পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশ্বাসী
কবিখ্যাতি অর্জনের জন্য অনেকেই মাথা খোঁড়েন। লেখেন গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা। প্রকাশ করেন একটার পর একটা কাব্যগ্রন্থ। কবি হেলাল হাফিজ হেঁটেছেন এর ঠিক বিপরীত পথে। সংখ্যা নয়, শুরু থেকেই গুণগতমানের দিকে ছিল নজর। ফলে লেখেননি বেশি। দীর্ঘ কবিজীবনে তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র তিন। এই পরিমিতিবোধই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল কিংবদন্তি পর্যায়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বাংলা কবিতা ভুবনে প্রবেশ। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লিখে। যদিও কবিতাটি তখনকার কোনও পত্রিকাই প্রকাশ করার সাহস পায়নি। তবে আটকে রাখা যায়নি। আহমদ ছফার মধ্যস্থতায় কবিতাটির প্রথম দুটি চরণ ছেয়ে যায় ঢাকা শহরের দেওয়াল। চরণ দুটি গণ-অভ্যুত্থানকে যেন বারুদের মতো উসকে দেয়। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যান এই কবিতার স্রষ্টা। ভিজতে থাকেন মানুষের ভালবাসায়।
আরও পড়ুন-আগামী সপ্তাহ থেকে ফের চড়বে তাপমাত্রা
অসম্ভব সংযমী
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান স্মরণে আছে অনেকের। সেই সময়কাল থেকে মধ্য আশির দশকের স্বৈরশাসনের মাতাল হাওয়ায় লেখা ৫৬টি কবিতায় কবি অসাধারণ কারুময় শৈল্পিক সত্তা ও নান্দনিকতায় প্রেম, সমকাল ও স্বদেশের পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রেমে এঁকেছিলেন অতীত ও বর্তমানের রূপচিত্র। পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছিল পরিচিত ও অর্থবহ। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে এর পরপরই তিনি হয়ে যান নীরব। অসম্ভব সংযমী ছিলেন। কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও পাঠকের প্রতি অসম্ভব সম্মান না থাকলে কোনো কবি এতটা সংযমী হতে পারেন না। তরুণ বয়সে খ্যাতির মোহ তাঁকে তাঁর কাব্যবিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। তিনি যখন মনে করেছেন বই প্রকাশ করা দরকার, তখনই করেছেন। বাংলা সাহিত্যে এই বিষয়টিও এক বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৬— দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষা শেষে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’।
সজাগ ছিল কবি মানস
তুলনায় অনেক কম লিখেছেন। তবে কবিতার থেকে দূরে থাকেননি কোনোদিন। লিখেছেন নিয়মিত। প্রকাশ করেছেন সামান্য। সব সময়ই সজাগ ছিল তাঁর কবি মানস। পৈতৃক রক্তের দায়বদ্ধতা যাঁর কবিতায়, তিনি তো ফিরবেনই। সুদীর্ঘ ৩৪ বছর পরে ফিরে এলেন স্বমহিমায়। পিতৃদত্ত সেই রক্তের মহান দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে ২০১২ সালে পাঠককে উপহার দিলেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ৭১’। প্রথম বই প্রকাশের জন্য যা সময় নিয়েছিলেন, দ্বিতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে নিলেন তার দ্বিগুণ। তারপর আবার নীরবতা।
আরও পড়ুন-ডাবল ইঞ্জিন যোগীরাজ্যের থেকে শত যোজন এগিয়ে বাংলা : কাফিল
স্রোতের বিপরীতে
ফিরলেন ২০১৯ সালে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’র মাধ্যমে। পরিমিতিবোধের এই কবি স্মার্টফোনের কবিতাকে কাব্যাকারে দুই মলাটবন্দি করেছেন। কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পাঠকের বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু, পড়ার পর সেটা থেকে বেরোনো মুশকিল। একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতে হয়। ইচ্ছে হয় ফিরে পড়তে। পৃথিবী জুড়ে একটা অস্থির সময়। সমাজে হানাহানি, দুর্নীতি, অসহনশীলতা, বিপথগামীতা— সেখানে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে কাব্যগ্রন্থটি। তাঁর কবিতা যতটা কোমল, ততটাই কঠিন। নানা সময় বলেছেন প্রেমের কথা। সেইসঙ্গে বলেছেন বিরহের কথাও। প্রেমও যে প্রতিবাদের একটা ভাষা, দেখিয়েছেন ছত্রে ছত্রে। অর্থাৎ, তাঁর কবিতার মোড়কে যথারীতি প্রণয় আর ভেতরে আগুন-শপথ, প্রতীক্ষা, দেশপ্রেম, নারীপ্রেম ও সমকালভাবনা। তিনি জীবনে কবি, যাপনে কবি। তার সৃষ্ট পঙক্তিমালার মর্ম ও সংবেদন, অন্তর্নিহিত লাবণ্যপ্রভা, নান্দনিক সৌরভ কবিতা প্রেমিকদের অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আলোড়িত করে। দেশপ্রেম, নারীপ্রেম ও সমকাল ভাবনার সূত্র থেকে উৎসারিত তাঁর কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য অনন্য।
এই দেশেও জনপ্রিয়
জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর। পূর্ব বাংলার নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার বড়তলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে করেন এইচএসসি পাস। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে হন বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং পত্রিকার সঙ্গে। অশান্ত সময়ে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কবিতা সাধনার জন্য পেয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার-সহ বেশকিছু পুরস্কার। শুধুমাত্র নিজের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীর বাঙালি কবিতা পাঠকদের কাছে ছিলেন সমাদৃত। এই দেশেও তাঁর জনপ্রিয়তা উল্লেখ করার মতো।
আরও পড়ুন-যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করছে মোদি সরকার, লোকসভায় তোপ দাগলেন সৌগত
থেকে যাবে অমোঘ পঙক্তি
শুক্রবার, ২০২৪-এর ১৩ ডিসেম্বর প্রয়াত হন। দীর্ঘদিন গ্লুকোমায় আক্রান্ত ছিলেন। ঢাকার শাহবাগের এক হোস্টেলে থাকতেন। সেই হোস্টেলের বাথরুমে পড়ে যান। প্রায় ৩০ মিনিট পেরোনোর পরে বাথরুমে তার সাড়াশব্দ না পাওয়ায় হোস্টেলের নিরাপত্তাকর্মীদের সাহায্যে বাথরুমের দরজা ভেঙে অচেতন অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। চলে গেছেন কবি হেলাল হাফিজ। অসংখ্য কবিতার পাশাপাশি থেকে যাবে তাঁর অমোঘ পঙক্তি— ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ এইভাবেই তিনি থেকে যাবেন— প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।