হাসপাতাল মানে শুধুমাত্র ডাক্তার বা নার্স বা প্যারামেডিক্যাল কর্মী নয়, এই সবকিছুর পিছনে রয়েছে এক বিশাল পরিচালন কর্মকাণ্ড। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে উন্নতমানের করে তোলার জন্য যেমন চিকিত্সা ব্যবস্থার উন্নতি, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, ওষুধপত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এগুলি যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনই একটি হাসপাতাল বা নার্সিংহোম-এর সমস্ত কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্যও একটি কর্মীবাহিনী দরকার পরে। চিকিত্সাব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো একটি ভালো প্রশাসনিক কাঠামোর (Hospital Management) দরকার। রাজ্য তথা দেশে যেভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নের জন্য সরকারি বা বেসরকারি একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তার দরুন এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বা প্রশাসনিক বিভাগে অনেক প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন। অন্যান্য পরিষেবার সঙ্গে এই পরিষেবার পার্থক্যের জায়গাটা অনেকাংশেই বেশি। হাসপাতালের প্রায় সব ক্ষেত্রেই ২৪ ঘণ্টা, ৩৬৫ দিন সময়ের জন্য কাজ চালু রাখতে হয়। শুরু থেকেই সেই রকম মানসিকতা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই, কাজের জায়গা বা চাহিদার জায়গাটাও নেহাত কম নয়। বর্তমানে শহর বা শহরতলি অঞ্চলে জেনারেল হসপিটালের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে স্পেশ্যালিটি হসপিটাল, সুপার স্পেশ্যালিটি হসপিটাল। উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ প্রশাসনিক ব্যাক্তিদের প্রয়োজন হয় পরিষেবা টিকিয়ে রাখা এবং সেটিকে আরও উন্নতমানের করে গড়ে তোলার জন্য। পরিষেবা, অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি রোগীর প্রতি যত্ন, সহনশীলতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়।
হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট কী ?
– স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সমস্ত প্রশাসনিক স্তরে কাজ চালানোর উপযোগী প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরির জন্য রয়েছে হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের (Hospital Management) মতো বিষয়। প্রতিষ্ঠানের গঠন, কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা, গুণমান, চিকিত্সা সংক্রান্ত সুযোগসিুবধা প্রদান, রোগী এবং তাঁর সঙ্গে আসা মানষুজনদের পরিষেবা প্রদান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, উন্নয়ন এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট-এর মতো বিষয়। একটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আনুষাঙ্গিকভাবে আউটপেশেন্ট ক্লিনিক, ড্রাগ অ্যাবিউজ ট্রিটমেন্ট সেন্টার, এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইউনিট, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার এই সমস্ত বিভাগগিুলর জন্যেও হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। শিক্ষা থেকে বাণিজ্য যে-কোনও ধরনের প্রতিষ্ঠানকেও ধরে রাখার জন্য। বলা যেতে পারে, সামগ্রিক পরিষেবা নিয়ে হাসপাতালকে আরও সমৃদ্ধিশালী করার জন্য একটি ভালো ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রয়োজন পরে। ম্যানেজমেন্ট স্তরের পড়াশুনার মধ্যে অন্যতম যুগোপযোগী এবং পেশাবহুল কোর্সের মধ্যে রয়েছে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট। আজকের হাসপাতালশিল্পের দ্রুতবধর্মান বিস্তারের যুগে এর প্রয়োজন আরও বাড়ছে।
যোগ্যতা কীরকম দরকার ?
– বিভিন্ন ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলিতে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ের উপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করানো হয়। ব্যাচেলর ইন হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট (বিএইচএম) কোর্সের জন্য ৫০ শতাংশ নম্বরসহ উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ যোগ্যতা থাকা দরকার। মূলত বিজ্ঞান শাখার ছেলেমেয়েদের জন্যে এই কোর্স। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বায়োলজি থাকা আবশ্যক। এই বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের জন্য যে-কোনও শাখায় স্নাতক বা বিএইচএম যোগ্যতার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মেডিক্যাল বা নন-মেডিক্যাল উভয় প্রার্থীদেরই সুযোগ দেওয়া হয়। ডব্লুবিইউটি অনুমোদিত কোর্স হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিছু প্রতিষ্ঠান এক বছরে ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্সও করানো হয়ে থাকে। এসসি/এসটি/ওবিসি প্রার্থীদের জন্য স্কলারশিপেরও ব্যবস্থা থাকে।
কোথায় করানো হয় ?
ডব্লুবিইউটি অনুমোদিত একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক কোর্স করানো হয়। ডব্লুবিইউটি থেকে মাস্টারস ডিগ্রি করা যেতে পারে। ইগনু থেকে হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ- একটি সার্টিফিকেট কোর্স করানো হয়ে থাকে। অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেও সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা কোর্স হয়ে থাকে। রাজ্যের বাইরে অল ইন্ডিআ ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স থেকে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা করা যেতে পারে।
কী ধরনের কোর্স ?
-“বিএইচএম করার জন্য ডব্লুবিইউটির সিলেবাস অনুযায়ী ছয়টি সেমেস্টারে ভাগ করা হয়ে থাকে। ছয়টি সেমেস্টারের মধ্যে ম্যানেজমেন্ট সম্বন্ধে প্রাথমিক শিক্ষা, হসপিটাল অ্যান্ড হেলথ সিস্টেম, মেডিক্যাল টার্মিনোলজি, হেলথ ইকনমিক্স, মেডিক্যাল রেকর্ড সায়েন্স, ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, পাবলিক রিলেশন, ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাবরেটরি, কম্পিউটার ল্যাবরেটির সম্বন্ধে পড়ানো হয়ে থাকে। প্রায় সব সেমেস্টারেই থিওরি ও প্র্যাক্টিক্যাল ভাগ থাকে। ইগনুর ডিপ্লোমা কোর্সের ক্ষেত্রে ম্যানেজমেনট, ক্লিনিক্যাল, থেরাপিউটিক সার্ভিস, সাপোর্ট অ্যান্ড ইউটিলিটি সার্ভিস, হেলথ সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট, প্রোজেক্ট ওয়ার্ক এসব করানো হয়।
কাজ কী ধরনের ?
– এই পেশার ক্ষেত্রে হসপিটাল ম্যানেজার বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে বিশেষ কিছু দিকে খেয়াল রাখতে হয়। স্বাস্থ্য ও তার রক্ষা বিষয়ে প্রাথমিক ধারণার পাশাপাশি পাবলিক ম্যানেজমেন্টের দিকটি মাথায় রাখতে হয়।
তাঁদের যেমন একদিকে মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েটদের জন্য প্রয়োজনীয় টেকনিকাল বিষয়গুলিতে নজর রাখতে হয়, তেমনই নন-মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েটদের জন্য হেলথ সার্ভিস, ম্যানেজিং স্টাফ, আইটি ম্যানেজমেন্ট, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়গুলির দিকে খেয়াল রাখতে হয়। চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরের কর্মী, ডাক্তার, নার্স, চিকিত্সাকর্মীর সঙ্গে সু-সম্পর্ক ও সমন্বয় বজায় রেখে চলতে হয়। বর্তমানে ব্র্যান্ড ভ্যালু, মার্কেট প্ল্যানিং-এরও জায়গায় তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও ম্যানেজাররা বড় ভমিকা পালন করেন। সুসংগত এবং উন্নতমানের পরিষেবা দেখিয়ে চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানের মান্নোয়নের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া প্রয়োজন। তবে শুধুমাত্র হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবেই নয়, মেডিক্যাল কলেজের ডিরেক্টর, নার্সিং ডিরেক্টর, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হেড, মেডিক্যাল ডিরেক্টর, হসপিটাল সুপারিন্টেডেন্ট হিসাবে কাজ করার সুযোগ থাকছে। যোগাযোগ দক্ষতার পাশাপাশি, ম্যানেজিং পাওয়ার, নতুনত্বের চিন্তাভাবনা, দায়িত্বশীলতা থাকা প্রয়োজন।
পেশায় সুযোগ কেমন ?
-“বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, হেলথ এজেন্সি, মেডিক্যাল কলেজ ও প্রতিষ্ঠান, হেলথ সেন্টার এবং নার্সিংহোম, ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলিতে প্রচুর কাজের সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোর্স করার পর বিভিন্ন নার্সিংহোম, হেলথ সেন্টারগুলিতে কাজের সুজোগ করে দেওয়া হয়। অ্যাপেলো, আমরি, সিএমআরআই, ফোর্টিস, ডিসানের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিতে কাজের সুযোগ মেলে। বিশাল সংখ্যক প্রাইভেট হসপিটাল এই কাজের সুযোগ বাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ছোটখাটো হেলথ সেন্টারে কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বড় কাজের সুযোগ তৈরি হয়। বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, মুম্বইয়ের মতো শহরে প্রচুর নুতন কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে অ্যাসিস্ট্যান্ট হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে কাজ শুরু করা যেতে পারে। কাজ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদন্নোতি হওয়ার সুযোগ থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি চিকিত্সাক্ষেত্রে প্রবেশ না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও কাজের সুযোগ পাওয়া যায়।