একটা সময় পরিবেশ ছিল অশান্ত। বাতাসে ভেসে বেড়াত বারুদের গন্ধ। মাঝেমধ্যেই রক্তাক্ত হয়ে উঠত এলাকা। স্থানীয়দের চোখেমুখে লেগে থাকত আতঙ্ক। বেশিরভাগ মানুষই হতদরিদ্র। আদিবাসী। অনেকেই দিন কাটাতেন অভুক্ত অবস্থায়। সবুজ অরণ্যে ঘেরা এলাকা। বনানীর শোভা উপভোগ করার ইচ্ছা থাকলেও, পা রাখার সাহস পেতেন না দূরের মানুষজন। পরিস্থিতি ছিল এতটাই ভয়াবহ।
২০১১-র পর বদলেছে সময়। বদলেছে পরিস্থিতি। বর্তমানে এলাকা পুরোপুরি শান্ত। উধাও বারুদের গন্ধ। আতঙ্কের বদলে এখন স্থানীয়দের চোখেমুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝিলিক। পুরুষরা কাজে যান। কেউ কেউ রুক্ষ মাটির বুকে ফসল ফলান। মহিলারা সামলান ঘর। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা দলবেঁধে সাইকেলে হাসিমুখে স্কুলে যায়। এখন আর অভুক্ত থাকতে হয় না কাউকেই। জল, আলো ঘরে ঘরে। লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। এই ছবি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনির।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর কড়া পদক্ষেপ প্রশাসনের বিদ্যুৎ অপচয় : ১৬ দফা নির্দেশিকা
এলাকাটি শালগাছের বনে ঘেরা। তাই শালবনি। পাশাপাশি আছে সেগুন, মহুয়া, পলাশ-সহ অন্যান্য গাছও। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দু-পাশে সবুজ অরণ্য। বুকচিরে ছুটে গেছে রাস্তা। কোথাও পিচঢালা, কোথাও মোরাম-বিছানো। ঘন সবুজ বনাঞ্চলই শালবনির প্রধান আকর্ষণ। গত এক যুগে এই মালভূমি অঞ্চলে বেড়েছে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষজনের আনাগোনা। বহু পর্যটক গাড়ি ছুটিয়ে আসেন। সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। স্থানীয় হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেন। বিকেলের দিকে ফিরে যান। গাড়িতে বসে গভীর অরণ্যের শোভা উপভোগ করাই ভাল। গাড়ি থেকে নামলে ঘটে যেতে পারে বিপদ। মাঝেমধ্যেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে বন্যপ্রাণী। আছে হাতির উপদ্রব। তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই মঙ্গল। ডালে ডালে উড়ে বেড়ায় নানারকমের পাখি। সারাদিন চলে কিচিরমিচির। পাখিদের কনসার্ট বাদ দিলে এই শ্যামলসুন্দরের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে নীরবতা। যাঁরা নির্জনতা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা।
শালবনি একটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক। দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত। সেগুলো হল বাঁকিবাঁধ, দেবগ্রাম, কাশিজোড়া, সাতপাটি, ভিমপুর, গড়মাল, লালগেড়িয়া, বিষ্ণুপুর, কর্ণগড় এবং শালবনি। প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই রয়েছে গভীর জঙ্গল। এর উত্তর দিকে চন্দ্রকোণা রোড, দক্ষিণে মেদিনীপুর, পূর্বে কেশপুর, পশ্চিমে ঝাড়গ্রাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শালবনিতে ছিল রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিমান ঘাঁটি। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে নোট মুদ্রণ উপনগরী। বর্তমানে সেটা ভারতীয় নোট উৎপাদনের একটি মুখ্য ছাপাখানা। এ ছাড়াও শালবনিতে রয়েছে রেল স্টেশন, বিডিও অফিস, থানা, স্কুল, হসপিটাল, বাজার, দুর্গাবাড়ি, খেলার মাঠ, পার্ক, কলকারখানা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-ভারতের জন্য এখনও ঝাঁপাতে চান সুনীল
আশেপাশে আছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান। শালবনির কর্ণগড়ে রয়েছে রাজা মহাবীর সিংহ নির্মিত প্রাচীন এক গড়ের ধ্বংসাবশেষ। ঘুরে আসা যায়। একসময় এই গড়ে চুয়াড় বিদ্রোহের নেত্রী রানি শিরোমণির রাজত্ব ছিল। গড়ের এক অংশে অবস্থিত মহামায়া মন্দির। ভাদুতলা থেকে কিছুটা দূরে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে। মন্দিরটি ওড়িশার স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। মন্দিরপ্রাঙ্গণে যাওয়ার রাস্তায় এক সুদৃশ্য প্রবেশতোরণ দেখা যায়। সেখান থেকে বেশ কিছুটা গেলেই মূল মন্দিরপ্রাঙ্গণের প্রবেশদ্বার। প্রায় আট ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দিরপ্রাঙ্গণের মূল প্রবেশদ্বারটি প্রায় ৭৫ ফুট উঁচু। ‘হাওয়াখানা’ বা ‘হাওয়ামহল’ নামে পরিচিত। মন্দিরের আদলে নির্মিত প্রবেশদ্বারের উপরে সাধকরা বসে যজ্ঞ ও যোগসাধনা করেন। সেইজন্য এই প্রবেশদ্বারটিকে ‘যোগী খোলা’ বা ‘যোগমণ্ডপ’ও বলা হয়।
মন্দিরপ্রাঙ্গণে পাশাপাশি তিনটি মন্দির রয়েছে। ল্যাটেরাইট পাথরে তৈরি। দণ্ডেশ্বর মন্দির, খড়্গেশ্বর মন্দির ও মহাবীর মন্দির। দণ্ডেশ্বর ও খড়্গেশ্বর মন্দিরের দক্ষিণদিকে রয়েছে মহামায়ার মন্দির। কথিত আছে, রানি শিরোমণি এই মহামায়ার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরে মা মহামায়ার সঙ্গে বগলাদেবীরও বিগ্রহ রয়েছে। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। কর্ণগড়ের রাজা যশোবন্ত সিংহ নাকি এই পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। মহামায়া মন্দিরের পিছনে রয়েছে সিদ্ধিকুণ্ড। এর জল শুধুমাত্র দেবীর অন্নভোগ এবং পুজোর কাজে ব্যবহৃত হয়। সিদ্ধিকুণ্ডর পরেই রয়েছে যোগমায়া মন্দির। কল্পতরু বেদিতে কল্পতরু গাছের নিচে ভক্তরা মনস্কামনা পূরণের জন্য সংকল্প করেন। মহামায়া মন্দিরে হয় নিত্য পুজো। শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময় বিশেষ পুজো আয়োজিত হয়। সমাগম হয় অগণিত মানুষের।
জানা যায়, ‘শিবায়ন’ কাব্যের রচয়িতা তন্ত্রসাধক কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য এই মন্দিরে বসেই ‘শিবায়ন’ কাব্য রচনা করেছিলেন। দণ্ডেশ্বর ও খড়্গেশ্বর মন্দিরের পিছনে মাকড়া পাথর দিয়ে তৈরি এক বেদির উপরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মেদিনীপুর শাখার কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আগ্রহী পাঠকরা স্মৃতিস্তম্ভটি অবশ্যই চাক্ষুষ করতে পারেন।
এছাড়াও শালবনি অঞ্চলে রয়েছে শীতলা, শিব ও কালীমন্দির। এখানকার অধিবাসীদের উৎসবগুলোও দেখার মতো। বেজে ওঠে ধামসা, মাদল। জমে ওঠে নাচ-গান। শালবনির উপর দিয়ে বয়ে গেছে তমাল নদী ও কংসাবতী সেচ বিভাগের দুটি ক্যানেল। বর্ষার মরশুমে এই অরণ্য-অঞ্চলে ঘুরে আসতে পারেন। দূর হয়ে যাবে শরীর ও মনের ক্লান্তি।
কীভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে শালবনি পর্যন্ত আছে বাস। হাওড়া, শালিমার, সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে খড়্গপুর, মেদিনীপুর হয়ে লোকাল ও এক্সপ্রেস ট্রেনে শালবনি স্টেশন যাওয়া যায়। যেতে পারেন নিজের গাড়িতেও। কলকাতা থেকে শালবনি প্রায় ১৭০ কিলোমিটার পথ।
কোথায় থাকবেন?
শালবনিতে আছে কয়েকটি লজ। সেখানে থাকা যায়। পাশাপাশি থাকা যায় মেদিনীপুর শহরের হোটেল, লজেও। মেদিনীপুর শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বে শালবনির অবস্থান। গাড়িতে শালবনি বনাঞ্চল এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যায়।