৩০ ডিসেম্বর ২০২৪। ন্যায়, বিজয় এবং নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দিন হয়ে রইল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবদন্তি অভিনেত্রী বিনোদিনীদাসীর অবদানকে স্বীকৃতি দিলেন, যা করার কথা ছিল ১৪১ বছর আগেই। এই দিনটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারের নতুন নামকরণ করা হল— বিনোদিনী থিয়েটার।
আজ যদি ঊনবিংশ শতকের রঙ্গমঞ্চের সেরা অভিনেত্রী নটী বিনোদিনী বেঁচে থাকতেন, তবে তিনিই সবচেয়ে খুশি হতেন। আনন্দিত হতেন ঠাকুর রামকৃষ্ণও। মঞ্চের নাম নিয়ে অভিনেত্রীর অভিমান ছিল। গুর্মুখ রায় থিয়েটার প্রতিষ্ঠায় বিনোদিনীর নাম রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখনকার কর্তাব্যক্তিরা রাজি হননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, “গণিকার মেয়ের নামে থিয়েটার কেন?” এক পর্যায়ে সেই থিয়েটারের নাম রাখা হল স্টার থিয়েটার।
আরও পড়ুন-অমিল ট্রেন, পর্যটকদের জন্য বাস এনবিএসটিসির
বিনোদিনী এই সিদ্ধান্তে আঘাত পেয়েছেন, কেঁদেছেন এবং এ হেন প্রতারণায় তিনি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করেছিলেন বটে, কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি। আজ, বহু বছর পর, তাঁর নাম ফিরে এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। নাট্যমঞ্চের নামের পরিবর্তন ঘটল, যা ছিল তাঁর প্রাপ্য। দেরিতে হলেও ন্যায়বিচার আসে। মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে এই বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।
এই বৃত্তে আর এক বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা না বললেই নয়, যিনি মঞ্চের নতুন নামকরণের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু। তাঁর লেখা অদামৃতকথা-য় ঊনবিংশ শতকের রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস আছে। বাংলা রঙ্গমঞ্চের পাঁচ প্রখ্যাত অভিনেত্রী— গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী ও প্রভাদেবীর মধ্যে বিনোদিনীকে ব্রাত্যবাবু ‘দুর্মূল্য মরকতখণ্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘মেঘনাদবধকাব্য’-এ একাই সাতটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্রাত্যবাবুও তন্নিষ্ঠ।
ঊনবিংশ শতকের ওই সময়টি ছিল কলকাতার থিয়েটারের স্বর্ণযুগ। একদিকে উত্তর কলকাতা, অন্যদিকে পশ্চিম কলকাতায় চলছে সংস্কৃতির চর্চা। বিনোদিনীর সময়কালে রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ-র পরিখানা (অধুনা বিএনআর)-য় মঞ্চস্থ হচ্ছে একের পর এক থিয়েটার। গানবাজনা আর নাচ রয়েছে সঙ্গে। মালকা জান (গহরজানের মা)-এর মতো শিল্পীরা গাইছেন। যদু ভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী, ধীরেন্দ্রনাথ বসু, শ্যামলাল চক্রবর্তী আর সাজ্জাদ মহম্মদরা আসছেন নিয়মিত। পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির লোকজনও মেটিয়াবুরজ আসতে শুরু করেছেন।
২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৪, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরিকল্পনা করেছিলেন থিয়েটার দেখতে যাবেন। ভক্তরা সবাই এই পরিকল্পনা মেনে নিতে পারছিলেন না, কারণ সেই সময়ের বেশ্যারা অভিনয় করতেন। ঠাকুর বলেছিলেন, “আমি তাদের মা আনন্দময়ী দেখব, তারা চৈতন্যদেব সেজেছে, তা হলেই বা। শোলার আতা দেখলে সত্যিকারের আতার উদ্দীপন হয়।”
ঠাকুর ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে গিয়েছিলেন। বিনোদিনী শুনে থিয়েটারের কুশলীদের বলেছিলেন, “আমাদের জন্মের দোষ আছে, আমাদের কেউ ডাকবে না রে।” অভিনয় চলাকালীন ঠাকুর বিনোদিনীকে পুরুষ ভেবেছিলেন, তবে পরে জানতে পারেন যে তিনি ছিলেন বছর বাইশের এক তরুণী। অভিনয়ের পর, যখন বিনোদিনী মেকআপ তুলছিলেন, তখন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়। তিনি দরজা খুলে দেখেন হাস্যোজ্জ্বল ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে দেখে ঠাকুর বলেন, “কি দেখলাম গো, আসল নকল সব এক হয়ে গেল।” বিনোদিনী প্রণাম করতেই ঠাকুর বললেন, “বলো মা, গুরু হরি, হরি গুরু।” অভিনেত্রীর মাথায় হাত রেখে ঠাকুর আশীর্বাদ করলেন। বললেন, “তোমার চৈতন্য হোক।” সেদিন বিনোদিনীর মনে হল, অনন্ত আনন্দ ভিতর থেকে উৎসারিত হচ্ছে। বাড়ি ফিরে বিনোদিনী শুধু আনন্দ অনুভব করেছিলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণার পরে আজ বিনোদিনীর আত্মার আনন্দের শেষ নেই। তিনি হয়তো গিরিশ ঘোষকে বলছেন, “মাস্টারমশাই, আমার নামে থিয়েটার হলো কলকাতায়।” তিনি হাসতে হাসতে এও বলছেন হয়তো বা, “ও অমৃতবাবু, শুনেছ? আমার নামে থিয়েটার।” আনন্দ, শুধুই আনন্দ। বিনোদিনী অনুভব করছেন, সামনে ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন, “মা, তোমার চৈতন্য হোক।” ঠাকুর রামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৮৮৬ সালের আগস্ট মাসে। ওই বছরেই, ডিসেম্বর মাসে অভিনয় ছেড়ে দেন বিনোদিনী। যখন ঘোড়ার গাড়ি স্টার থিয়েটার (অধুনা বিনোদিনী থিয়েটার) থেকে বের হচ্ছিল, তখন রাস্তা ছিল ফাঁকা, আকাশে তারারা সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অভিনয়ের জগৎ থেকে বুকে একরাশ অভিমান নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি, মাত্র ২৪ বছর বয়সে।
আরও পড়ুন-অমিল ট্রেন, পর্যটকদের জন্য বাস এনবিএসটিসির
স্টার থিয়েটার নিয়ে নটী বিনোদিনী লিখেছেন, ‘‘আমি জানিতাম যে আমারই নামে ‘নাম’ হইবে! কিন্তু যেদিন উহারা রেজিস্ট্রি করে আসিলেন— আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘থিয়েটারের নতুন নাম কী হইল?’ দাসুবাবু প্রফুল্লভাবে বলিলেন, ‘স্টার।’ এই কথা শুনে আমি দুই মিনিট কথা কহিতে পারিলাম না।’’
বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘‘থিয়েটার যখন প্রস্তুত হয়, তখন সকলে আমায় বলেন, ‘এই থিয়েটারটি তোমার নামের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাতে তোমার মৃত্যুর পরও তোমার নাম বজায় থাকবে।’’ তখন ঠিক হয়েছিল প্রেক্ষাগৃহের নাম হবে ‘বি থিয়েটার’। এই কথাটি শুনে বিনোদিনী উৎসাহিত হন। গিরিশচন্দ্র ঘোষের অনুরোধে তিনি তাঁর ভক্ত গুর্মুখ রায়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন এবং সেই টাকা দিয়ে স্টার থিয়েটারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সে সময় বিনোদিনীর মনে হয়েছিল, ‘‘উঁহারা কি শুধু আমায় মুখে স্নেহ ও মমতা দেখিয়ে কাজ শেষ করলেন? কিন্তু কি করব, আমার আর কোন উপায় ছিল না!’’ ‘প্রতারিত’ বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘‘আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে, তাঁরা ছলনার মাধ্যমে আমার সঙ্গে এমন অসৎ আচরণ করবেন।’’
আরও পড়ুন-দুর্ঘটনায় আহত ১৮ ফুটবলার
সেই ছলনা, প্রতারণা শেষ হল। স্টার থিয়েটারের এই নাম বদল নিছক পরিবর্তন নয়। যেসব নারীকে সমাজ মনে করে ‘অচ্ছুৎ’, তাঁরা যেন ন্যায়বিচার ফিরে পেলেন মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণায়। একই সঙ্গে বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসকেও তিনি উসকে দিলেন নবীন প্রজন্মের কাছে। ইতিহাস, ন্যায় ও আধুনিকতার পুনর্জন্ম হল যেন।