মাটি আমাদের মা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তালগাছ’ কবিতায় লিখেছেন ‘মা যে হয় মাটি তার/ ভালো লাগে আরবার/ পৃথিবীর কোণটি।’
সত্যিই তো, মাটি আমাদের মা। মাটি আমাদের ধারণ করে। পৃথিবীতে আমরা বেঁচে আছি মাটির সঙ্গে মূল্যবান সংযোগের উপর নির্ভর করেই। প্রকৃতির একটি অতি-গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল মাটি। এর মাধ্যমে আমরা পুষ্টিকর শস্য ফলাতে পারি। গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের খাদ্যের ৯৫ শতাংশেরও বেশি আসে মাটি থেকে। শুধু তাই নয়, বহু প্রাণীর আবাসস্থলও মাটি। তাই মাটির মান বজায় রাখা এবং মাটির গুণমান যাতে নষ্ট না হয় তা নিশ্চিত করা বিশ্বের প্রত্যেকটি মানুষের দায়িত্ব, কর্তব্য।
কিন্তু বহু জায়গায় মাটির গুণমান হ্রাস হয়েছে। যার ফলে মাটির ক্ষয়, উর্বরতা হ্রাস এবং জৈব পদার্থের হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি। গাছের মতো গুরুত্ব পায়নি মাটি। জলবায়ু পরিবর্তন যে অশনিসঙ্কেত দেখাচ্ছে তাতে জল এবং বায়ুর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে মাটিও। মাটি-দূষণের ভয়ঙ্কর প্রভাব বুঝতেই পারছে না এখনকার ডিজিটাল সভ্যতার মানুষ।
আরও পড়ুন-খাঁটি মাটি, খাঁটি জীবন
মিশছে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন
মাটি দূষণ নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন একটা হেলদোল নেই। মার্কিন বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণায় বলেছেন, কলকারখানার দূষণ থেকে নাইট্রোজেন মিশছে মাটিতে। কারখানা, গ্যাস প্ল্যাট, তৈল শোধনাগারের বর্জ্য এবং নানা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মাটিকে শুষ্ক করে তুলছে। এই শুষ্ক মাটি থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশে যাচ্ছে বাতাসে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য কার্বনকে মাটিতে ধরে রাখতে পারছে না। এই কার্বন তেজস্ক্রিয়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে গ্রিন হাউস গ্যাসের চেহারা নিয়ে বাতাসে মিশছে। প্রতিনিয়ত এমন বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে মিশে দূষণের কারণ হয়ে উঠছে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন কীভাবে মাটির স্বাস্থ্য খারাপ করছে ও বাতাসে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমণ করছে, সেই প্রক্রিয়াটা জানার চেষ্টা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। মানুষের তৈরি রাসায়নিক দূষণের কারণেও মাটিতে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন মিশছে। গাছের ফলন বাড়াতে কীটনাশকের যথেচ্ছ প্রয়োগ, শহরের নানা ধরনের বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত নানা রাসায়নিক মাটির ক্ষতি করে। পেট্রোলিয়াম চালিত গাড়ি থেকে নানাবিধ যন্ত্রও মাটির দূষণের কারণ হয়। এই রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে কিছু উপজাত দ্রব্যও তৈরি হয়। সেগুলোও মাটির ক্ষতি করে। দূষিত মাটি ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণও।
হয়ে যাচ্ছে নির্জীব
মাইক্রোবস বা মাইক্রোঅর্গানিজম বলতে বোঝায় মাটিতে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, কেঁচো, নিমাটোড, ছত্রাক ও নানারকম পোকামাকড়কে। মাটির জৈবিক উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য এরাই সহায়ক। বিজ্ঞানীরা বলেন, মাটিতে কম করেও ১৫ রকম ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া নিমাটোড ও সন্ধিপদী প্রাণীরা বসবাস করে। এরাই মাটির প্রাণশক্তি ধরে রাখে, শস্যের ফলনের জন্য পুষ্টি উপাদানের জোগান দেয়। বর্তমান সময়ে শস্যের ফলন বাড়াতে এত বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে যে মাটি নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মাটির জৈব উপাদান, ছত্রাক ও জীবাণু। কমছে ফলনের পরিমাণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জৈব উপাদান মাটির প্রাণশক্তি। সেটা ‘হিউমাস’ গঠন করে। তার উপরে নির্ভর করে ছত্রাক ও রাইজোবিয়াম লেগুমিনোসেরাম, ব্যাসিলাস ফার্মাসের মতো উপকারী জীবাণুর বংশবিস্তার। সেটা কমে যাওয়ায় ছত্রাক ও জীবাণু দুর্বল হচ্ছে। তাই মাটি নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। মানুষের তৈরি দূষণ আর বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে মাটির যে দুরবস্থা হচ্ছে তার ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে মানুষের শরীরেও। শস্যের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে সেই রাসায়নিক, সেখান থেকে ঢুকছে মানুষের শরীরে। নানারকম জটিল মারণব্যধির কারণ হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন-ভিটেমাটির সোহাগ-কথা
বর্জ্য থেকে রোগ সংক্রমণ
হাসপাতাল চত্বরে অনেক সময়ই ব্যবহৃত রক্তমাখা তুলো, ব্যান্ডেজ, ক্যাথিটার নিয়ে পথ কুকুরদের টানাটানি করতে দেখা যায়। এইসব মেডিক্যাল বর্জ্য মাটিতে মিশে নানা রোগ ও অ্যালার্জিজনিত অসুখের কারণ হয়ে উঠছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশে এবং নির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে এই মেডিক্যাল বর্জ্য সাধারণ ভ্যাটে ফেলার কথাই নয়। আলাদা-আলাদা রঙের প্যাকেটে আলাদা-আলাদা বর্জ্য রাখা থাকবে এবং তা প্রতিদিন সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে ওই কাজে নিয়োজিত কর্মীরা। তার পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ওই বর্জ্য নষ্ট করে ফেলার কথা। আদতে এই নিয়ম মানা হয় না অনেক জায়গাতেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিক্যাল বর্জ্য মাটিতে ফেললে মাছি, মশা ওই বিষাক্ত আবর্জনায় বসে এর পর আশপাশের এলাকার খাবারে মধ্যে বসলে তা থেকে নানারকম অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের একটি রিপোর্টে বলেছিল, হাসপাতাল-বর্জ্য থেকে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি।
মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়বে
পৃথিবীর সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই রয়েছে একাধিক পারমাণবিক চুল্লি। সেখান থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ও পারমাণবিক বর্জ্য পরিবেশের সঙ্গে মিশছে অহরহ। এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মাটিতেও মিশছে। হাজার হাজার টন এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্যকে নিষ্ক্রিয় করে সংরক্ষণ করার কোনও উন্নত প্রযুক্তিই এখনও অবধি সেইভাবে সামনে আসেনি। আমেরিকা, জার্মানি, রাশিয়া এই প্রক্রিয়ায় অনেকটা অগ্রসর হলেও ভারতে এখনও তেমন পদ্ধতি তৈরি হয়নি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘প্লুটোনিয়াম ২৩৯’ হচ্ছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ, যা ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী। একটি মাঝারি মাপের পরমাণু চুল্লি প্রতি বছরে ২৫০-৩০০ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম ২৩৯ তৈরি হয় যা লক্ষ লক্ষ বছরের জন্য পারমাণবিক দূষণ তৈরি করে। মৃত জীবেও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব থেকে যায় এবং পরিবেশেও ক্রিয়াশীল থাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিষ্ক্রিয় করে নিরাপদে সংরক্ষণ করতে না পারলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাণঘাতী ফুসফুসের ক্যানসার রোগ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে।
সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে
যেভাবেই হোক, রক্ষা করতে হবে মাটিকে। মাটির গুণগত মান বজায় রাখার তাৎপর্য এবং এই উপাদান আমাদের জীবন এবং খাদ্যব্যবস্থায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর পালিত হয় বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। ২০১৩ সালের জুনে, এফএও সম্মেলন বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের দিনটি ঠিক হয়। পরে ৬৮ তম জাতিসংঘ জাতীয় সাধারণ পরিষদের কাছে এই দিনটি পাঠানো হয়, যাতে জাতিসংঘ ৫ ডিসেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্তিকা দিবস হিসাবে গ্রহণ করে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১৪-র ৫ ডিসেম্বরকে প্রথম সরকারি বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসাবে মনোনীত করে। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রচারাভিযানের লক্ষ্য হল ভাল ও স্বাস্থ্যকর ফসল পেতে মাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা সকলকে বোঝানো। জল ও মাটির মধ্যে সম্পর্ক বোঝানোর জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ এই দিন। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের মাধ্যমে সারা বিশ্বে মাটি ভাল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশ্বের সমস্ত নাগরিকদেরই নিজের মাটির দিকে খেয়াল রাখা উচিত ও ভাল রাখা উচিত— সেই সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে এই বিশেষ দিনটি।
আরও পড়ুন-বাংলা কল্পবিজ্ঞানের রাজা
এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসংঘ তার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে লিখেছে— ‘সাসটেইনেবল সয়েল ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস, অল্প চাষাবাদ, ফসলের পরিবর্তন, জৈব পদার্থ সংযোজন এবং কভাক ক্রপিং মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে এবং মাটির ক্ষয় হ্রাস করে এবং জলের অনুপ্রবেশ এবং সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে পারে। এই প্রক্রিয়াগুলো মাটির জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে, উর্বরতা বাড়ায় এবং কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন ঠিক রাখে। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সব প্রক্রিয়া।’
২০২৪ সালে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের থিম হল ‘মাটির যত্ন : পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা।’ যা মাটির বৈশিষ্ট্যগুলি সহজেই বোঝাবে। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান, আলোচনাসভা আয়োজিত হয়। যাতে মানুষ সচেতন হতে পারেন। এটা ঠিক, দিনটি পালনের ফলে আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে। আশা করা যায়, আগামী দিনে মানুষের সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সুরক্ষিত থাকবে মাটি।