বাঙালিদের নবান্ন উৎসবের মতোই দক্ষিণ ভারতে নতুন ফসল ওঠার আনন্দের উৎসব হল ওনাম। আর এই ওনামের কেন্দ্রে রয়েছে রাজ্য কেরল। এখানকার জাতীয় উৎসব ওনাম। রাজ্যের সমস্ত ধর্মাবলম্বী ও জাতের মানুষ এই ওনাম উপলক্ষে একত্রিত হন। এবছরেও হইহই করে শুরু হয়ে গেছে ওনাম। ১০ দিনের এই উৎসব শেষ হবে ১৭ সেপ্টেম্বর। গোটা বিশ্ব জুড়ে মালয়ালি সম্প্রদায় এই উৎসব ধুমধাম করে উদযাপন করে। ১০ দিন ধরে চললেও শেষের দিনটির তাৎপর্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন-সুনীলের ঘরের মাঠে আজ কঠিন চ্যালেঞ্জ লাল-হলুদের
পৌরাণিক গল্পগাথা
পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, পুরাকালে এক অসুররাজ মহাবলী কেরলে রাজত্ব করতেন। তখন কেরলের স্বর্ণযুগ। অসুর হয়েও তিনি ছিলেন উদার। রাজ্যে ছিল না কোনও অভাব। রাজ্যের প্রতিটা মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন। মহাবলী ছিলেন তেজস্বীও। তাঁর দাপটে দেবতারা সর্বদা থাকতেন তটস্থ। দেবতাদের আসন তখন টলমল অবস্থায়। ফলে দেবতারা তখন ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন এবং ওই অসুররাজকে দমন করার জন্য ভগবান বিষ্ণু তখন বামন অবতার রূপে কেরলে অবতীর্ণ হলেন। দানশীল মহাবলী সাহায্যপ্রার্থী কাউকে ফেরাতেন না আর এই সুযোগটি নিলেন বিষ্ণু। তিনি সাহায্যপ্রার্থী হয়ে মহাবলীর কাছে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর কাছে বসবাসের জন্য তিন পদ মাপের জমি চাইলেন। মহাবলী বামনরূপী বিষ্ণুকে চিনতে পারলেন না। তাই বামনের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। প্রথমবার পা রাখতেই বিষ্ণু গোটা পৃথিবী অতিক্রম করেন। দ্বিতীয়বার শেষ করেন স্বর্গ ও পাতাল। তৃতীয়বার পা তুলে মহাবলীকে প্রশ্ন করেন, ‘কই? আর একবার পা রাখার জায়গা কোথায়? স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সব যে শেষ।’ মহাবলী সবই বুঝলেন, কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মাথা নিচু করে তিনি বামনদেবকে তাঁর মাথায় পা রাখতে বললেন। বামনদেব তখন মহাবলীর মাথায় পা রাখলেন আর সঙ্গে সঙ্গে মহাবলী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। শেষ মুহূর্তে মহাবলী কাতর কণ্ঠে বিষ্ণুর কাছে অনুরোধ জানালেন, তিনি যেন তাঁর প্রিয় রাজ্যে প্রতিবছর একবার এসে প্রিয় প্রজাদের দেখে যেতে পারেন। বিষ্ণু মহাবলীর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। বামনদেবের আশীর্বাদে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন মহাবলী। ধারণা করা হয়, ওনাম উৎসবের মাধ্যমে অসুররাজ মহাবলী কেরলে ফিরে আসেন প্রতিবছর। প্রিয় প্রজাদের দেখতে তাঁর আগমন উপলক্ষে তাই পালিত হয়ে থাকে এই ওনাম উৎসব।
দশ আয়োজনে
মালয়ালি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চিংগাম মাসের ২২তম দিনে ওনাম উদযাপিত হয়। আর এই ওনাম থেকেই শুরু হয় মালয়ালি নববর্ষ কোল্লা বর্ষম। এই উৎসব ১২ দিনের হলেও মূলত পালিত হয় ১০ দিন। থাকে নানা আয়োজন। প্রথম দিন কোচির বামনমূর্তি থিরিকারা বা ত্রিক্কাকারা মন্দির থেকে উৎসবের সূচনা হয় যার নাম আথাম। এই মন্দির থেকে আরাত্তু নামে এক মিছিল বের হয়। যার আকর্ষণে শহরে ভিড় করেন পর্যটকরা। হাতির পিঠে এখানে বামনদেবমূর্তি বসিয়ে চলতে থাকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। প্রত্যেক বাড়ির সামনে হলুদ ফুলের পাপড়ি দিয়ে আলপনার একটি বৃত্ত আঁকা হয়। এই স্তর প্রত্যেক দিন বৃদ্ধি পায়। নানা রঙের ফুলও যোগ হতে থাকে। ওনামের শেষ দিন এই বৃত্তের সংখ্যা বেড়ে হয় ১০। এই আলপনাকে পোক্কালম বলা হয়। বলিরাজা ও বামন অবতারের মূর্তি উঠোনে বা প্রবেশদ্বারে রাখা থাকে। ওনামের দ্বিতীয় দিনে মহাবলী রাজ্যবাসীর ঘরে ঘরে যান বলে প্রচলিত বিশ্বাস। তাই সকলে ঘরদোর পরিষ্কার করে, রং করে আলোর মালা দিয়ে বাড়িঘর সাজানো হয়। এর নাম ‘চিথিরা।
পরের দিন ‘চোধি’। এই দিনে নতুন জামাকাপড় ও আপনজনদের জন্য উপহার কেনাকাটার দিন। যে-যার সাধ্যমতো কেনাকাটা করে থাকেন। ওনামের ঐতিহ্যবাহী পোশাক মেয়েদের সোনালি-পাড় সাদা সিল্কের শাড়ি, এর নাম ‘কাসাভু’। পুরুষদের পোশাক সাদা বা ঘিয়ে সিল্কের লুঙ্গি, সঙ্গে ঊর্ধ্বাঙ্গের সোনালি বা রঙিন জামা, যার নাম ‘মুন্ডু’।
আরও পড়ুন-ফোনে সেই বিস্ফোরক কথোপকথন
মহাভোজে
চতুর্থ দিন ভিসাকাম। এই দিনে পালিত হয় শ্রীনারায়ণ গুরুজয়ন্তী। এ দিন দুপুরে আয়োজিত হয় ওনামের মহাভোজ। ট্র্যাডিশনাল মালয়ালি পদ রান্না করা হয় এই সময়। তাকে স্থানীয় মালয়ালম ভাষায় বলে ‘সাদ্য’। প্রতিটি বাড়িতেই পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে রান্না হয়। মোট ২৬টি পদ থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নোনতা কলাভাজা বা কলার চিপস, গুড়-মাখানো মিষ্টি কলাভাজা, কাঁচা আমের আচার, পাঁপড়, থোরান, আদা, তেঁতুল ও গুড়ের চাটনি, (ওনামের প্রথম দিনই এটা তৈরি হয়) মেজহুক্কুপুরাত্তি, কালান, ওলান, মশলাদার তরকারি, আভিয়াল, সাম্বার, ভাত, ডাল, এরিশেরি, রসম, আচার, বাটারমিল্ক, চালগুঁড়ি, কাজুবাদাম, মিহি নারকেলকুচি, গুড় সহযোগে তৈরি মিষ্টান্ন, পায়েস ইত্যাদি। সাদ্য পরিবেশন ও ভোজনপর্ব চলে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। আহার পরিবেশিত হয় কলাপাতায়। প্রায় এক মাস আগে থেকে আয়োজন শুরু হয়।
প্রতিযোগিতায়
পঞ্চম দিনকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় আনিঝাম। নদীনালা প্রধান কেরলে বোট রেস বা নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা জগদ্বিখ্যাত। এই ওনামকে কেন্দ্র করে নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতাও হয়। নদীর ধারে ভিড় করে দর্শনার্থীরা নিজের নিজের গ্রামের নৌকাকে উৎসাহ দেয়। নৌকাগুলোর মাথার দিকটা সাপের ফণা বা বল্লমের ফলার মতো উঁচিয়ে থাকে, স্থানীয় ভাষায় এই সর্পাকৃতি নৌকাগুলিকে পল্লিওডামস বলে। এই নৌকোর প্রতিযোগিতাকে ইংরেজিতে ‘স্নেক-বোট রেস’ ও স্থানীয় ভাষায় ‘বল্লমকেলি’ বলা হয়। এখানে আরানমুলা উথ্রাত্তাহি-ট্রফি বোট-রেস ও নেহরু-ট্রফি বোট-রেস দুটিই বিখ্যাত। এই নৌকো-বাইচ দেখতে সারা পৃথিবী থেকে ভ্রমণার্থীরা এই সময় কেরলে আসেন। এজন্য আরানমুলা এলাকার পার্থসারথি মন্দির প্রতিবছর নৌকা প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান করেন।
নাচেগানে
ষষ্ঠ দিনের উৎসবের নাম থিরিকেটা। এই দিনটিতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা একত্রিত হন। অনেকে নিজেদের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতে পুরনো জন্মভিটে পরিদর্শনে যান।
সপ্তম দিনে নাচগানের মাধ্যমে উৎসবের উদযাপন মেতে ওঠেন সব্বাই। এই উৎসবের স্থানীয় নাম মুলাম। মেয়েরা কেরলের বিখ্যাত লোকনৃত্য ‘কায়কোট্টিকলি’ পরিবেশন করে নানা অনুষ্ঠানে। এছাড়া কেরলের অন্যান্য বিখ্যাত নৃত্যশৈলী যেমন— থিরুভাতিকলি, পুলিকেলি, খুল্বি খুল্লাল, কথাকলি ইত্যাদির আয়োজনও হয় বিভিন্ন জায়গায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেন। কথাকলিতে মুখ এঁকে বিশাল শিরোভূষণ পরে বিচিত্র বেশভূষায় রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক নানা চরিত্রে অভিনয় করেন শিল্পীরা। ভারতের লোকসংস্কৃতির এই ধারাগুলি এই ধরনের উৎসবকে কেন্দ্র করে এখনও বেঁচে আছে। পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে।
আরও পড়ুন-অরাজনৈতিক মুখোশের আড়ালে রাজনীতির কারবারিদের কারসাজি
আসছে বছর
অষ্টম দিনকে বলা হয় পুরাদম। যে বৃত্তাকার আলপনা প্রথম দিন থেকে দেওয়া শুরু হয়েছিল দরজার বাইরে দেওয়া সেই বৃত্তাকার আলপনায় এদিন যুক্ত হয় শেষের বৃত্ত। অর্থাৎ দশম দিনের দশ নম্বর বা সব শেষের বৃত্ত। বলিরাজা ও বামন অবতারের ছোট মূর্তি আলপনার মাঝে বসানো হয়। অসুররাজ মহাবলীকে অভ্যর্থনা জানাতেই কেরলে ওনামের সময় প্রতিটি বাড়ির দরজায় এই ফুল দিয়ে আলপনা দেওয়ার রীতি রয়েছে।
নবম দিনটি ওনাম-সন্ধ্যা, নাম উথরাদম। খাওয়াদাওয়া, আনন্দ-আহ্লাদে কাটে এই দিন। এই দিনটি উৎযাপনের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার দিন। দশম অর্থাৎ শেষ দিনটি হল থিরুভুনাম। এই ওনামের বাকিদিনগুলির মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। উৎসবের সমাপ্তির এই দিন সকাল-সকাল স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে নতুন করে আলপনা দেন কেরলবাসী। সন্ধ্যায় রাজ্য জুড়ে আলোকসজ্জা ও আতশবাজির আয়োজন হয়। শহর জুড়ে বেরয় শোভাযাত্রা, সঙ্গে সঙ্গে চলে নাচ-গান। রাজ্যের স্থানীয় গ্রামগুলোয় নানা ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলো, যেমন কায়ানকলি, আত্তাকালাম, কুটুকুটু, কাবাডি, আম্বেয়াল, তালাপ্পনথুকলি প্রভৃতির আয়োজন হয়।
কেরলের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও মহোৎসাহে উৎসবে শামিল হয়। তাঁরা মোমবাতি জ্বেলে বাইবেলে ফুলবর্ষণ করেন, একে বলে নিলাভিলাক্কু। শেষ দিনে বৃত্তাকার আলপনার মাঝে বসানো বলিরাজার মূর্তি যা স্থানীয় ভাষায় ওনাথাপ্পান নামে পরিচিত তা বিসর্জন দেওয়া হয়, তার পর সকলে দরজার সামনের আলপনা পরিষ্কার করে ফেলেন। কেরলের এই উৎসবের শেষে আবার কেরলবাসী মহাবলীর আগমনের সুদীর্ঘ অপেক্ষায় বসে থাকেন।