শীতের রোগের ঘরোয়া সমাধান

শীতের শুরুতে আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে জ্বর-সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, কানব্যথা— এগুলো খুবই ভোগায়। পরিবারের ছোট-ছোট শিশু থাকলে তো কথাই নেই! লেগেই থাকে নানান অসুখবিসুখ। সব সময় ডাক্তার-বদ্যির কাছে না ছুটে, ঠাকুমা-দিদিমার সেই পুরাতনী চমৎকার ঘরোয়া সমাধান। লিখলেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চারক

Must read

শীতের শুরুতে ঘরে কিছু না থাক মধু, দারচিনি, তুলসী পাতা, আখের গুড় সবসময় মজুত রাখেন নিভাননী। নিভাননীর কাছে ঘর সংসারই সব। কবে কোন ছোটবেলায় এ সংসারে এসেছিলেন। তাঁর কাছে মনে হয় সংসারের কোনও কাজে ত্রুটি থাকলে তাঁর হেরে যাওয়া। সন্তান-সন্ততি নাতি-নাতনি, স্বামীর দেখভালেই দিন কাটাতে ভাল লাগে পেখম আর পোখরাজের ঠাম্মার। শীত আসতেই চিন্তার শেষ নেই তাঁর। কারণ প্রতিবছর নিয়ম করে শীত আসে। আর শীতের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে আসে নানান অসুখবিসুখ।
কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রান পড়তে না পড়তেই শীত নিয়ে সকলের যেন ভালবাসা আর আহ্লাদীপনার শেষ নেই। সবাই ভুলে যায় যে, আবহাওয়া পরিবর্তনের আনন্দের সঙ্গে নিয়ে আসে মাথাব্যথা, গাব্যাথা, সর্দি, কোমরে ব্যথা, জ্বর, গলাব্যথা, নাক-চোখ দিয়ে অকারণে জল পড়া, কাশি, গলা-খুসখুস, শ্বাসকষ্ট আরও কত কী।
তাই শীত পড়ার আগেই নিভাননী এই সমস্ত অসুখের ঘরোয়া টোটকার উপাচারগুলো জোগাড় করে রাখেন তিনি হাতের কাছে।
স্কুল কলেজ ফেরত নাতি-নাতনি, অফিস ফেরত ছেলে অথবা বাজার ফেরত কর্তামশাইয়ের ঘন ঘন নাক টানা অথবা খুকখুকে কাশি, খাবারে অরুচি দেখলেই ঠিক ধরে নেন নিভাননী এগুলো হচ্ছে শীত শুরুর উপসর্গ। তৈরি থাকেন তিনি। কারণ তাঁর কাছে আছে এ-রোগের মহৌষধ।
নিভাননীর যত্নে বাগানে বেড়ে ওঠা বাসক, তুলসী আর টাটকা শিউলি পাতার রস করে তাতে মধু মিশিয়ে সকাল-সন্ধে পরিবারের সদস্যদের মুখের সামনে দেন তিনি।
সপ্তাহখানেক নিয়মিত খেলে সর্দি-কাশি তো হাপিশ হবেই সঙ্গে গলা ছেড়ে গান গাইতে আর কোনও অসুবিধা থাকে না।
কখনও কখনও কাবাবচিনি আর লেবু মাখানো শুকনো আদাও সংগ্রহে রাখেন। একটা দুটো করে মুখে রাখলে গলা খুসখুস উধাও। এখনকার মতো কথায় কথায় ডাক্তারবাবুর বাড়ি ছোটা সেকালে নিয়ম ছিল না। ঘরের মেয়ে বউরাই ঘরোয়া টোটকায় এই সব সমস্যা সমাধানে বাজিমাত করতেন। নিভাননী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’।
ক-দিন ধরেই দেখছেন নাতনি পেখমের জ্বর-জ্বর ভাব, গলাব্যথা, ঢোঁক গিলতে কষ্ট, মাথাব্যাথা। আজ স্কুল থেকে ফিরতেই হলুদ দেওয়া গরম দুধের গ্লাস ধরলেন নাতনির মুখের সামনে। ক’দিন সকাল-সন্ধ্যা গরম দুধে হলুদ খেয়ে নাতনির শরীর যখন ঠিক হল তখন একদিন স্কুল থেকে ফিরে ঠাম্মার গলা জড়িয়ে ধরে পেখম বলল, ঠাম্মা তোমার এই ঘরোয়া টোটকাগুলো আমি লিখে ফেলি। তুমি মুখে মুখে আমায় বলে দাও তো…

আরও পড়ুন-হাওড়ার রাস্তায় বসল স্বয়ংক্রিয় নম্বর প্লেট রিকগনিশন ক্যামেরা

ঠাকুমার টোটকা
বাসক পাতা, শিউলি পাতা, তুলসী পাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে, একসঙ্গে রস করে মধু দিয়ে উষ্ণ অবস্থায় খেলে সর্দি-কাশি কমে।
আদা আর নুন রোদে ভাল করে শুকিয়ে কৌটো ভরে রেখে দেওয়া। ঘনঘন কাশি হলে সে সময় মুখে রাখলে গলায় খুব আরাম পাওয়া যায়। আর খুসখুসে কাশি উধাও হয় নিমেষেই।
রসুন মেথি আর কালোজিরে শুকনো খোলায় ভাল করে নেড়ে, সেটা একটা পুঁটুলিতে রেখে বাচ্চাদের নাক বন্ধ হলে বালিশের পাশে রাখলে বন্ধ নাক খুলে যায় এবং বাচ্চারা সর্দির থেকে আরাম পায়।
লবঙ্গ গোলমরিচ তুলসী পাতা মধু দারুচিনি আর আদা দু-কাপ জলে এগুলো প্রায় ১০-১৫ মিনিট ধরে ভাল করে ফোটাতে হবে। জলটা কমে যখন এক কাপমতো হয়ে যাবে তখন এর মধ্যে মধু দিয়ে ছেঁকে নিয়ে উষ্ণ অবস্থায় খেতে হবে। গলাব্যথা সর্দি-কাশি সবেতে এটা খুব উপকারে দেয়।
সর্দিতে যখন একেবারে নাক বন্ধ, শ্বাস নিতেও হালকা কষ্ট তখন মধু আর আদার পেস্ট এক চামচ করে দিনে অন্তত তিনবার খেলে বিশেষ করে ঘুমানোর আগে খুব আরাম পাওয়া যায়। তবে আদা-মধুর পেস্ট খাওয়ার পরপরই জল খাওয়া একেবারেই চলবে না।
একটা পাত্রে জল ফুটিয়ে তাতে চা পাতা তুলসী পাতা দারচিনি শুকনো আদার গুঁড়ো দিয়ে ফোটাতে হবে। এবং শেষে মধু দিতে হবে। এবং এই মশলা চা-গরম অবস্থায় খেলে কান বন্ধ, নাক বন্ধ, গলা জ্বালা এসব কমে।
বুকে সর্দি বসলে বা কফ জমলে ঘিয়ের সঙ্গে রসুন গরম করে সেটা দিয়ে গরম ভাত খেলে এই সমস্যায় কিন্তু দারুণ উপকার পাওয়া যায়।
তাহলে পেখমরানি দেখলি তো আমার এইসব ঘরোয়া টোটকাগুলো কিন্তু রোজকার রান্নাঘর থেকেই নেওয়া। আর গরম দুধে হলুদ খেয়ে গলায় আরাম মিলল কিনা? এক গাল হেসে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরল পেখম। আর মনে মনে বলল সত্যিই ঠাম্মা কত কিছু জানে!
শীতের শুরুতে আবহাওয়ার মতিগতি বোঝা ভার। কখনও বেশ শীত কখনও-বা গরম। মনে হচ্ছে পাখা চালালে বেশ আরাম হবে। আবার পাখা চালালে গা হাত-পা শিরশির করছে। এইরকম আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার ফলে সারাদিন ধরেই সর্দি-কাশির উৎপাত। এ-সবের জন্য রয়েছে আয়ুর্বেদের ঘরোয়া সমাধান।

আরও পড়ুন-২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবস সংসদে শীতকালীন অধিবেশনে একগুচ্ছ বিল

আয়ুর্বেদের টোটকা
শীতের শুরু মানে হঠাৎ সর্দিগরমি, প্রচণ্ড গলাব্যথা। যেন কাঁটার মতো বেঁধে। কিছুই খাওয়া যায় না এমনকী সাধারণ তাপমাত্রার জলও না। এক্ষেত্রে নুন, হলুদ, ত্রিফলা গুঁড়ো জলের সঙ্গে মিশিয়ে বারবার গার্গেল করলে গলাব্যথা অনেকটাই কমবে এটার আরেকটি উপকারও আছে কণ্ঠস্বরও কর্কশ হয় না।
গলাব্যথার জন্য খুবই উপকারী শুকনো আদা। আদা শুকনো কুচি মুখের মধ্যে রেখে দিলে হাঁচির সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। এতে যে শুধু কাশির সমস্যাই কমে তা নয়, মা জেঠিমা-কাকিমাদের মতে এই টোটকাতে বাড়ে হজম শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
তবে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে শুকনো আদা জলের সঙ্গে ফুটিয়ে বারবার করে খাওয়ালে তাতে রোগ নিরাময় হয়।
তুলসী পাতার তো গুণের শেষ নেই। তুলসী পাতা নানাভাবে খাওয়া যায়। সকাল-সন্ধে মধু দিয়ে চিবিয়ে খাওয়া যায়, তুলসী পাতা জলে ফুটিয়েও সেই জল খাওয়া যায়। তারপর আবার নাক বন্ধ হয়ে গেলে বাড়িতেই গরম জলের ভাপ নেওয়া যায়।
গরম জলে তুলসী পাতা, পাঁচটা-ছটা ফেলে দিয়ে সেই ভাপ নিলে সেটা খুব উপকারী। ঠান্ডা লেগে কান-মাথা আটকে গেলে সেই ক্ষেত্রে এটা খুব উপকারী।
ছোট শিশুদের জন্য জায়ফল
শীতের শুরুতে বাচ্চারা ভুগলে বড়দের মাথার ঠিক থাকে না। কাশি হলে চলতেই থাকে। মা তখন সমস্যায় পড়ে যান। বুঝতে পারেন না যে কী ওষুধ দেবেন।
ছোটদের কাশির সিরাপ দেওয়া ভাল নয়। বদলে দিতে পারেন প্রাকৃতিক উপাদান যেমন জায়ফল। এর উপকারিতা অসীম। খাবারের স্বাদ-গন্ধ বাড়ানোর পাশাপাশি জায়ফল শরীরের জন্য খুবই উপকারী। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লে সর্দি-কাশির সংক্রমণের বা অন্যান্য অসুখের ঝুঁকি বেড়ে যায় এমন পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের এক চিমটি জায়ফল গুঁড়ো দিলে তাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পায়। শীতের মরশুমে সর্দি-কাশি হলে সর্ষের তেলে জায়ফলের গুঁড়ো মিশিয়ে গরম করে বাচ্চাদের বুকে মালিশ করলে সর্দি- কাশি থেকে আরাম পায় শিশুরা। জায়ফলের তেলে উপস্থিত অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্যও উপকারী।
অনেক সময় শিশুরা প্রায়ই পেটব্যাথা বা গ্যাসের সমস্যায় ভোগে। মধুতে এক চিমটি জায়ফলের গুঁড়ো মিশিয়ে খাওয়ালে পেটের ব্যথা ও গ্যাসের সমস্যা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
এছাড়া শিশুর ঠান্ডা লাগলে বুকে সর্দি জমলে জায়ফল গুঁড়ো একটু তাওয়ায় গরম করে নিয়ে বুকে ঘষলে, পায়ের তলায় দিলেও সর্দি নিরাময় হয়।
দুধে মিশিয়ে জায়ফল শিশুকে খাওয়ালে এই সময় যে হজমের গোলমাল তার উপশম হয়। এই সময় খাবারে অরুচি হলে জায়ফল-মেশানো দুধ খাওয়ানো যেতে পারে। এতে খিদে বাড়বে। তবে জায়ফল কোনও শিশুকে দেবার আগে শিশুটির এতে এলার্জি আছে কি না দেখে নিন। এলার্জি থাকলে ভুল করেও শিশুকে দেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন-‘হাঁটি হাঁটি পা পা’, গোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে রুক্মিণী

ঋতু বদলের অসুখের প্রতিরোধ
ঋতুর পরিবর্তনের সময় পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে দেহের ভিতরে বিভিন্ন ক্রিয়া চলতে থাকে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। বাতাসে তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতাও কমে যায়। যা আমাদের শ্বাসনালির স্বাভাবিক ক্রিয়াকে ব্যাহত করে ফলে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া সহজ হয়। এই সময়টাতে নানা ধরনের অসুখবিসুখ মানুষকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
তাই ঋতু পরিবর্তন এবং শীতকালীন অসুখবিসুখ প্রতিরোধে করণীয় হল যারা শীতকালে সর্দি-কাশি-ঠান্ডা-সহ বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হন তাঁরা শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন উষ্ণ গরম জল, চা বা কফি পানীয় হিসাবে গ্রহণ করে দিনটা শুরু করুন।
আদা-লবঙ্গ-তুলসী পাতা মিশিয়ে হার্বাল চা খুবই কার্যকর এই সময়ে। এতে শরীরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। ঠান্ডা কম লাগবে এবং বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।
যাদের এ-সময় নিয়মিত গলাব্যথা হয় তাদের জন্য উষ্ণ গরম জল পান করাই ভাল এবং হালকা গরম জলে নুন দিয়ে কুলকুচি করা উচিত। প্রয়োজনে গলায় গরম কাপড় জড়িয়ে রাখতে হবে।
এছাড়া ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ মরশুমি ফল, শাকসবজি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। কারণ ভিটামিন সি ঠান্ডা লাগার প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে।
সর্দি-জ্বরে অনেক সময় রুচি কমে যায় খাবারে তখন আনারস, বাতাবি লেবু, আমলকী, আমড়া, কমলালেবু খেলে মুখে রুচি ফেরে।
ঠান্ডা লাগলে গলায়, বুকে, পিঠে রসুন দিয়ে ফোটানো সর্ষের তেল হালকা ভাবে মালিশ করলে এবং গরম সেঁক দিলে উপকার পাওয়া যাবে। সর্ষের তেল,রসুন শরীরকে গরম রাখে, যা ঠান্ডা লাগার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
নাক বন্ধ মনে হলে নাক দিয়ে গরম জলের ভাপ নিলে আরাম হয়। উপকার বেশি পেতে হলে গরম জলে কিছু ফিটকিরি বা মেন্থলের টুকরো দিয়ে ভাপ নিলে বন্ধ হওয়া নাক সহজেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

এইসময় জল এমনিতেই খুব কম খাওয়া হয়, ফলে শরীরে জলের স্বল্পতা দেখা যায়। এর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও তরল খাবার খেতে হবে।
এই সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা বেশি প্রয়োজন কারণ ধুলোবালি ও রোগ-জীবাণুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। ফলে অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।
কিছু কিছু সময় শীতের তীব্রতায় হাতের আঙুল নীল হয়ে যায়, আঙুল ফুলে যায় এবং খুব ব্যথা হয় যাঁদের তাঁরা অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করবেন। যেন কোনওভাবেই ঠান্ডা না লাগে। গরম সেঁক দেওয়া ও হালকা আঙুলের ব্যায়াম এক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
আমাদের এই শহরে নিভাননী, হেমনলিনী, প্রভাময়ী, রাঙা ঠাম্মা, ফুল দিম্মা, কনে মা, বড়মার মতো মানুষেরা থাকেন। শীতের শুরুতে একবার তাঁদের সাথে কথা বলে জেনে নিন শীতের অসুখ-বিসুখের মোকাবিলা করার হাল-হকিকত। ব্যাস তা হলেই কেল্লাফতে! জমিয়ে শীত উপভোগ করতে আপনি এক্কেবারে রেডি অ্যান্ড স্টেডি।

Latest article