শেষ বোশেখের দাবদাহে দিনের আলোয় বাইরে বেরোনোই যেন আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরই মধ্যে হইহই করে এসে গেল মাতৃদিবস।
মাতৃদিবসের মূল আখ্যান রোম থেকে এলেও সারা বিশ্বেই এই দিনটা সমান জনপ্রিয়। যিশুখ্রিস্টের জন্ম হতে তখনও ২৫০ বছর বাকি। সেই সময় রোমের অধিবাসীরা দেবী হিলারিয়াকে সম্মান জানাতে মাতৃদিবসের প্রচলন শুরু করেন।
আরও পড়ুন-মোদিবাবু এবার তুমি ভোকাট্টা হবে, দুর্যোধন-দুঃশাসনের থেকেও ভয়ঙ্কর এই বিজেপি : মুখ্যমন্ত্রী
তার পর সাত সমুদ্র তেরো নদী দিয়ে গ্যালন গ্যালন জল বয়ে গিয়েছে। যিশুখ্রিস্ট ক্রুশ বিদ্ধ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর মা মেরিকে স্মরণ করে শুরু হল মাদারিং সানডে। সেও অনেক কাল আগের ঘটনা। সীমাবদ্ধ ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়। বর্তমান ধারণার মাতৃদিবস শুরু হয় ১৯০৮ সালে। আমেরিকায় শান্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অ্যানা জার্ভিস মায়ের জন্যে গোটা একটা দিন বরাদ্দ করার দাবি তোলেন। অ্যানা জার্ভিস আমেরিকাবাসীর কাছে আবেদন করেন রোজ সম্ভব না হলেও মাদার্স ডে-তে অন্তত ছেলে-মেয়েরা যেন মায়ের জন্য হাতে লেখা একটা চিঠি আর উপহার দেন। তার পর থেকে বিশ্ব জুড়ে মাতৃদিবস পালন করা হয় হইহই করে।
মা বলতে আমরা বুঝি নিখাদ নিঃস্বার্থ ভালবাসা, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে, দোষ-গুণ সাংসারিক অবস্থার ঊর্ধ্বে। তাঁর শ্রেণি, গোত্রের বিচার নেই। যে সন্তান দুর্বল, তার দিকেই মায়ের টান বেশি। সরোদামণি বলতেন, “মনে ভাববে, আর কেউ না থাক, আমার একজন ‘মা’ আছেন।”
যে তাঁর কাছে এসে পড়ত, আশ্রয় চাইত, মা তাঁদের অকাতরে ভালবাসতেন, আশ্রয় দিতেন। গাঁয়ের এক বৃদ্ধা মাঝি-বৌ দীর্ঘ দিন পরে মায়ের কাছে এসেছেন। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, তাঁর রোজগেরে ছেলেটি মারা গেছে। শুনে মা ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন। যাঁর গলার স্বর কখনও শোনা যায় না, তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে দেখে সেবক সাধুটি ব্যস্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন— দুই মা-ই সন্তান শোকে কাঁদছেন, কার সন্তান বোঝা যাচ্ছে না। পরে একটু শান্ত হয়ে মা দরিদ্র মাঝি-বৌকে এক মাথা তেল ও মুড়িগুড় দিলেন। যাওয়ার সময় বললেন, “আবার এসো মাঝি-বৌ।”
আরও পড়ুন-বোসের পাশে বসাও পাপ, ডাকলেও রাজভবনে যাব না, ইস্তফা দিন রাজ্যপাল
মা কিন্তু শুধুই স্নেহময়ী জননী নন, পথপ্রদর্শকও। এক বার তাঁর এক ত্যাগী-সন্তান সন্ন্যাসের পবিত্র ব্রত ভঙ্গ করে অনুতপ্ত হন। মা তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার সব অপরাধ আমি ক্ষমা করেছি, তুমি আমার সন্তানই থাকবে, কিন্তু ব্রতভঙ্গকারীর কোনও প্রায়শ্চিত্তেই সন্ন্যাসী-সঙ্ঘে স্থান হতে পারে না।” যে ভুল করেছে, মাতৃসুলভ স্নেহ দিয়ে তার ভুল দেখিয়ে দিয়েছেন, ভুল সংশোধন করতে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু ভুল ‘ভুল’ নয়, কখনও তা বলেননি। দুর্বলকে ক্ষমা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, চেয়েছেন সে দুর্বলতা জয় করুক, তার পথও বলে দিয়েছেন। কিন্তু স্নেহান্ধ হয়ে দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি স্নেহময়ী ছিলেন, স্নেহদুর্বলা ছিলেন না। আজকের এই সমস্যাদীর্ণ দেশে এরকম মা আমাদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে আরও ভালবাসতে শেখান, তাঁর নিজের আদর্শে আমাদের আরও সেবামুখী করে তুলুন, এই প্রার্থনা।
অনেককেই বলতে দেখেছি, মাকে ভালবাসতে আবার কোনও নির্দিষ্ট দিন লাগে নাকি? মা তো সব সময়ই মা। সারা বছরই ভালবাসার বন্ধনে অটুট থাকুক পৃথিবীর সেরা উপহার মায়ের প্রতি ভালবাসা। ধরে নিলাম কথা ঠিক আছে, তবে বছরের একটা দিন যদি প্রিয় মায়ের জন্য বরাদ্দ থাকে, মাকে উপহার দেওয়ার উপলক্ষে যদি এই দিনটি তৈরি করে দেয়, মা দিবসে যদি দূরে অবস্থান করা কোনও সন্তান মায়ের কাছে ফিরে আসে তাহলেই আন্দাজ করা যায় মা আর আদরের সন্তানের মধ্যে যে কত কালের ভালবাসা নিহিত ছিল।
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মা যাবতীয় মমতার আশ্রয়স্থল ও অফুরন্ত ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীতে প্রতিটি শিশু সন্তানের প্রথম শেখা বুলিও হচ্ছে ‘মা’। এই পৃথিবীর ইতিহাসে সকল ধর্মই মাকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসন। তবে মানুষ ছাড়াও এই পৃথিবীতে অবুঝ প্রাণীদের মধ্যেও প্রবল মাতৃত্ববোধ চোখে পড়ে। অন্য কারও ভালবাসার মধ্যে স্বার্থ নিহিত থাকলেও, এক মাত্র মায়ের ভালবাসায় কোনও ধরনের স্বার্থপরতার স্পর্শ নেই, আর নেই কোনও চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ।
আরও পড়ুন-শাহরুখই সেরা মালিক, বিতর্কের আবহে গম্ভীর
একমাত্র মা-ই সন্তানকে বুক-ভরা ভালবাসা দিয়ে লালন-পালন করেন। মায়ের আচঁল/কোলই সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তাই মাকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানানোর জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নেই। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসা প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের, প্রতিক্ষণের। তারপরও এই বিশ্বের সকল মানুষ যাতে একসঙ্গে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারে, সেজন্য প্রতি বছরের মে মাসে বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মা দিবস।
প্রতিটি মানুষই কোনও না কোনও মায়ের সন্তান। মাকে বাদ দিয়ে সন্তান হয় না, মানুষ হয় না। মাকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা করার শিক্ষা পুরো মানবজাতিকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা করারই নামান্তর। মানবসম্পদের যথার্থ বিকাশ এবং মানব সমাজের সার্বিক অগ্রগতির জন্য মা জাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্বশীলতা এবং ভালবাসা অবশ্যই অপরিহার্য এবং পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আজ এই অন্ধকার সময়ে, এই গুলিয়ে যাওয়া পরিবেশ-পরিসরে মায়ের প্রতি ভালবাসা সেই জরুরি অনুভূতি, যা আমাদের সুস্থ করে তুলতে পারে, ভদ্র করে তুলতে পারে।