প্রতিবেদন: মোদি জমানায় দেশে বাড়ছে ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ। অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর) জানিয়েছে যে, গত এক বছরে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই হামলাগুলি মুসলিম, দলিত, আদিবাসী এবং খ্রিস্টানদের মতো বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংখ্যালঘুদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে এবং বারবার চালানো হচ্ছে। প্রকাশিত রিপোর্টের নাম ‘ঘৃণা অপরাধ প্রতিবেদন : মোদির তৃতীয় সরকারের প্রথম বছরের চিত্রণ’।
আরও পড়ুন-কেন্দ্র বাংলার সঙ্গে দ্বিচারিতা করছে ঘাটালের মানুষ বিচার করুন : মানস
এই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, কীভাবে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও উসকানিমূলক কথা লাগাতার বলা হচ্ছে। এপিসিআর ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা। সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে তারা বলেছে যে, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বাড়লেও ঘৃণা ছড়ানোর অপরাধ রেকর্ড বা নথিভুক্ত করার কোনও সরকারি ব্যবস্থা নেই। ঘৃণার অপরাধ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? রাষ্ট্রসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তির সামাজিক পরিচয়কে কেন্দ্র করে ঘৃণা বা শত্রুতার কারণে যখন তার জিনিসপত্র, শরীর বা সম্পত্তির ক্ষতি করা হয়, তখন তাকে ঘৃণা- অপরাধ বলে। যেমন— হামলা, বয়কট, বের করে দেওয়া, খুন, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর বা এসবের হুমকি দেওয়া সবই ঘৃণা-অপরাধের মধ্যে পড়ে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঘৃণা ছড়ানোর বক্তব্য হল এমন আপত্তিকর কথা, যা কোনও ব্যক্তির সামাজিক পরিচয়কে লক্ষ্য করে ইচ্ছাকৃতভাবে বলা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সময়ে মোট ৯৪৭টি ঘৃণার অপরাধ ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪৫টি ছিল ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং ৬০২টি ছিল সরাসরি ঘৃণার অপরাধ। এই ৬০২টি ঘটনার মধ্যে ১৭৩টিতে সংখ্যালঘুদের ওপর শারীরিক হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেছেন এবং তাঁরা সবাই ছিলেন মুসলিম। এই ঘটনাগুলিতে ২৫ জন হিন্দু ব্যক্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যদিও তাঁরা মূল লক্ষ্য ছিলেন না, তবে ঘটনাস্থলে থাকার কারণে তাদের ক্ষতি হয়েছে। এক্ষেত্রে হিন্দু পুরুষদের চেয়ে হিন্দু নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত এক বছরে দেওয়া ৩৪৫টি ঘৃণাসূচক বক্তব্যের মধ্যে ১৭৮টির জন্য দায়ী ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে ঘৃণার অপরাধ বেশি ঘটে। প্রতি মাসে প্রায় ৮০টি এমন ঘটনা ঘটছে, যা প্রায় ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অক্টোবর ২০২৪ এবং এপ্রিল ২০২৫-এ সবচেয়ে বেশি ঘৃণার অপরাধ ও ঘৃণাসূচক বক্তব্য দেখা গেছে। অক্টোবরে ৮০টি ঘৃণা অপরাধ হয়েছিল। এর বেশিরভাগই ছিল মুসলিম পুরুষদের ডান্ডিয়া বা গরবায় অংশ নেওয়া এবং ‘লাভ জিহাদের’ মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে। মাসের শেষ সপ্তাহে মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা বয়কটের জন্য দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি প্রচার চালিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ (২১), মধ্যপ্রদেশ (১৬) এবং মহারাষ্ট্র (১১) ছিল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য। উত্তরপ্রদেশে অনেক ঘটনায় মুসলিম যুবকদের নবরাত্রি উৎসবে যেতে বাধা দেওয়া হয় এবং তাদের হয়রানি ও মারধর করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি ‘ধর্মীয় ধর্মান্তরের’ বিরুদ্ধেও বড় অভিযান চালিয়েছে। এতে যাজকদের হুমকি দেওয়া হয়েছে বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছে। মহারাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি মুসলিমদের উপর হামলা, গো-সন্ত্রাস এবং খ্রিস্টান ও মুসলিমদের প্রার্থনা সভায় বাধা দেওয়ার মতো ‘সমন্বিত অভিযান’ চালিয়েছে। এই বছরের এপ্রিলেও ৯৬টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২৭টি ছিল বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে। পহেলগাওঁতে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ঘৃণা অপরাধ বেড়েছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক মুসলিমকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-বাংলায় নারী সুরক্ষা নিয়ে মিথ্যাচার, এবার কী বলবে বিজেপি, ৩ বছরে মধ্যপ্রদেশে নিখোঁজ ২ লক্ষ মহিলা
এপ্রিল মাসে রামনবমী ও ইস্টার উৎসবও ছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, উভয় উৎসবের সময়ই ঘৃণা অপরাধ ঘটেছে। আমেদাবাদ ও রায়গড়ে ইস্টার উদযাপন ব্যাহত হয়েছে। মুম্বই ও যোধপুরের মতো শহরে রামনবমীর শোভাযাত্রা মুসলিমদের লক্ষ্য করে ঘৃণা অপরাধের জন্ম দিয়েছে। একই মাসে, নৈনিতালে একটি যৌন হেনস্থার ঘটনা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা উসকে দিয়েছিল। সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ হওয়া এবং মুসলিমদের এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও দেখা গেছে। গণেশ চতুর্থী, নবরাত্রি, রামনবমী এবং হোলির মতো হিন্দু উৎসবগুলো বারবার ঘৃণা অপরাধ এবং সাম্প্রদায়িক সংহতির কারণ হয়েছে। হেট ক্রাইম ট্র্যাকার দেখিয়েছে, রাজনৈতিক নেতা, সংবাদমাধ্যম এবং পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি কীভাবে ধর্মীয় উৎসবগুলিকে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিংসার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ গণেশ চতুর্থীর সময় মধ্যপ্রদেশের পান্নায় মুসলিমদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। থানেতে এক মুসলিম যুবককে ‘মূত্র জিহাদ’ এবং ভিন্ন ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মিথ্যা অভিযোগে মারধর করা হয়। এসব হামলাকে হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এপ্রিল ২০২৫-এর রামনবমীতে সবচেয়ে স্পষ্ট হিংসা দেখা গেছে। রাজস্থানের যোধপুরে একটি রথে শিকল বাঁধা মুসলিম পুরুষের ছবি নিয়ে মিছিল করা হয়। একই মাসে, বারমেরে একটি মসজিদ এবং তেলেঙ্গানায় একটি মাদ্রাসায় ভাঙচুর হয়। রাজস্থানের কিছু গ্রামে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। উত্তরপ্রদেশের বাগপতে এক মুসলিম যুবককে হোলি খেলায় অংশ নিতে অস্বীকার করায় হামলা করা হয়। বরেলিতে হোলি উদযাপনের সময় মুসলিম ছেলেদের একটি সরকারি পার্কে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এসব ঘটনাকে ‘হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত’ করার অজুহাতে লঘু করে দেখানো হয়েছিল। রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে, পুলিশের ভূমিকা বেশিরভাগ সময়ই নিষ্ক্রিয় ছিল। এক বছরে নথিভুক্ত ৬০২টি ঘৃণা অপরাধের মাত্র ১৩% ক্ষেত্রে এপিআইআর দায়ের করা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে এক খ্রিস্টান যাজককে বজরং দলের সদস্যরা পুলিশ স্টেশনের ভেতরেই মারধর করে, যেখানে তিনি সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন। নবরাত্রি সম্পর্কিত অনেক ঘটনায় পুলিশকে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীদের সহায়তা করতে দেখা গেছে, যারা গরবা অনুষ্ঠানে মুসলিমদের আইডি পরীক্ষা করছিল। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, যেকোনও ধরনের নির্বাচন এবং ঘৃণা অপরাধ ও ঘৃণা বক্তৃতার মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। আগে মনে করা হত যে, এমন ঘটনা কেবল সংসদ বা বিধানসভা নির্বাচনের সময়ই ঘটে। কিন্তু এই প্রতিবেদন বলছে যে, স্থানীয় নির্বাচনও ঘৃণা-অপরাধের ঘটনার কেন্দ্র হতে পারে, বিশেষত ঘৃণা বক্তৃতার ক্ষেত্রে, যেমনটি উত্তরাখণ্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর নির্বাচনের সময় দেখা গেছে। সমীক্ষাটি বলেছে যে, দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরাখণ্ডে ঘৃণা-অপরাধের বৃদ্ধি নির্বাচনের সময় বিজেপির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পরিকল্পনা করে ব্যবহৃত হয়েছে। সমীক্ষার পর্যবেক্ষণ, দেশে বিজেপির ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে ধর্মভিত্তিক সহিংসতাও বেড়েছে। এক বছরে রেকর্ড করা ও বিশ্লেষণ করা ৩৪৩টি ঘৃণাসূচক বক্তৃতার ঘটনার মধ্যে ১০৯টি একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সংশ্লিষ্ট সংগঠন দ্বারা দেওয়া হয়েছিল এবং ১৩৯টি জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, পাঁচটি ঘৃণা বক্তৃতা প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই দিয়েছিলেন, ৬৩টি বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রীরা এবং ৭১টি অন্যান্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা। উদ্বেগের বিষয়, এই বছর দুজন বিচারক এবং একজন রাজ্যপালও ঘৃণা-বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসা উসকে দিতে সিনিয়র বিজেপি নেতাদের সক্রিয় ভূমিকার কথা আগেও বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি ২০২৪ সালের প্রতিবেদনেই দেখা গেছে যে মোদির নির্বাচনী প্রচারণার মূল চালিকাশক্তি ছিল ঘৃণাসূচক বক্তব্য। এই সহিংসতা এবং ভিন্নধর্মীদের প্রতি বিদ্বেষ কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন উপাদানের কাজ নয়, বরং সরাসরি শীর্ষ বিজেপি নেতৃত্ব থেকেই এর সূত্রপাত। গত বছর দেওয়া ৩৪৩টি ঘৃণা বক্তৃতার মধ্যে, বিজেপি ১৭৮টি ঘটনা নিয়ে শীর্ষে ছিল, এরপর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ২১টি এবং বজরং দল ২০টি ঘৃণাসূচক ঘটনা ঘটায়।