ঠাকুরবাড়ির উৎসবের দোল

কলকাতার দোলে বাবুবিলাসে অন্যতম ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার। কীভাবে পালিত হত ঠাকুর পরিবারের দোল উৎসব? অন্দরমহলের মহিলারা কীভাবে অংশগ্রহণ করতেন? তাঁদের ভূমিকাই বা কতটা থাকত? মহিলাদের সাজগোজই বা কেমন ছিল? লিখলেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো আমাদের নানা ঋতুভিত্তিক উৎসব চলতেই থাকে। দোল বা বসন্ত উৎসব তার মধ্যে অন্যতম। সব ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বমানবতার উৎসব হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।
ফাগুনের রঙে যখন প্রকৃতি রঙিন হয়ে ওঠে তখন সবার মনেই লাগে রঙের ছোঁয়া। সে রঙ হল উৎসবের রঙ, আবেগের রঙ, আনন্দের রঙ। সেকাল থেকে একাল জারি রয়েছে দোলবিলাস। অতীতে বাবুদের দোলবিলাসের কত কাহিনি আজ কিংবদন্তি। কলকাতার বাবুদের দোলবিলাস নিয়ে ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায় হরেক গল্প। যা খুবই রঙিন এবং বর্ণাঢ্য।

আরও পড়ুন-দাপুটে জয়ের দিনে কাঁটা আশিক ও কাইথের চোট, আইএসএলের শেষ চারে মোহনবাগান

কলকাতার দোল প্রসঙ্গে ইতিহাস গবেষকের কথায় মেলে, ‘দোলের দিনে কোন ব্যক্তির বস্ত্র বেদাগ থাকতো না। দলে দলে মিছিল বাহির হইতেছে। পিচকিরি ও আবিরে পথঘাট ঘরবাড়ি লালে লাল হইয়া যাইতেছে।’
ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে হোলির আনন্দে মেতে উঠতেন। কলকাতার দোলে বাবুবিলাসের অন্যতম ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।
কীভাবে ঠাকুর পরিবারের দোল উৎসব পালিত হত? কী কী ব্যবস্থা থাকত তাতে? অন্দরমহলের মহিলারা কি অংশগ্রহণ করতেন? তাঁদের ভূমিকাই বা কতটা থাকত? তাঁদের বিশেষ সাজগোজ কেমন ছিল?
যেহেতু বলা হয় যে, সে-সময়ে নারী স্বাধীনতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। এই বাড়ির পুত্র-কন্যা এবং বধূরা মিলে স্বাধীনতার এবং স্বাধিকারের এক স্বতন্ত্র আবহ তৈরি করেছিলেন। সে-যুগের নিরিখে যা ছিল নজিরবিহীন। তাই তাঁদের পরিবারের উৎসব নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আমজনতার অসীম কৌতূহল।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লাগামহীন কুৎসা, আইনি জালে কং-নেতা

আসুন জেনে নেওয়া যাক কেমন ছিল ঠাকুর বাড়ির দোল?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথা ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’তে বর্ণনা দিয়েছেন— দোলের দিনে তাদের দেউড়ি গমগম করতো। চারিদিকে লাল আবিরের ছড়াছড়ি। লালে লাল হয়ে যেত মনোহর সিংয়ের সাদা দাড়ি পর্যন্ত। ‘‘ওই একটা দিন তার দাড়িতে হাত দিতে পেতুম, আবির মাখাতে গিয়ে। সেদিন আর সে তেড়ে আসত না। একদিকে হত সিদ্ধি গোলা। প্রকাণ্ড পাত্রে কয়েকজন সিদ্ধি ঘুঁটছে তো ঘুঁটছেই। ঢোল বাজছে। গামুর গুমুর শব্দে। আর আবির উড়ছে। দেওয়ালে ঝোলানো থাকতো ঢোল। দুদিন আগে তা নামানো হতো। বাবামশাইয়েরও ছিল একটি— সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া, লাল সুতো বাঁধা। আগে থেকেই ঢোলে কি সব মাখিয়ে ঢোল তৈরি করে, বাবামশায়ের ঢোল যেত বৈঠকখানায়, আর দারোয়ানদের ঢোল থাকত দেউড়িতেই।

আরও পড়ুন-শ্রদ্ধায়-স্মরণে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

গান হতো কচমত শব্দে। বেহারারা অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচ নাচতো দুই হাত তুলে, দুটো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নাচ। দেউড়ি আর বৈঠকখানায় এইরকম ছিল দোল উৎসব। আর ওতেই আনন্দ। বালতি ভরা লাল জলে পিচকিরি ডুবিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছি রং ছিটিয়ে দিচ্ছি পিচকিরি দিয়ে। তারা চেঁচামেচি করছে দেখে আমাদের ফুর্তি কী! বাড়ির ভেতরে সেদিন কি হত জানিনে, তবে আমাদের বয়সে খেলেছি দোলের দিনে— আবির নিয়ে এই বাড়ি ও বাড়ির অন্দরে ঢুকে বড়দের পায়ে দিতুম, ছোটদের মাথায়। বড়দের রঙ মাখাবার হুকুম ছিল না, তাঁদের ঐ পা পর্যন্ত পৌঁছতো আমাদের হাত।”
বৈঠকখানা আর দেউড়ি— উৎসব এই দুটোর মধ্যে লাগত ভাল রাজপুর দারোয়ানদের উৎসব। বৈঠকখানায় শখের দোল, শৌখিনতার চূড়ান্ত। সেখানে লটকনে ছোপানো গোলাপি চাদর, আতর, গোলাপ, নাচ, গান, আলো আর ফুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু সত্যি দোল উৎসব করত দারোয়ানরাই। উদণ্ড উৎসব। এমন লাল যে চেনবার জো নেই। সিদ্ধি খেয়ে চোখ দুটো পর্যন্ত সবার লাল। দেখলেই মনে হত হোলি খেলা এদেরই।
দোতলায় বাবামশাইয়ের বৈঠকখানাতেও হোলির উৎসব হত। সেখানে যাবার হুকুম ছিল না আমাদের। উঁকিঝুঁকি মারতুম। আধ হাত উঁচু আবিরের ফরাস পাতা। তার উপরে পাতলা কাপড় বিছানো। তলা থেকে লাল আভা ফুটে বের হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব এসেছেন অনেক বাবামশাইয়ের। অক্ষয়বাবু তানপুরা হাতে বসে আছেন। ফুলের ছড়াছড়ি। বাবামশাইয়ের সামনে গোলাপ জলের পিচকিরি, কাঁচের গড়গড়া, তাতে গোলাপ জলে গোলাপের পাপড়ি মেশানো। নলে টান দিলেই পাপড়িগুলো উঠানামা করে।

আরও পড়ুন-বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা

ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দোলের আয়োজন ছিল বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। সমারহের সঙ্গেই পালিত হত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দোল উৎসব। ইতিহাস অনুযায়ী বিখ্যাত নর্তকীর পায়ের ছন্দে আধহাত উঁচু আবিরের ফরাসে নাচের ছন্দে ফুটে উঠত পদ্মফুল। এমনই জাঁকজমকপূর্ণ বিস্তার ছিল ঠাকুরবাড়ির হোরি খেলার।
এতক্ষণ তো আমরা অবন ঠাকুরের ছোটবেলার কথা শুনলাম। পরবর্তী সময়ে ঠাকুরবাড়ির পূর্ণবয়স্ক সদস্যরা কীভাবে পালন করতেন বসন্ত উৎসব?
জোড়াসাঁকোর তেতালার বারান্দার আড্ডায় সংস্কৃত নাটকে বসন্ত উৎসবের কথা পাঠ করতে গিয়ে তার বর্ণনা জেনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সবাইকে বললেন— ‘‘কি সুন্দর ছিল সেকালের বসন্ত উৎসব। যেন হৃদয়ের হরি খেলা। এমন প্রাণ খুলে দিশি রঙের উৎসবকে ফিরিয়ে আনতে পারি না আমরা?” কেবলমাত্র আবির দিয়ে খেলা হবে। সহধর্মিণী কাদম্বরীরও উৎসাহের খামতি নেই। সোৎসাহে তিনি বললেন কেন পারব না, আমাদের উঠোনে অথবা পাশের বাড়ির বৈঠকখানার আঙিনায় বসন্ত উৎসব করলে দারুণ হবে।

আরও পড়ুন-শুধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার নয়, বাংলার পর্যটন দেশে মডেল

বাড়ির কন্যে স্বর্ণকুমারী বললেন— খুউব ভাল হবে। সব ভাই-বোনেরা মিলে দারুণ বসন্ত খেলা হবে।
এইসব বিষয়ে গুণেন্দ্রনাথের জুড়ি মেলা ভার। তিনিও সানন্দে সবাইকে নিয়ে মেতে উঠলেন। আমন্ত্রণ জানানো হল অতিথিদেরও।
এক বসন্ত-সন্ধেয় রঙিন আলোয় আর আবিরে বৈঠকখানা বাড়ির বাগান হয়ে উঠল যেন রূপকথার মায়াকানন।
রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর কথায়, বাড়ির মহিলারা দোল পূর্ণিমার বিশেষ দিনে হালকা মসলিনের শাড়ি পরে ফুলের গয়না, সুগন্ধী আতর আর গোলাপের গন্ধমাখা মালা খোঁপায় জড়াবেন। পারিবারিক রীতি এটাই। দোলের দিনে হালকা বা সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল, আবিরের লাল রং সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।
এ ছাড়া প্রতি উৎসবেই ঠাকুর পরিবারের মেয়েদের বিশেষ সাজ ছিল। বাসন্তী রঙে ছোপানো কালো পেড়ে শাড়ি, মাথায় ফুলের মালা, কপালে খয়েরের টিপ— এই ছিল বসন্ত পঞ্চমীর সাজ। দুর্গোৎসবে ছিল রং-বেরঙের উজ্জ্বল শাড়ি, ফুলের গয়না, চন্দন ও ফুলের প্রসাধন।
আমরা সবাই জানি শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রুচিতে ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব ধারা অন্যরকম ছিল। সূক্ষ্ম রুচিবোধে, সৌন্দর্যে, ভাবনায়, সুষমায় যা ছিল স্বতন্ত্রতায় আর আভিজাত্যে মোড়া। এর ধারে-কাছে কেউ আসতে পারত না।

আরও পড়ুন-রাজ্যে রাজ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার থাবা, আক্রান্ত বড়রাও, ওষুধে সতর্কতা

রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান দোলের দিনে সেজেছেন সেকালিনীর মতো। বেলফুলের মালা জড়ানো, খোঁপায় পিন করা জর্জেটের ওড়না। সারা গায়ে ফুলের গয়না। যেমন, হাতে মাধবীলতার কঙ্কণ, গলায় মাধবী মালা, কানেও ঝুমকোর মতো একগুচ্ছ মাধুরী ফুল। তাঁকে দেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে ডাক দিলেন— ‘‘অয়ি মাধবিকা কুসুমনন্দিতা।” আনন্দে ঝলমল করতে করতে কাদম্বরীও হাত বাড়িয়ে স্বামীর সাদা জামায় আবির ছড়িয়ে দিয়ে বললেন— ‘‘ওহে আবির লাঞ্ছিত যুবা এসো আমরা বসন্তের আহ্বান করি।”
দৃশ্যপট বদলে যায় মুহূর্তে। কখনও কবি বিহারীলাল দু’হাত ভর্তি লাল-সবুজ গোলাপি আবির নিয়ে বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে দিতে থাকেন কাদম্বরীর মাথায়, গায়ে— সারা শরীরে। উচ্ছ্বাসে সেই আবির বর্ষণে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ভিজতে থাকেন কাদম্বরী ঠাকুরণ।
এই হোরি খেলা দেখেই স্বর্ণকুমারীর মাথায় আসে একটি গীতিনাট্যের পরিকল্পনা। ‘বসন্ত উৎসব’ নাম দিয়ে সেটি লিখেও ফেলেন তিনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শুনেই অভিনয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। মহাখুশি তিনি। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রিহার্সাল শুরু করলেন মহাধুমধাম করে। ঘরোয়া আসরে বসন্ত উৎসব গান গাইলেন কাদম্বরী। এক অপার্থিব সুরের মায়ায় যেন ভাসিয়ে নিল সবাইকে। স্বর্ণকুমারী এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী অভিনয়ও করলেন।

আরও পড়ুন-অ্যাডিনো-সামলাতে হল ১৬ শয্যার শিশু ইউনিট

এই আনন্দযজ্ঞে আবির মাখামাখির পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গলা খুলে গান শুরু করলেন। প্রতিভা, সরলারাও রঙখেলা ফেলে গলা মেলাচ্ছে কোরাসে। বেজায় খুশি তারা। আসর জমাতে গুণেন্দ্রনাথ তবলায় সঙ্গত শুরু করলেন।
স্বর্ণকুমারী রঙও খেলছেন আর দুচোখ ভরে দেখছেন। সবার উদ্যোগে, উৎসাহে, উপস্থিতিতে তাঁদের গরিমার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি হয়ে উঠেছে যেন স্বর্গের নন্দনকানন।
গ্রন্থঋণ : জোড়াসাঁকোর ধারে : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবির বউঠান : মল্লিকা সেনগুপ্ত।

Latest article