সৌদামিনী কেতকী
কবিগানের সেরা গায়ক ভোলাময়রা। উঠতি এক ফিরিঙ্গি কবিয়ালের কবি হওয়ার ইচ্ছাকে নস্যাৎ করে কবিগানের আসরে ভোলা ময়রা গাইলেন:
‘তুই জাত ফিরিঙ্গি জবর জঙ্গি পারব নাকো তরাতে, শোনরে ভ্রষ্ট, বলি স্পষ্ট, তুই যে নষ্ট মহা দুষ্ট। তোর কি ইস্ট কালী কেষ্ট, ভজকে যা তুই যিশুখ্রিস্ট শ্রীরামপুরের গির্জেতে।’
আরও পড়ুন-সুগন্ধি
দমবার পাত্র নন ফিরিঙ্গি কবি। তিনি বললেন: ‘খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এ কথা শুনি নাই।’ তিনি হলেন অ্যান্টনি কবিয়াল। কবিয়াল হিসেবে সর্বদা তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর স্ত্রী সৌদামিনী। এই নিয়ে জমজমাট নাটক ‘এন্টনী কবিয়াল’। তিনটি মুখ্য চরিত্রের শিল্পী জহর গঙ্গোপাধ্যায় (ভোলা ময়রা), কেতকী দত্ত (সৌদামিনী), সবিতাবব্রত দত্ত (এন্টনী কবিয়াল)। এটি মঞ্চস্থ হচ্ছে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে। কিন্তু মানিকতলার খালপাড়ের ওই মঞ্চে কে নাটক দেখতে যাবেন? সেই পথ বার করলেন কেতকী দত্ত। গভর্নমেন্ট বাস যার একটা যাবে সাউথ ক্যালকাটা, আরেকটা যাবে হাওড়া, অপরটা যাবে নর্থ ক্যালকাটা। তিনটে বাস তিনটে রুটে যাওয়ায় বন্দোবস্ত করা হল।
আরও পড়ুন-বিশ্বভারতীর উপাচার্যের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ
খালপাড়ের মঞ্চ, মশার ডিপো। দর্শকদের মশা কামড়ালে কেউ কি আসবে? কেতকী অন্যদের নিয়ে স্প্রে করে মঞ্চ বন্ধ করে রাখতেন। শো-এর ঠিক আগে মঞ্চ খুলে দেওয়া হত। এই নাটক শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর। সকলের মধ্যে একটা স্পিরিট কাজ করত। নইলে জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো দুর্ধর্ষ নট কাউন্টারে বসে বসে টিকিট বিক্রি করতেন? প্রথম দুটো দৃশ্যে তাঁর চরিত্রের প্রবেশ ছিল না। তারপর যখন তিনি ঢুকতেন আর ওই বৃদ্ধ বয়সে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গাইতেন :
‘আমি সেই ভোলানাথ নই আমি সে ভোলানাথ নই’ তখন দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতেন।
শিল্পীর অভিনয়-মুগ্ধ প্রখ্যাতরা
‘এন্টনী কবিয়াল’ সেই সময় কে না দেখেছেন? সবার আগে উল্লেখ করার মতো নাম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। তিনি এলেন। তাঁকে সংবর্ধিত করা হল। দেখলেন এই নাটক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এছাড়া এই নাটক দেখে গিয়েছেন উত্তমকুমার, কিশোরকুমার, কানন দেবী, তৎকালীন রাজ্যপাল ধর্মবীর, বেলুড় মঠের অধ্যক্ষ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজির মতো স্মরণীয় মানুষেরা।
আরও পড়ুন-বেনজির পরিস্থিতি ত্রিপুরা বিধানসভায়, সাসপেন্ড হলেন ৫ বিরোধী বিধায়ক
লতার দীর্ঘ লাঞ্ছনা
মুখ্যত নাটকের পেশাদার শিল্পী হলেও, আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছেন বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারে। চতুর্মুখ গ্রুপ থিয়েটারের সদস্যপদ নিয়েছিলেন। এই চতুর্মুখের প্রযোজনায় ১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট প্রতাপ মঞ্চে শুরু হল ‘বারবধূ’ নাটক। নাট্যরূপ দিলেন পরিচালক অসীম চক্রবর্তী। নায়ক প্রসাদের চরিত্রে তিনি। আর নায়িকা লতার চরিত্রে অভিনয় করলেন কেতকী দত্ত। বিতর্কের মধ্যে পড়েছিলেন কেতকী দত্ত। কারণ নাটকের প্রথম দৃশ্যে শুধু একটা অন্তর্বাস আর সেমিজ পরে প্রসাদের সঙ্গে যৌনদৃশ্যে অভিনয় করছেন। গোড়ার দিকে বিক্রি ভাল ছিল না নাটকটির। একদিন হঠাৎ করে অসীম চক্রবর্তীর মাথায় এক পাবলিসিটির নতুন চমক এল। দিলেন ‘ভালোবাসার ব্লো হট নাটক’। ব্যস, বিক্রি বাড়তে বাড়তে রোজ হাউসফুল। ১৮০০ রজনী অভিনীত হয়ে এ-নাটক একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সবাই কেতকীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অসীম চক্রবর্তীর মনে কমপ্লেক্স গ্রো করতে শুরু করল এবং তখন তিনি মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার শুরু করলেন কেতকী দত্তের ওপরে। স্টেজের উপরে পর্যন্ত মানসিক অত্যাচার করতেন। হাত দুটো অসীম এমনভাবে ধরতেন যে পাঁচটা আঙুলের ছাপ পড়ে যেত। শোয়ের শেষে যেই লাইট অফ হত, মুখটা অসীম নিয়ে আসতেন কেতকীর কাঁধের কাছে। জোরে কামড় বসিয়ে দিতেন। রেগে অসীম বলতেন, ‘‘যদি চরিত্রটা না দিতাম কে চিনত কেতকী দত্তকে?’’ চুপ করে থাকতে পারতেন না কেতকী। তিনি বলতেন, ‘‘শোনো তুমি ভুল বললে, কেতকী দত্তকে অনেকে চেনে। তোমার বারবধূ থেকে কেতকীকে চেনে না, এন্টনী কবিয়ালের কেতকী দত্তকে চেনে।’’
আরও পড়ুন-এজেন্টরা যা করবেন
চলচ্চিত্রে যোগ
পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের পাশাপাশি বহু ছবিতে কেতকী দত্ত অভিনয় করেছেন। তাঁর প্রথম ছবি দৃষ্টিদান (১৯৪৮)। এছাড়া তিনি অভিনয় করেছেন বঞ্চিতা, কৃষ্ণা কাবেরী, যার যেথা ঘর, সহোদর, সঞ্চারী, কঙ্কাল, পাত্রী চাই, গোপাল ভাঁড়, রাখী, মানরক্ষা, ত্রিযামা, কংস, নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে, দেবর্ষি নারদের সংসার, হসপিটাল, ডাইনি, সরি ম্যাডাম, বিপাশা, বন্ধন, উত্তরায়ণ, রাধাকৃষ্ণ, কে তুমি, একটুকু বাসা, পদিপিসীর বর্মী বাক্স, হার মানা হার, বনপলাশীর পদাবলী, অসাধারণ, নাগরিক, সুবর্ণলতা, করোটি, শ্রীমতী হংসরাজ, সতী প্রভৃতি ছবিতে।
আরও পড়ুন-রাজ্যপালের ভাষণ! লঙ্ঘিত নির্বাচনবিধি
পেশাদারি মঞ্চে অবস্থান
বাবা তারাকুমার ভাদুড়ী মা প্রভা দেবী, এঁরা দু’জনেই জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী। ছোট থেকেই নাটক-অভিনয়ের পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। সংগীতে তালিম নিয়েছেন রঞ্জিত রায়, বিজয়কৃষ্ণ দাস, ললিত গোস্বামী, দুর্গা সেন, অনিল বাগচীর কাছে। এক সময় মায়ের হাত ধরে তিনি শিশু অভিনেত্রী হিসেবে শ্রীরঙ্গমে প্রবেশ করেন। তুলসী লাহিড়ীর ‘মায়ার সংসার’ নাটকে তিনি শিশু চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মঞ্চে তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শৈলেন চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলি প্রমুখ বিখ্যাত অভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। মুখ্যত পেশাদার শিল্পী হলেও আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছেন ‘শ্রীমঞ্চ’, ‘চতুর্মুখ’ প্রভৃতি গ্রুপ থিয়েটারে। পরবর্তীকালে তিনি স্টার থিয়েটার, রঙমহল থিয়েটার, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ, প্রতাপ মঞ্চ থেকে শুরু করে বহু মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। রঙমহলে টানা সাত বছর কাজ করেছেন। সেখানে ‘মায়ামৃগ’ নাটকে অভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ওই নাটক চলাকালীন প্রেক্ষাগৃহে গোলযোগ দেখা দিলে শুরু হয় শিল্পীদের আন্দোলন। কেতকী দত্ত আঁতুড়ের বাচ্চা নিয়ে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বহুদিন রাত কাটিয়েছেন হলের সামনে বসে।
আরও পড়ুন-বেলডাঙায় খুন তৃণমূল কর্মী, নন্দীগ্রামে অপহৃত দলীয় প্রার্থী
রকমারি পরিচয়
কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে এছাড়াও অভিনয় করেছেন নটী বিনোদিনী, দয়াল অপেরা প্রভৃতি নাটকে। মিনার্ভা থিয়েটার ভাড়া নিয়েছিলেন ইচ্ছামতো নাটক করবেন বলে। কিন্তু ওখানকার কর্মীরা তাঁকে ঢুকতেই দেননি তিনি অপসংস্কৃতির চর্চা করবেন এই অভিযোগে। বাংলা নাটকে গানের সঠিক গায়কির তিনি একজন বিশিষ্ট শিল্পী। স্বতন্ত্রভাবে পুরনো বাংলা নাটকের গানের অনুষ্ঠান করতেন। মাঝে মাঝেই বেতারে, যাত্রায়, দূরদর্শনেও তিনি অভিনয় করেছেন। নৃত্য শিক্ষা করেছেন ললিত গোস্বামীর কাছে। বিয়ে করেছেন মদন দত্তকে। দুই পুত্র, তিন কন্যার জননী তিনি। কেতকীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ৯ জুলাই আর মৃত্যু ২০০৩ সালের ৮ জুলাই। জীবনসায়াহ্নে তিনি উষা গাঙ্গুলিদের রঙ্গকর্মীদের ‘মুক্তি’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। বহু পুরস্কারে তিনি ধন্য হয়েছেন। রবীন্দ্রভারতী এবং পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি তাঁকে সম্মানিত করেছেন।