“একটা ব্যথা বর্শা হয়ে মৌচাকেতে বিঁধবে কবে
সারা শহর রক্ত লহর, আশ মিটিয়ে যুদ্ধ হবে”
নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার লাইনগুলো যেন কোভিড-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবাজ পৃথিবীর প্রতীক। কোনও ভয় নেই, কোনও লাগাম নেই, যার আছে ক্ষমতা, যার আছে সৈন্যবল সে জয় করতে চাইছে, নতুন নতুন সীমানা। সেখানের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা শুধুই ‘‘কোল্যাটারেল ড্যামেজ”। সারা বিশ্বজুড়ে অগুনতি ফ্রন্টে যুদ্ধ চলছে, কোথাও দুটো দেশের মধ্যে, কোথাও চারটি দেশের মধ্যে, কোথাও দেশের মধ্যকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবার কোথাও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে। সারা পৃথিবীব্যাপী চলা আর্থিক অসাম্যকেও আর একটা ক্রমাগত যুদ্ধ বলা যেতে পারে বেঁচে থাকার জন্য। এই পটভূমিকায় এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হল জাপানের সংস্থা ‘নিহন হিডানকিও’কে। আসলে নরওয়েজিয়ান নোবেল শান্তি কমিটি এই যুদ্ধবাজ পৃথিবীর প্রতি তাদের নীরব আবেদন আর অসহায়তা প্রকাশ করল হিরোশিমা ও নাগাসাকি পরমাণু বোমায় বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে নিয়ে কাজ করা সংস্থাকে ২০২৪-এর নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে। বিশেষত রাষ্ট্রপুঞ্জের (United Nations) সার্বিক ব্যর্থতার জন্যে পরোক্ষভাবে ক্ষমা চাইল বিশ্ব জুড়ে আজকের দিনে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষাধিক মানুষের কাছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমায় যাঁরা কোনওরকমে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং সারা জীবন ধরে তাঁদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম আণবিক বোমার যে ভয়াবহ রূপ বহন করে চলেছে তাঁদের ‘হিবাকুশা’ নামে জাপানে পরিচিতি। প্রায় লক্ষাধিক বেঁচে যাওয়া মানুষ এই ‘নিহন হিডানকিও’ সংস্থার মাধ্যমে মূল স্রোতে ফিরে আসার চেষ্টা করেছে ও বাঁচছে। এই সংস্থাটি জাপানে যে সমস্ত সংস্থা পরমাণু বিপর্যয় আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করে চলেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আণবিক বোমা নিক্ষেপের পরবর্তীতে, প্রথম পর্যায়ে সারা পৃথিবীতে আমেরিকা তাদের এই ভয়াবহ নৃশংসতার পরিচয় প্রকাশ করতে অস্বীকার করায় জাতিসংঘ ঘটনার প্রায় ত্রিশ বছর পর্যন্ত জাপানের আণবিক বোমায় প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে চেপে ছিল। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি এলাকার বেঁচে যাওয়া অধিবাসীদের সম্পর্কে ভয়ের ধারণা ছিল জাপানের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের মনেও। আণবিক প্রতিক্রিয়া এবং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো।
‘নিহন হিডানকিও’ সংগঠনটি সারা বিশ্ব জুড়ে প্রকৃত তথ্য তুলে আনে ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাটম্যান’-এর ধ্বংসলীলার। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠার সাঙ্গে সঙ্গে সংস্থা বিবৃতি দিয়েছিল— আমরা এখনও পর্যন্ত নীরবে মাথা নিচু করে বেঁচে আছি। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করে ‘হিবাকুশারা’ও যে বেঁচে থাকতে সক্ষম এবং তাঁদের মধ্যে যে আণবিক শক্তির প্রতিক্রিয়া থেকে বাকিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার কোনও ভয় নেই এটা বোঝাতেই সময় কেটে গেছে, পরবর্তী ৩০ বছর। জাতিসংঘ ঘুরতে এসে ১৯৭৬ সালে সংস্থার প্রতিনিধি তুলে ধরেন ধ্বংসলীলার প্রকৃত চিত্র, সংস্থার একসময়ের চেয়ারম্যান সুনাও সুবোই ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে দেখাও করেন। এই ছোট্ট অথচ উন্নত দেশটি আবার ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লিতে বিপর্যয়ের শিকার হয়। এবং পরবর্তীতে অধিকাংশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ আছে। সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব জুড়ে পারমাণবিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার শপথ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের নিতে দেখা, এই উদ্দেশ্য সফল না হলেও তাদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে বিশ্ব জুড়ে চলা যুদ্ধ এবং পারমাণবিক শক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে আরেকবার নোবেল কমিটি স্মরণ করিয়ে দিল রাষ্ট্রনায়কদের।
আরও পড়ুন- এএফসি পরীক্ষায় আজ ভুটান-যাত্রা ইস্টবেঙ্গলের
ইউরোপ জুড়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সময়ে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগের আস্ফালন। রাশিয়ার সর্বাধিনায়ক পুতিন বারবার হুংকার ছাড়ছেন ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের। সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও ইউরোপের ন্যাটো ও আমেরিকার অস্ত্র-সাহায্য প্রায় দু’বছরের বেশি চলা এই যুদ্ধকে টিকিয়ে রেখেছে। ভারত থেকেও যুবক-যুবতীরা কাজের খোঁজে গিয়ে এই দেশগুলির ভাড়াটে সেনা হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য এশিয়াতেও যুদ্ধ এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। প্রতিরক্ষায় বলিয়ান ইজরায়েল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর থেকেই সীমানাবর্তী আরব দেশগুলির সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ, জঙ্গি আন্দোলন, এগুলি চলে আসছেই। গাজাতে নিজেদের প্রতিরক্ষার অজুহাতে আক্রমণ করে এক বছর ধরে প্রায় লক্ষাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে ইজরায়েল। প্যালেস্টাইনের পর আবার লেবানন, সিরিয়া, ইরান প্রত্যেক দেশে হামলা করে তারা মধ্যপ্রাচ্য এশিয়া জুড়ে বছরভর যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে ইজরায়েল। আফগানিস্তান ও ইরাকে আমেরিকার ব্যর্থ আক্রমণ ও শাসনের পরে দেশগুলি আবার ফিরে গেছে ধর্মীয় শাসকদের হাতে, সীমিত হয়েছে মানুষদের স্বাধীনতা। আমাদের পাশের দেশ বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধের শিকার হয়ে এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে চলছে। বিভিন্ন ছোট দেশগুলিতে পৃথিবীব্যাপী চিনের আর্থিক ফাঁস দুর্বিষহ করে দিয়েছে অর্থ ব্যবস্থা। এছাড়াও গোটা আফ্রিকা জুড়ে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর তাণ্ডব নিজেদের মধ্যে খাবারের জন্য লড়াই এবং সর্বোপরি সারা বিশ্বের শান্তিরক্ষার জন্য গঠিত জাতিসংঘের ‘নিধিরাম সর্দার’ হয়ে যাওয়া এই বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে সময় লেগেছিল কুড়ি বছরের মতন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হওয়া লিগ অফ নেশনস ব্যর্থ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনায়কেরা সারা বিশ্ব জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের বা ইউনাইটেড নেশনের (United Nations)। তারপরে প্রায় আশি বছরের বেশি সময় কেটে গেছে পৃথিবী বারবার রক্তাক্ত হয়েছে কিন্তু কোনও বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক আশা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের বয়স আশি পেরিয়ে গেছে। আজকের দিনে ১৯৫টি সার্বভৌম দেশ এই ইউনাইটেড নেশনস-এর সদস্য হলেও ক্ষমতা হারিয়ে শুধু ত্রাণকার্যে সীমিত হয়ে গেছে সংস্থাটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একক শক্তিশালী আমেরিকাকে রাশিয়া কিছুটা বেগ দিলেও সরাসরি বিশ্বের দাদাগিরির দায়িত্ব আমেরিকার হাতেই থেকেছে আজ পর্যন্ত। তারপর রাশিয়া ভেঙে যাওয়ায় আরও মজবুত হয়েছে বিশ্ব জুড়ে আমেরিকার প্রভাব কিন্তু উদার অর্থনীতির হাত ধরে চিনের উন্নতি এবং কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে প্রায় সর্বাধিক ক্ষমতাশালী দেশে পরিণত হয়ে যায় চিন। চিনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক নতুন অক্ষশক্তি যে শক্তি সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়েও কাজকর্মের মধ্যে পরিষ্কার করে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির দেশগুলির প্রতি তাদের অসূয়া।
এই অবস্থায় অসহায়ের মতো রাষ্ট্রপুঞ্জের (United Nations) দশা দেখে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থার লজ্জা নিবারণে এগিয়ে এসেছে নোবেল কমিটি। নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০২৪-এ আরেকবার বিশ্বের অমিত শক্তিধর দেশগুলিকে মনে করিয়ে দিয়েছে পরমাণু বোমার ভয়াবহতা। বিশ্বজুড়ে শান্তি স্থাপন এবং আরেকটা পরমাণবিক হামলার হাত থেকে রক্ষার জন্য এই পুরস্কার নিজেদের মনে করিয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রগুলি বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র । হিবাকুশার দুর্দশা অকল্পনীয়, কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত হাজার অসুবিধা সত্ত্বেও, সমাজ তাদের দূরে সরিয়ে রাখা সত্ত্বেও, তাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের ক্ষতি এবং বেদনার সঙ্গে বিশ্বকে পরিচিত করার জন্য যাতে সাধারণ মানুষ এবং ক্ষমতার শীর্ষে থাকা রাষ্ট্রনায়কেরা বুঝতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ আসলে গভীর ধ্বংসযজ্ঞ। এই সংস্থা আজ সত্তর বছর ধরে সেই ক্রুসেড বিশ্ব জুড়ে প্রচার করেছে, তারই ফলশ্রুতি এই ‘নিহন হিডানকিও’কে নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল কমিটি যেন বলতে চাইল—
‘যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল,
যত অশ্রুজল, যত হিংসা হলাহল,…
মাথা করো নত। এ আমার এ তোমার পাপ’…।