সাম্প্রদায়িকতা নয়, সম্প্রীতি চাই এক বিদ্বেষহীন ভারতের বোধন

নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের দেশে ভুলি ভেদাভেদজ্ঞান আগুয়ান হওয়ার মন্ত্র জানেন কেবল জননেত্রী। তাঁরই নেতৃত্বে নতুন ভোরের অভ্যুদয়ের জন্য অপেক্ষমাণ আমরা সবাই। লিখছেন চিরঞ্জিৎ সাহা

Must read

ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি শেখায়— ‘অতিথি দেবো ভব’। অর্থাৎ অতিথি হলেন ঈশ্বর। তাই তো হিন্দুপুরাণে উল্লেখিত— ‘অতিথি নারায়ণ।’ সাম্যবাদী আন্দোলনের সর্বপ্রথম সূত্রপাত হয়েছিল এই পশ্চিমবঙ্গের পবিত্রভূমি নদীয়ার নবদ্বীপেই। সৌজন্যে ধামেশ্বর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। জাতি, ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে কীর্তনের সম্মোহনে গোটা বাংলাকে যিনি দীক্ষিত করেছিলেন মনুষ্যত্বের মহামন্ত্রে। ধর্মীয় ও প্রাদেশিক সংকীর্ণতাকে ধূলিসাৎ করে মানবিকতার আহ্বান তাঁকে মৃত্যুর ৫০০ বছর পরেও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় চিরজীবী করে তুলেছে।

আরও পড়ুন-বীরাঙ্গনা

‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে, যেদিন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।’— এই বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশের সর্বপ্রথম মহাত্মা বাঙালি লালন ফকির, যে অভাগার জাতটাই আজও সঠিকভাবে চিহ্নিত করে উঠতে পারলেন না গবেষকরা। কেউ তাকে মুসলমান বলে, কেউবা বলে হিন্দু। আদতে তিনি জাত-বর্ণ-ধর্ম বহির্ভূত মানবিক বন্দনার বাউল। লালন হিন্দু বা মুসলমান কোনওটিই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ওহেদানিয়াত নামক একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদের অনুসারী। ওহেদানিয়াতের মাঝে বৌদ্ধধর্ম এবং বৈষ্ণব ধর্মের সহজিয়া মতবাদ, সুফিবাদ-সহ আরও অনেক ধর্মীয় মতবাদ বিদ্যমান। তাই তো উদাত্ত কণ্ঠে বাঙালি লালন গাইতে পেরেছিলেন—
‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়।
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রম তো গেল না।।’
সংহতির শাশ্বত রাজধানী এই বাংলার সম্প্রীতির সার্থক পতাকা বাহক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে গরিব আখরোট বিক্রেতা রহমত কাবুল থেকে কলকাতায় এসে কোনোরকম পূর্বপরিচয় ছাড়াই সন্তানস্নেহে আপন করে নেয় ছোট্ট বাঙালি মেয়ে মিনিকে। গড়ে ওঠে সখ্য। পরবর্তীতে ভাগ্যের দুর্বিপাকে কলকাতায় দশ বছরের জেলযাত্রা ঘটে রহমতের। মুক্তির পর নিজের মেয়ের বিয়ের আড়ম্বরের ব্যয় সংকোচন করে কপর্দকশূন্য আফগান কাবুলিওয়ালার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন মিনির বাঙালি বাবা। সেই রবীন্দ্রনাথই তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় লিখেছেন— ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন—
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ শ্রীচৈতন্য, লালন কিংবা রবীন্দ্রনাথের প্রোথিত এই আদর্শের বীজ মহীরুহ হয়ে ক্রমে সমৃদ্ধ করেছে বঙ্গসংস্কৃতিতে। উদারতা বাঙালির সত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবহমান।
ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে চন্দননগরের ফরাসডাঙায় বসবাস করতে শুরু করে এক পর্তুগিজ পরিবার। সেই পরিবারেরই ছোট ছেলে অ্যান্টনি বাংলা ভাষা রপ্ত করে তাতে গান বেঁধে রাম বসু, ঠাকুর সিংহ, ভোলা ময়রার মতো দুর্ধর্ষ কবিয়ালদের পর্যদুস্ত করেছিলেন অবলীলায়। খ্রিস্টান এই ভদ্রলোকের কলকাতা বউবাজারের বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে ছিল আন্তরিক যাতায়াত। তাই আজ এই মন্দির পরিচিত ‘অ্যান্টনি কালীবাড়ি’ নামে—
‘খৃষ্টে আর কৃষ্টে কোনও তফাৎ নাই রে ভাই / শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এই কথা শুনি নাই… আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে / ঐ দ্যাখো শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে / আমার মানবজনম সফল হবে যদি রাঙা চরণ পাই।’
তৎকালীন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক ও প্রগতিশীল চিন্তাবিদ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর কর্মভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এই বাংলাকেই। ১৯২৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দার্জিলিংয়ে আসেন আলবেনিয়ান ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী মাদার টেরেজা। মানবসেবার মহৎ আদর্শে নিজেকে উদ্দীপ্ত করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি। আন্তরিকতার শহর কলকাতার ভালবাসার বন্ধন ছিন্ন করার স্পর্ধা পরবর্তীতে আর দেখাতে পারেননি তিনি।

আরও পড়ুন-চিকিৎসা শিক্ষায় হিন্দি চাপানোর অপচেষ্টা, মধ্যপ্রদেশেই মুখ থুবড়ে পড়ল বিজেপি সরকার

আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন মাত্র ২১ বছরের একটি মেয়ে। তারপর সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলার মায়া কাটিয়ে আর দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনি তাঁর। ভারতবর্ষের উন্নতিকল্পে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সেই ক্লান্ত নিথর শরীরটা আশ্রয় নিয়েছিল ভারতমাতার নিরাপদ কোলে। ততদিনে জড়িয়ে পড়েছেন এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও। রবীন্দ্রনাথের ‘লোকমাতা’, এই আইরিশ, মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল বঙ্গদেশকে কোনও স্বার্থ ছাড়াই ভালোবেসে ছিলেন নিজের মাতৃভূমির চেয়ে অনেক বেশি। আর বাংলাও সনাতনী সংস্কৃতি অনুসরণ করে এদের আপন করে নিয়েছিল হৃদয়ের মণিকোঠায়।
১৯৮০-এর দশকে বন্ধু মজিদ ও খাবাজিকে সঙ্গী করে সুদূর ইরান থেকে কলকাতা ময়দানে পা রেখেছিল ঝাঁকড়া চুলের এক দামাল ছেলে। সময়ের সাথে সাথে কলকাতাই হয়ে ওঠে তার ঘরবাড়ি। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেই কল্লোলিনী বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল ইরানিয়ান ঝরনা জামশিদ নাসিরিকে কিংবা হাল আমলের ব্রাজিলিয়ান হোসে রামিরেজ ব্যারেটো থেকে বাইচুং ভুটিয়া, আলভিটো ডিকুনহা— পেশাদারি ফুটবলের প্রয়োজনে কলকাতায় পাড়ি জমালেও অবসর পরবর্তীকালে তিলোত্তমার উষ্ণ আশ্রয় অগ্রাহ্য করে ফিরে যেতে পারেননি নিজেদের পুরনো শিকড়ে। আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়েছেন কলকাতার ভালবাসার শিকলে।
পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যিক রাজধানী কলকাতার বড়বাজার যেন এক টুকরো ভারতবর্ষ। নির্ভয়ে বহু মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবি নিজের মাতৃভাষায় তাদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করছে এই বাংলায়। ব্যারাকপুর কিংবা দুর্গাপুরের শিল্পতালুকে প্রবেশ করলে গুলিয়ে যেতে পারে বিহারের কোনও নাম না জানা শহরের সাথে। এই বাংলা সততই যেন উদারতার তীর্থক্ষেত্র। ঝালমুড়ির স্টলের সাথে কলকাতার ফুটপাথ আজ নির্দ্বিধায় ভাগ করে নেয় পাহাড়ি মোমো কিংবা বিহারি লিট্টির ঠেলাগাড়ি। সুদূর চিন কিংবা কোরিয়া থেকে আসা অল্প বয়সি ছেলেটির বানানো উপাদেয় সহযোগে ব্রেকফাস্ট সারতে বাঙালি ভোরবেলা ভিড় জমায় চায়না টাউনে। অথচ সেই বাঙালিকেই আজ নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলার অপরাধে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে। গুজরাতের সুরাটে পুলিশ জোরজবরদস্তি বন্ধ করে দিচ্ছে বাঙালির মিষ্টির দোকান। গুরুগ্রামের হোটেলের গরিব রাঁধুনি কোচবিহারের সিরোজ আলম মিয়াঁকে বাংলা বলার অপরাধে বাংলাদেশি হিসেবে দাগিয়ে হেনস্থা করে হরিয়ানার পুলিশ। মহারাষ্ট্রের বাঙালি মেয়েদের স্বামীর ঘর ছাড়তে হচ্ছে শুধুমাত্র জাতিগত কারণে। অথচ প্রাদেশিকতার সংকীর্ণ বেড়াজাল অতিক্রম করে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ স্বীকৃতি দিয়েছে মোট ১১টি ভাষাকে। তাহলে কেন এই বৈষম্য? আসলে মিথ্যের ট্রাপিজে ঝুলতে থাকা বিজেপি সরকার ভয় পাচ্ছে বাঙালিকে। ইতিহাস বলে, বিদ্যাসাগর নামের এক বাঙালিই একদা আত্মস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের সাহস দেখিয়েছিলেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে রাজা রামমোহন রায় বন্ধ করেছিলেন সতীদাহ প্রথা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে সুভাষচন্দ্র ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন আইসিএসের মত লোভনীয় চাকরি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকল্পে সর্বাধিক আত্মবলিদানের নজির রয়েছে এই বাঙালিরই। বরাবরই বিপ্লব এবং পরিবর্তনের আঁতুড়ঘর বাংলা। তাই ভয় পাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, নেতাজির উত্তরাধিকারী বাঙালির আজও একটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছে, যিনি বাংলাভাষীর স্বার্থে উদয়ন পণ্ডিতের মতো আত্মত্যাগের মহামন্ত্রে বলীয়ান হয়ে ঘোষণা করেই দিয়েছেন— ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান!’ আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। তারপর সাম্প্রদায়িকতার কাঁচের খাঁচা গুঁড়িয়ে সম্প্রীতির দেবী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বোধন হবে এক নিরপেক্ষ ভারতবর্ষের।

Latest article