যুবসমাজের নেশামুক্তির নায়ক হারবার্ট ডেভিড ক্লেবার

১৯৩৪ সালে জন্মানো এই বিজ্ঞানী একজন ইহুদি। বাবার ছিল সামান্য ব্যাগ তৈরির ব্যবসা। কিন্তু ফার্মাসিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

Must read

ভাস্কর ভট্টাচার্য: কেমনভাবে জীবনকে দেখলে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা যায় অন্যের জন্য? হারবার্ট ক্লেবার ঠিক সেই ভাবেই দেখেছিলেন। অনুভব করেছিলেন নিজের জীবন দিয়ে। সেই থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমেরিকার সমাজের প্রান্তে প্রান্তে মাদকাসক্ত রোগীদের সুষ্ঠু জীবন ফিরিয়ে দিতে। যেমন ভাবে ফিয়োদর দস্তয়ভস্কি কুৎসিত কারাগারের জীবন দেখে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে লিখেছিলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ সহ সব লেখা। হারবার্ট ডেভিড ক্লেবারও যেন তাইই। হয়ে উঠেছিলেন নেশামুক্ত এক সমাজ গড়ার পথিকৃৎ। গোটা আমেরিকা কেন, বিশ্বের নানা প্রান্তে এই বিজ্ঞানী চিকিৎসকের নাম আজ।

আরও পড়ুন-এক শ্রমিক সংগঠন, সুপারিশ ঋতব্রতর

একদিকে মা তখন উদ্বাস্তু ইহুদিদের ত্রাণের জন্য টাকা সংগ্রহ করছেন, ছেলে তখন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছেন। বাবা ছিলেন একজন সামান্য ব্যাগ ব্যবসায়ী ও ফার্মাসিস্ট চিকিৎসা কর্মী। ছেলের স্বপ্ন, সাধারণ মানুষদের চিকিৎসক হবেন। কোনওদিনই ভাবেননি, একজন প্রথম সারির মনোবিদ হয়ে উঠবেন।

১৯৬৪ সালে ডাক্তারি পাশ করে যখন চিকিৎসা শুরু করবেন, তখন তাঁকে পাঠানো হল সেইসব মানুষদের চিকিৎসা করতে। প্রথমে হতাশ হলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে এইসব নেশাসক্ত মানুষদের উন্নতিকল্পেই গোটা আমেরিকা জুড়ে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং নেশামুক্ত আমেরিকার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

প্রথম চিকিৎসার হাতেখড়ি বা তাঁকে যেখানে পাঠানো হল সেটা ছিল একটা প্রিজন হসপিটাল। কুখ্যাত মাদক খামার। যেখানে মাদকাসক্তদের শুধু চিকিৎসা করা হয়। এই মাদক খামারে ক্লেবার রোগী হিসেবে পেয়েছিলেন অভিনেতা পিটার লোর, জাজ বাদক চেক বেকার এবং বিট লেখক উইলিয়াম এস বুডোস-এর মতো খ্যাতনামা প্রতিভাদের। কয়েক হাজার বন্দি। সবাই নেশায় আসক্ত বা অপরাধে বন্দি।

আরও পড়ুন-Kangana Ranaut: কমিশনের আর্জি

তাঁদেরই সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার দায় পড়ল। এই কারাগারেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে লেখক বুডোস লিখেছিলেন তাঁর পৃথিবীখ্যাত উপন্যাস ‘জাঙ্কি’। কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে ফিয়োদর দস্তয়ভস্কির সঙ্গে লেখক বুডোস- এর অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে যেন নেশায় পেয়ে বসল বিজ্ঞানী ক্লেবারকে। নেশাগ্রস্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দিতেই হবে। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি কখনওই আশাহীন না। অবশ্যই আশাবাদী।’’ এই আশা নিয়েই তিনি রোগমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখে গেছেন।

সঙ্গে পেয়েছিলেন স্ত্রী মারিয়ান ফিচম্যানকে। ক্লেবার, যিনি আসক্তিকে নৈতিক ব্যর্থতার বিপরীতে একটি চিকিৎসা অবস্থা হিসাবে দেখেছিলেন, তাঁর নার্সিং পদ্ধতিকে ‘প্রমাণ-ভিত্তিক চিকিত্সা’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। রোগীদের শাস্তি বা লজ্জা দেওয়ার পরিবর্তে, ক্লেবার সতর্কতার সঙ্গে ওষুধ এবং থেরাপিউটিক সম্প্রদায়গুলিকে রোগীদের পুনরুদ্ধারের পথে থাকতে এবং পুনরায় সংক্রমণ এড়াতে সহায়তা করতেন।

আরও পড়ুন-Sabrimala Temple: আজ থেকে খুলছে শবরীমালা মন্দির

১৯৯২ সালে, ক্লেবার, তাঁর স্ত্রী মারিয়ান ফিশম্যানের সঙ্গে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের মধ্যে, এই ধরনের অপব্যবহারের চিকিৎসার জন্য দেশের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র পদার্থ অপব্যবহার বিভাগ সহ-প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ডিভিশনের পরিচালক ছিলেন এবং কোকেন, হেরোইন, প্রেসক্রিপশন ওপিওড, অ্যালকোহল বা গাঁজা আসক্তিযুক্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সার জন্য নতুন পদ্ধতির উপর বেশ কয়েকটি প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন। তিনি জোসেফ ক্যালিফানোর সঙ্গে কলম্বিয়ার আসক্তি এবং পদার্থ অপব্যবহারের জাতীয় কেন্দ্রের সহ-প্রতিষ্ঠা করেন।

মানসিক চিকিৎসায় এক নতুন পদ্ধতি প্রণয়ন করেছিলেন, যেন এক চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত। কোকেন, মারিজুয়ানা, হেরোইন, অ্যালকোহলের মতো নেশাসক্তদের চিকিৎসায় এনেছিলেন অভিনবত্ব। সেই সঙ্গে ১৯৯৬ সালে ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিনয়-এর ন্যাশনাল অফ সায়েন্সের সদস্য হয়েছিলেন। ফোর্ড ইনস্টিটিউট সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সম্মানজনক পদে নিযুক্ত থেকে নেশাসক্তদের চিকিৎসা করে গেছেন। আড়ইশোর মতো গবেষণাপত্রের লেখক বা সহায়ক প্রণেতা তিনি।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ক্লেবার নিউইয়র্কের ‘সেরা ডাক্তারদের একজন’ হয়ে উঠেছিলেন। অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ সম্মান পেয়েছেন জীবনের নানা কাজের স্বীকৃতি হিসেবে।
অনেকেই অনাগ্রহী ছিলেন এই চিকিৎসার প্রতি। কিন্তু হাল ছাড়েননি ক্লেবার। যেন পথ প্রদর্শকের কাজ করে গেছেন। আজকের দিনে তাঁকে বারবার স্মরণ করেন সবাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশ-এর আগ্রহেই ড. ক্লেবার ১৯৮৯ সালে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ স্লোগান তুলেছিলেন। জিমি কার্টারের আমলে নেশা ও মাদকাশক্তি ন্যাশনাল সেন্টার খুলেছিলেন।

১৯৩৪ সালে জন্মানো এই বিজ্ঞানী একজন ইহুদি। বাবার ছিল সামান্য ব্যাগ তৈরির ব্যবসা। কিন্তু ফার্মাসিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তাঁরই সন্তান হারবার্ট ডেভিড ক্লেবার। ক্লেবার আমেরিকায় মাদকের চিকিৎসায় দেশের শীর্ষ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। ডেপুটি ডিরেক্টর হয়ে হোয়াইট হাউস-এর ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল পলিসি তৈরি করেছিলেন। একজন সামান্য ইহুদি সন্তান থেকে বিশ্বের অন্যতম একজন মনোরোগ চিকিৎসক হয়ে ওঠার অনন্য নজির এই বিজ্ঞানীর। পিটসবার্গের এই বিজ্ঞানী চিকিৎসক প্রয়াত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে।

Latest article