কখনও কখনও মনে হয়, সব সমাপতন নেহাত কাকতলীয় নয়। এক সুগভীর ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে তার ভেতর। আপাত অদৃশ্য কিন্তু ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ ইশারা লুকিয়ে থাকে তার ভেতর।
তেমনই এক সমাপতন আমাদের নাড়িয়ে দিল সোমবার। বহুদিন ধরেই ঠিক করা ছিল চাঁদমারি। চোরাগোপ্তা হামলা চলতই, সুযোগমতো, সুবিধা বুঝে। এবারই প্রথম কোনও রাখঢাক ছাড়া, একেবারে সরাসরি।
আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু দুটি শব্দ, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আর ‘সমাজতন্ত্র’। অনেকদিন ধরেই ভারতের আত্মপরিচয়ে এই দুটি বৈশিষ্ট্য লগ্ন থাকুক, চাইছিলেন না মোদিপক্ষ। ছাঁটার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। কারণ, সংবিধানের প্রস্তাবনায়, একেবারে ‘সার্বভৌম’-র সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে, কর্তনযোগ্য শব্দদ্বয় দাঁড়িয়েছিল, ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর সৌজন্যে। বিপুলভাবে আঘাত করলে দেশের সার্বভৌমত্ব আহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই, তাই-ই, চোরাগোপ্তা আক্রমণের পথ নিয়েছিল বিজেপি।
আরও পড়ুন-সিবিআই তদন্ত খারিজ করল সুপ্রিম কোর্ট
২০১৫-র কথা। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ দেশব্যাপী বিতর্কের ডাক দেন ওই শব্দ দুটোকে নিয়ে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ওই দুটি শব্দ থাকার আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটা ঠিক করার জন্যই ওই বিতর্কের আহ্বান।
কেন ‘প্রস্তাবনা’ নিয়ে এত মাথাব্যথা? কারণ, বিভিন্ন মামলায় রায় দিয়ে গিয়ে ভারতের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা প্রস্তাবনার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যদিও প্রস্তাবনা সংবিধানের কার্যকরী অংশের অন্তর্গত নয়। আইনগত বিচারে প্রস্তাবনা গুরুত্বহীন। প্রস্তাবনা ‘নিষ্ঠাপূর্ণ সংকল্প’ (Solemn resolve) হতে পারে, কিন্তু সংকল্প আর কার্যকরী আইন তো এক নয়। তা সত্ত্বেও সংবিধান সংশোধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রস্তাবনাকে সংবিধানের অংশ হিসেবেই গণ্য করা হয়। কারণ, বেরুবাড়ি মামলায়, সুপ্রিম কোর্টের অভিমত অনুযায়ী, এই প্রস্তাবনা হল সংবিধান প্রণেতাদের মনোরাজ্যের চাবিকাঠি। সংবিধানের কোনও বিশেষ অংশ অস্পষ্টতার কারণে বোধগম্য না হলে সেটিকে প্রস্তাবনার আলোয় ব্যাখ্যা করা হয়। এখানেই প্রস্তাবনার গুরুত্ব আর এজন্যই প্রস্তাবনায় দুটো শব্দ থাকল নাকি ছাঁটা হল, তা নিয়ে তত মাথাব্যথা।
এখন কথা হল, প্রস্তাবনায় যদি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা না থাকে, তাহলে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? সংবিধান বিশারদ সুভাষ কশ্যপ বলছেন, যতদিন ১৪-১৫, ১৯, ২৫-২৮, ৪৯ প্রভৃতি ধারা সংবিধানে আছে, ততদিন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রায়োগিক গুরুত্ব নিয়ে চিন্তান্বিত হওয়ার কারণ নেই। ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা প্রস্তাবনায় জুড়েছে ১৯৭৬-এ। কিন্তু তার আগে থেকেই প্রস্তাবনায় ধর্ম, বিশ্বাস ও উপাসনায় স্বাধীনতার কথা বলা ছিল। সকলের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতার অঙ্গীকার সেখানে ছিল। মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্য এবং সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বর নীতির মাধ্যমে এই অঙ্গীকার সুদৃঢ় করার ব্যবস্থাও ছিল। এজন্যই এস আর বোম্বাই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ‘ধর্মনিপেক্ষ’তা বা ‘সেকুলারিজম’কে সংবিধানের মূল কাঠামোর ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে তুলে ধরেছিল। প্রস্তাবনায় এই শব্দটির অস্তিত্বে বা অনস্তিত্বে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক চরিত্র ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তা সত্ত্বেও নয়া সংসদ ভবনের প্রবেশ লগ্নে সাংসদদের হাতে তুলে দেওয়া ভারতের সংবিধানের প্রথম অসংশোধিত রূপের প্রতিলিপিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা না-থাকার কারণে এত হইচই কেন? আর কেনই বা শব্দটাকে ছেঁটে ফেলার প্রতি এত গৈরিক আগ্রহ?
আরও পড়ুন-তৃণমূল কংগ্রেসে জোর শৃঙ্খলায়, সুসংহত প্রচার ও জনসংযোগ, কর্মসমিতি থেকে একগুচ্ছ কর্মসূচি
কারণ একটাই। প্রস্তাবনা থেকে শব্দটিকে কোতল করে ফেললে সংখ্যালঘুদের শিরদাঁড়ায় ভয় ছড়ানো যায়। তারা এমনিতেই নানা কারণে ত্রস্ত। সেই ত্রাসের মাত্রাটাকে আরও বাড়িয়ে তোলা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোনও দেশের সংবিধানে এই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ থাকার অঙ্গীকার নেই। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, সর্বত্রই রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ধর্মে নিষ্ঠার কথা সংবিধান কর্তৃক মান্যতা প্রাপ্ত। ওই দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের অবস্থা সবারই জানা। ভারতের সংখ্যালঘু এবং সত্যিকার প্রগতিশীল কোনও নাগরিকই নিশ্চয় চাইবেন না এরকম অবস্থা এদেশেও দেখা দিক।
‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি নিয়ে অ্যালার্জি এবং উদ্বেগের কারণ ভিন্ন। বিজেপির গৈরিক আদর্শ রক্তিম সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থিত। সংঘ চিরকালই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার ‘বৌদ্ধিক স্বৈরাচার’ (intellectual autocracy) বিষয়ে সন্ত্রস্ত। তাঁদের গরুর দুধে স্বর্ণ সন্ধান পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে কোনওভাবেই মানানসই হতে পারে না। উভয়ের মধ্যে একটা ‘ধারণাগত ফাঁক’ (understandability gap) থেকেই যায়। সেই ফাঁক থেকেই অ্যালার্জির চারা জন্মায়।
গণ পরিষদে হিন্দু মহাসভা, সমাজতন্ত্রী দল কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি ছিলেন না। সোমনাথ লাহিড়ী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন বটে, তবে দেশবিভাগের কারণে তাঁদের সদস্যপদ হারাতে হয়। ফলে, ৪২তম সংশোধনীর পূর্ববর্তী সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ থাকার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার যেমন ছিল না, তেমনই ‘সমাজতান্ত্রিক’ হয়ে ওঠার জেদি শপথও সেখানে ছিল না। তবু, তবুও, ভারতবর্ষ সমাজতান্ত্রিকতাকে বর্জ্য মনে করেনি। ১৮৯৬-এর ১ নভেম্বর, লন্ডন থেকে লেখা একটি পত্রে এ বিষয়ে বিবেকানন্দের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “আমি একজন সমাজতন্ত্রী, তার কারণ এই নয় যে আমি সমাজতন্ত্রকে একটি ত্রুটিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে মনে করি, তার কারণ এই যে নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল”। (I an a sicalist not because I think it is a perfect system, but half a loaf is better than no bread.) সংবিধানে এই রাজনৈতিক মতাদর্শের ছায়াপাত ঘটেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পথ চেয়ে। প্রস্তাবনা থাকুক কিংবা না-থাকুক, নির্দেশমূলক নীতিসমূহে সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রীতিপক্ষপাত সুস্পষ্ট। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে উৎপাদনের উৎসসমূহে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা কিংবা উৎপাদিত সম্পদের বণ্টনে সমভোগবাদের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারতীয় সংবিধানে সমাজতন্ত্র জায়গা করে নেয়নি। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি এড়িয়ে দেশবাসীর দারিদ্রমোচন এবং ভারতকে প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সংবিধানে সমাজতন্ত্রের ছায়াপাত।
সংবিধান বিষয়ক ইতিহাসবিদ গ্রানভিল অস্টিন দেখিয়েছেন, ১৯২০-র দশকের শেষভাগ থেকে ভারতে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র, উভয় ধারাই প্রবল বেগে প্রবাহিত হতে থাকে। এখন সেটি বাদ দেওয়ার পেছনেও রয়েছে বর্তমান শাসক দলের পাশ্চাত্য থেকে আগত রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সুগভীর অশ্রদ্ধা ও সুস্পষ্ট বিতৃষ্ণা।
আরও পড়ুন-বিরোধীদের চাপে আদানি ইস্যুতে কোণঠাসা, সংসদের দুই কক্ষই মুলতুবি দু’দিনের জন্য
কিন্তু সংবিধান দিবসের ঠিক আগের দিনই এসব বিতর্কে যতি টেনে দিল সুপ্রিম জোট। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ দু’টি বহাল রাখল। উল্লিখিত দুটি শব্দের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়। মামলাকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, সমাজকর্মী বলরাম সিংহ এবংআইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায়। মামলাকারীদের যুক্তি ছিল, ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আসল সংবিধানকে বিকৃত করছে। সংবিধান সভার আলোচনায় সংবিধানের প্রণেতারা এই দু’টি শব্দকে প্রস্তাবনার বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন বলেও দাবি করেন তাঁরা। কিন্তু এই সকল যুক্তি খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত জানিয়েছে সংবিধান সংশোধনীর বিষয়ে সংসদকে ক্ষমতা দিয়েছে সংবিধানই। তা ছাড়া এই দু’টি শব্দ এত বছর ধরে বহু বিচার বিভাগীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে গিয়েছে বলেও পর্যবেক্ষণ শীর্ষ আদালতের। ১৯৯৪ সালের এস আর বোম্মাই মামলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, এই দু’টি শব্দ সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী নয়।
সুতরাং,…