শিখ ধর্মের অভ্যুত্থান এবং প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

ভক্তি আন্দোলন শিখ ধর্মকে প্রভাবিত করেছিল। তবে শিখ ধর্ম আন্দোলনে সরাসরিভাবে যুক্ত ছিল না। মোঘল আমলে শিখ ধর্ম সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিখরা স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন দেশ ভাগের। ৮ নভেম্বর গুরুনানক জয়ন্তী। দিনটি মনে রেখে লিখলেন মণিশংকর মণ্ডল

Must read

১৫ এপ্রিল ১৪৫৯। পাকিস্তান— বর্তমান পাঞ্জাবে তৎকালীন মোঘল সাম্রাজ্যে যে বালক শিশুটি একটি হিন্দু পরিবারে আবির্ভূত হন, তিনি হলেন মহাপুরুষ গুরুনানক। নানকের বাবা-মা দুজনেই হিন্দু ক্ষত্রিয় পরিবারের থেকে আগত এবং তাঁর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। তিনি প্রথম দশজন শিখগুরুর মধ্যে একজন শিখগুরু। তিনি প্রথম সিকিমে শিখগুরু হিসাবে আবির্ভূত হন। তিনি পুরো এশিয়া ভ্রমণ করেছেন এবং এক ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেছেন। সাম্য, মানুষের প্রতি প্রেম-ভালবাসা, ভাল মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা— সবই তাঁর এই অমূল্য বাণী ৯৭৪টি কবিতায় ‘গ্রন্থ সাহেব’-এ লেখা আছে, যা শিখদের ধর্মগ্রন্থ নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন-অনবদ্য চারটি সাহিত্য পত্রিকা

একুশ শতকের প্রথম দিকে শিখ ধর্মের জনসংখ্যা ছিল ২০.৮ মিলিয়ন যা ভারতবর্ষের জনসংখ্যার মাত্র ১.৭২%। গোটা পৃথিবী জুড়ে শিখের বসবাস ২৫-৩০ মিলিয়ান যার ৮৩.২-৮৪.১% আমাদের দেশেই। এই ধর্ম নবীনতম ধর্ম হিসাবে পরিগণিত হয় এবং এই ধর্মের দ্রুত গতিময়তায় বর্তমানে এটি পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লুইস ফেনেক-এর মতে, এই ধর্ম সন্ত রীতি থেকে ভক্তিতে উত্থাপন করে। এই জন্যই আমরা ধারণা করতে পারি ভক্তি আন্দোলন শিখ ধর্মকে প্রভাবিত করেছিল। এই আন্দোলন শিখ ধর্মকে প্রভাবিত করলেও শিখ ধর্ম সরাসরিভাবে যুক্ত ছিল না। ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ কবীর, রবিদাসের কিছু মত, এই শিখ ধর্মাবলম্বীরা অসম্মতি জানায়। মোঘল সাম্রাজ্যের সময়কালে শিখ ধর্ম প্রাথমিকভাবে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার লাভ করে। একজন শিখের সাধু এবং সিপাহি দুই মনোভাবই পোষণ করতে হবে। গুরু আর্জন মারা যাবার পর তাঁর ছেলে গুরু হরগোবিন্দ শিখ ধর্মের ষষ্ঠ শিখগুরু হন।

আরও পড়ুন-আজ ফিরহাদের সভা ঘিরে প্রস্তুত জঙ্গিপুর

এই গুরুর সময়কালে এই ধর্মটি রাজনৈতিক এবং সামরিক পরিচিতি পায়। শিখ-কাহিনি অনুযায়ী, গুরু হরগোবিন্দের পিতার নির্দেশ ছিল সামরিক বাহিনী গঠন করার যা তাঁদের ধর্মকে রক্ষা করবে। ১৬৪৪ সালে গুরু হরগোবিন্দ তাঁর প্রপুত্রকে শিখগুরুর মর্যাদা দিয়ে যান। মোঘল সম্রাট সাহজাহান তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দ্বারা শিখ ধর্মের অবলুপ্তি কাম্য করেছিল। গুরু তেগবাহাদুর ১৬৬৫ সালে শিখগুরু হওয়ার পর কাশ্মীরি পণ্ডিত আর অ-মুসলিম মানুষজনকে বলপূর্বক মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করানোতে বাধা দেওয়ায় মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ১৬৭৫-এ শাস্তিস্বরূপ তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করেন। ১৬৯৯-এ গুরু গোবিন্দ সিং সমস্ত শিখদের নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করে নাম দেন ‘খালসা’। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাঁদের ধর্মকে টিকিয়ে রাখা। সতেরোশো শতকে শিখ ধর্মের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি লাভ করে।
ব্রিটিশ অবস্থানকালীন সময়ে শিখদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন থাকলেও শিখদের অন্যতম প্রতিনিধি রাজা রণজিৎ সিং চেয়েছিলেন শিখদের স্থায়ী সরকার স্থাপনের তবে তা ইংরেজ সরকার দ্বারা অনুমোদিত হয়নি। এরপর ১৮৩৯ সালে রণজিৎ সিং মারা গেলে শিখরা তাঁর কামনার পূর্ণতা চেয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যদিও তাতে কোনও লাভ হয়নি, ইংরেজরা এই ‘খালসা’ বাহিনীকে অতি সহজেই পরাজিত করে। এর পরে শিখরা অবলুপ্তির পথে প্রবাহিত হয় এবং তৎকালীন সময়ে ধীরে ধীরে শিখদের সমাজে অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। পরবর্তীতে শিখ সাম্রাজ্যের দ্রুত অবনতি নেমে আসে।

আরও পড়ুন-হাইকোর্টে খারিজ শুভেন্দুর আর্জি

অবশেষে মহারাজা দিলীপ সিং ১৮৫৩ সালে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত এবং যা শিখ ধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত বিষয়।
এর পরবর্তীতে শিখ রাজত্বের পূর্ণ অবলুপ্তির ফলে বিভিন্ন ধর্ম-গোষ্ঠী যেমন— খ্রিস্টান, ব্রাহ্মসমাজ, আর্যসমাজ এবং মুসলিমরা তাদের নিজের ধর্মে রূপান্তরিত করার তীব্র চেষ্টা করে এবং এর ফলস্বরূপ কিছু শিখ অন্য ধর্মে রূপান্তরিত হতে বাধ্য হয়।
শিখরা বহু দশক ধরে চলে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। তাই ১৯৪০ সালে শিখরা ‘খালিস্তান’ নামক এক স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি করে। ঐতিহাসিক কাল ধরে শিখরা মূলত ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে বসবাস করে এসেছে যা স্বাধীনতার সময়ে ‘র‍্যাডক্লিফ লাইন’ দ্বারা বিভাজিত হয়। এর ফলে তারা মুসলিম লিগের যা কিছু দাবি ছিল বা নিয়মাবলি ছিল তার তীব্র বিরোধিতা করে। তাই ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে বোঝা যাবে, শিখরা দেশ ভাগের বিরোধিতাই করেছিল। তাই ১৯৪৭ সালের মার্চ থেকে অগাস্টের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডি, ঝেলুম, অট্টক প্রভৃতি জায়গার শিখদের ওপর আক্রমণ করা হয়, শুধু তা-ই নয় তাদের নির্মমভাবে হত্যাও করা হয় এবং বিভিন্ন শিখ নেতাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়। এই ঘটনাটিকে তারা সিং পাঞ্জাবের ‘সিভিল ওয়ার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে শিখরা পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দু সংখ্যাগুরু ভারতবর্ষে চলে আসে এবং কিছু সংখ্যক শিখ মুসলিম সংখ্যাগুরু আফগানিস্তানে আসে যায়।

আরও পড়ুন-দুয়ারে সরকার শিবিরে হামলা

পাঞ্জাব শহরটি একদা চঞ্চল ছিল, সেখানে সর্বদা হানাহানি-যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। যদিও পাঞ্জাবে কিছু দশক ধরে শান্তি বিরাজ করছে। ১৯৮৪ সালে শিখরা বলপূর্বক অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দখল করলে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী শিখদের উপর আক্রমণ করলে বহু সংখ্যক শিখ মারা যায়। এই ঘটনার প্রতিশোধে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেহরক্ষক, যিনি একজন শিখ ছিলেন তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করেন। যদিও এই ঘটনার পরে শিখদের উপর অত্যাচার কমে যায় এবং তার পরবর্তী দশকে সমাজে বিভিন্ন জায়গায় শিখদের সম্মানিক উন্নতি দেখা যায়। বর্তমানে শিখদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেমন— প্রশাসনিক রাজনৈতিক সামরিক প্রভৃতি পদে তাদের অবস্থান পরিলক্ষিত হয়।

Latest article