আবেগের ডাল দিয়ে প্রতিবাদের পোস্তবড়া খাওয়ার আয়োজনে কোথাও কোনও ত্রুটি নেই।
সোজা কথায় নারীনির্যাতনের ইস্যু আঁকড়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা চলছেই
দিকে দিকে। রাজ্যে রাজ্যে।
কলকাতায় তরুণী চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটতে না ঘটতেই আরও কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল!
একের পর এক ডবল ইঞ্জিনের রাজ্যে
মেয়েদের উপর অত্যাচারের ঘটনায় লাগাম পরানো যাচ্ছে না। উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্রের পর এবার অসম। নগাঁও জেলার ঢিং এলাকায় দশম শ্রেণির ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠল তিনজনের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার রাতে ওই কিশোরীকে রাস্তার ধারে অর্ধনগ্ন ও অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পান স্থানীয়রা। তাঁরাই পুলিসকে খবর দেন। পুলিস এসে মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে।
আরও পড়ুন-আইএসএলে স্বাগত, নতুন থিম সং আনছে মহামেডান
নির্যাতিতা কিশোরী হিন্দু বলেই ধর্ষককে মুসলমান হতেই হবে। প্রমাণ হয়নি কিছুই। ধরাও পড়েনি কেউ। মেয়েটি রাস্তার ধারে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়েছিল। অল্প জ্ঞান ছিল। কিন্তু, কথা বলায় মতো অবস্থায় ছিল না সে। মেয়েটি শুধু এটুকুই জানিয়েছে, তিন যুবক বাইকে চেপে এসে তার উপর অত্যাচার চালিয়েছে।
তাতে কী!
গত দু’মাসে এনিয়ে ২৩টি নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জানিয়েছেন স্বয়ং অসমের মুখ্যমন্ত্রী।
তাতেই বা কী!
হাইলাকান্দির এক অনুষ্ঠানে বিষয়টিতে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টায় কসুর করেননি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
এই মেয়েটির জাস্টিস নিয়ে মাথা ঘামানো হবে না? কেন হবে না? কিন্তু তার জন্য শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষিত হবে? ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করে অবিরাম মিটিং-মিছিল করবে? সেটা যুক্তিসঙ্গত? যুক্তিসঙ্গত যদি বা হয়, বাস্তবসম্মত? বাস্তবসম্মত যদি বা হয়, সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে স্বাস্থ্যকর?
পুনেতে— স্কুলে যৌননির্যাতনের শিকার এক নাবালিকা। ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পিটি শিক্ষক-সহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিস। একইসঙ্গে স্কুলের প্রিন্সিপালকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পুনের নিগড়ি থানায় নির্যাতিতার পরিবারের তরফে অভিযোগ পাওয়ার পরেই গতকাল অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিভাবকদের দাবি, মূল অভিযুক্ত পিটি শিক্ষক ছাড়াও গ্রেফতার হওয়া অন্য অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন স্কুলের প্রিন্সিপাল ও বোর্ড মেম্বারদের একাংশ। নাবালিকার দাবি, গত ২ বছর ধরে অভিযুক্ত শিক্ষক তাঁকে যৌনহেনস্থা করেছেন। পিটি ক্লাসে নানা অছিলায় তাঁকে অশালীন ভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেন ও বাথরুমের বাইরেও হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল বলে দাবি ওই নির্যাতিতার।
ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পিটি শিক্ষক এর আগেও শ্লীলতাহানির দায়ে পুলিসের কবলে পড়েছেন। তবে তারপরেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে শিক্ষক পদে বহাল রেখেছে।
আরও পড়ুন-সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবি ফারুকের
এই নির্যাতিতা জাস্টিস পাবে না? তার জন্য কারা গলা ফাটাবে? কারা কীভাবে প্রতিবাদে ফেটে পড়বে?
সব ঘটনার ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার চাই।
আমরা আগেও নানা সময়ে ধর্ষকের ফাঁসি চেয়েছি, সেই দাবি মেনে ধর্ষকের ফাঁসি হয়েওছে, দেখেছি। এমনকী, দিল্লির ‘নির্ভয়া’র ঘটনাতেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তাতেও এই ধরনের ঘটনা কিন্তু কমেনি। এই সব ঘটনার মূলে রয়েছে মেয়েদের পণ্য ভাবা ও তাঁদের প্রতি অসম্মানজনক মনোভাব। গোড়া থেকেই একটি শিশু হয়তো দেখে আসছে বাবা ও মায়ের মধ্যে নানা সমস্যা। দেখছে বাবা-সহ বাড়ির সকলে ঠাকুরমা বা মায়ের উপর মানসিক ও শারীরিক পীড়ন চালায়। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুটি ধরে নেয়, বাড়িতে মা কিংবা ঠাকুরমার কথা বা আচরণের কোনও দাম নেই। সেও ছোট থেকেই মেয়েদের হেয় করতে শিখবে। ভবিষ্যতের নানা কাজে তার সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটবে। আইন করে বা কঠোরতম শাস্তি দিয়ে এই অন্যায় প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
প্রতিবাদের মিছিলেও তো ভেজালদের ভিড়। এঁদের মধ্যেও এমন কেউ কেউ আছেন যাঁরা হয়তো অতীতে কোনও না কোনও নারীকে নিগ্রহ করেছেন বা পারিবারিক ক্ষেত্রে নিজের স্ত্রী-বোন বা মেয়ের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এমন দ্বিচারিতাও খুব দুশ্চিন্তার।
কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে? ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার। সমাজের একটা শ্রেণি তাঁকেও নানাভাবে কোণঠাসা করেছে, একঘরে করেছে। সেই কাদম্বিনীদেবী কিন্তু শত সামাজিক লাঞ্ছনার পরেও নিজের প্র্যাকটিস ও পরিষেবা বন্ধ করে দেননি। এমনকী স্বামীর দাহকার্য শেষ হওয়ার আগেই এক সন্তানসম্ভবাকে দেখতে গিয়েছিলেন।
এই মূল্যবোধটা বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি।
মানুষের শুভবুদ্ধির বলয়ই তার অস্তিত্বের শেষ আশ্রয়। একথাটা এই টালমাটাল সময়ে যেন ভুলে না যাই।