে রেখে! এটা কোনও সুস্থ রাজনীতির অঙ্গ হতে পারে না।
অপরাধ যে করে তার একমাত্র পরিচয় সে অপরাধী। দেশের আইনকানুনের মধ্যে তার শাস্তির বিধান লিখিত আছে। অপরাধীর বিচার হয় তার অপরাধের প্রকৃতির ওপর। কী ধরনের অপরাধ সে করেছে তার ওপর তার শাস্তির পরিমাণ নির্ভর করে। একজন অপরাধী তার অপরাধের শাস্তি অন্য কাউকে হস্তান্তর করতে পারে না। কোনও নিরাপরাধ ব্যক্তি কোনও অপরাধীর শাস্তির ভার বা তার অংশ বিশেষ বহন করতে পারে না। তাই কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অপরাধের জন্য তার সমগ্র শ্রেণিকে বা জাতিকে কিংবা কমিউনিটিকে দোষী বলে দাগিয়ে দেওয়ার রাজনৈতিক কৌশল আসলে সমাজবিরোধিতার নামান্তর।