আওরঙ্গজ়েব কতটা হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন ?

১৭৫৯ সালে আজকের দিনে আওরঙ্গজ়েব আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। মোগল সম্রাটের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষী স্বরূপ ইতিহাসের পাতা ধরে বিশ্লেষণ করছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

যুগে-যুগে কাহিনি কিংবা লোকমুখে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজ়েবকে ‘খলনায়ক’ বলা হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটক হোক কিংবা তার পরবর্তী বিভিন্ন সাহিত্য, আওরঙ্গজ়েব চিরকালীন খল চরিত্রেই ঠাঁই পেয়েছেন। তিনি শুধু ‘গোঁড়া’ শাসক নন, তিনি দুরাচারী, অত্যাচারী, ভ্রাতৃঘাতী নবাব। ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহরুও তাঁর বই ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’য় আওরঙ্গজ়েবকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং গোঁড়া, অসহিষ্ণু শাসক হিসেবেই দেখছেন। নেহরু লিখছেন, ‘আওরঙ্গজ়েব সময়ের উল্টো দিকে ঘড়িকে চালাতে চেয়েছিলেন।’ কথায়-কথায় নেহরুকে দোষারোপে অভ্যস্ত বিজেপিও একবিংশ শতকে এসে দিল্লির রাস্তা থেকে আওরঙ্গজ়েবের নাম মুছে দিয়েছে।
সত্যিই কি আওরঙ্গজ়েব আদ্যোপান্ত ধর্মান্ধ ছিলেন? নাকি ইতিহাসে কল্পনার রং মিশিয়ে আখ্যান গড়ে তোলা হয়েছে?
ঔপনিবেশিক আমলে গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের লক্ষ্য ছিল, নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে মোগলদের থেকে উন্নত প্রতিপন্ন করা এবং ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতবাসী যে অন্ধকার যুগ পেরিয়ে এসেছে তা তুলে ধরা। সেদিক থেকে শেষ শক্তিশালী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজ়েবকেই নিশানা করেছিলেন তাঁরা। পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের কাছেও আওরঙ্গজ়েব মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী। সেই দায় বয়ে নিয়ে বেড়ায় তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক নীতি। এই আবহে সাড়ে তিনশো বছর আগের এক ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক।
বারাণসীর মোগল রাজকর্মচারীরা দিল্লির বাদশার কাছ থেকে ‘ফরমান’ পেলেন। সেই রাজনির্দেশে লেখা রয়েছে, মোগল বাদশার কর্মচারীদের স্থানীয় কোনও মন্দিরের বিষয়ে অযাচিতভাবে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। আরও লিখেছেন বাদশা আওরঙ্গজ়েব ওরফে আলমগীর, ‘তোমাদের নিশ্চিত করা উচিত যাতে কেউ হিন্দু এবং ব্রাহ্মণদের অত্যাচার না করে এবং তাঁরা তাঁদের এলাকায় থাকতে পারেন এবং মন্দিরে সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে পারেন।’ শুধু এখানেই শেষ নয়, পরবর্তীকালেও ব্রাহ্মণদের স্বার্থরক্ষায় আওরঙ্গজ়েবকে সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে। ১৬৮০ সালে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন, বারাণসীর ভগবন্ত গোসাঁই নামে এক ব্রাহ্মণকে কোনওরকম অত্যাচার না করার। এর আগেও এমন উদাহরণ আছে। দিল্লির তখতে বসার ৯ বছর পরে আওরঙ্গজ়েব দান পাঠালেন গুয়াহাটির উমানন্দ মন্দিরে। শুধু জমি নয়, আশপাশের এলাকা থেকে রাজস্ব আদায় করার অনুমতিও পেলেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। ১৬৮৭ সালে ফের বারাণসীতেই রামজীবন গোসাঁই নামে এক ব্রাহ্মণকে গঙ্গার পাড়ে জমি দিলেন দিল্লির বাদশা। সেই জমিতে ব্রাহ্মণ এবং ফকিরদের আশ্রয় গড়ে তোলা হল। ১৬৯১ সালে চিত্রকূটের বালাজি মন্দিরের জন্য মহন্ত বালকদাস নির্বাণী আখড়াকে আটটি গ্রাম ও বড় মাপের করহীন জমি দান করেছেন। ১৬৯৮ সালে মধ্য ভারতের পূর্ব খান্দেশের রঙ্গ ভট্ট নামে এক ব্রাহ্মণকে করহীন জমি দান করেছিলেন আওরঙ্গজ়েব। এসবের মাঝে ব্রাহ্মণদের ভাতাও বৃদ্ধি করছেন তিনি। ঈশ্বরদাস নামে এক ব্রাহ্মণ জ্যোতিষাচার্য আওরঙ্গজ়েবকে ‘ধার্মিক’ বলছেন এবং তাঁর কর পদ্ধতিকে ‘বৈধ’ তকমা দিচ্ছেন।
শৈব সাধুদের প্রতিও আওরঙ্গজ়েবের ‘নেকনজর’ লিপিবদ্ধ করেছে ইতিহাস। আকবর বাদশা দক্ষিণ ভারতের ‘জঙ্গম’ সম্প্রদায়ভুক্ত শৈব সাধুদের ১৫৬৪ সালে জমি দান করছেন। তার একশো বছর পরে আকবরের প্রপৌত্র আওরঙ্গজ়েব তিন-তিনবার (১৬৬৭ থেকে ১৬৭৪) বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছেন। শুধু ব্রাহ্মণ নয়, জৈন সাধুরাও সমান তালে আলমগীরের অনুগ্রহ লাভ করছে। মাউন্ট আবু, গিরনারের জৈন সাধুদের জমি দান করছেন তিনি। লালবিজয় নামে এক জৈন সন্ন্যাসীকে মঠ উপহার দিচ্ছেন। অনুদান পেয়ে খুশি জৈনরা সমসাময়িক গ্রন্থাবলিতে লিখে দিলেন, ‘মর্দানো অউর মহাবলী আওরঙ্গশাহী নরন্দ।’
তা হলে যে-আওরঙ্গজ়েবকে বছরের পর বছর ধরে গোঁড়া, ধর্মান্ধ বলে প্রচার করা হয়ে আসছিল, তিনি কোথায়?

আরও পড়ুন-কাঁথিতে আরও এক সমবায়ে বিপুল জয় তৃণমূল কংগ্রেসের

১৬৭০ সালে মথুরার কেশব দেব মন্দির ভাঙার নির্দেশও দেন আওরঙ্গজ়েব। ভিন্ন ধর্মের উপাসনাস্থল ভাঙা উদারপন্থী কাজ নয়, কিন্তু মন্দির ভাঙার পিছনে শুধুই ধর্মান্ধতা ছিল না, রাসের সময়ে দাঁড়িয়ে বারাণসীর সামন্তরা মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আবার বহু সময় ব্রাহ্মণরাও ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাকও গলাচ্ছিলেন। রাজনৈতিক কারণও ছিল। বারাণসী, মুলতানের মতো এলাকার মন্দিরগুলিতে শাসক-বিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে বলেও বাদশার কাছে খবর পৌঁছচ্ছিল। তাই এ-কথা বুঝতে সমস্যা হয় না যে, শাসকের ধর্ম এবং ক্ষমতা সম্পর্কে সতর্ক করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মোগল বাদশা। মন্দির সম্পর্কে আওরঙ্গজ়েবের নির্দেশও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্রাচীন কোনও মন্দির ধ্বংস করা যাবে না। তবে নতুন মন্দিরও তৈরি করা যাবে না।’’ নতুন মন্দির তৈরি করতে না-দেওয়াকে হিন্দুবিরোধী বলা হয় বটে। তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, সে-সময়ে মোগলরা আর্থিক সংকটে পড়েছিল। বিরাট সাম্রাজ্যের খরচ সামলাতে যে পরিমাণে কর দরকার, তা জমি থেকে আসছিল না। সে সময় রাজস্ব বাড়াতে নতুন এলাকা আওতায় আনা প্রয়োজন ছিল। এই পরিস্থিতিতে যদি একের পর এক মন্দির তৈরি হয় এবং তার অধীনে নিষ্কর জমি যায় তা হলে শাসকের আয় কমবে। হয়তো সেই কারণেই নতুন নতুন মন্দির তৈরিতে নিষেধ চাপিয়েছিলেন আওরঙ্গজ়েব। হিন্দুদের সম্পর্কে তাঁর বৈরিতা নিয়ে নানা কল্পকাহিনি ঘুরে বেড়ায় বটে, কিন্তু রাজপুতদের মতো হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মোগলদের সখ্যও তাঁর আমলে ধরা পড়ে। আওরঙ্গজেবের হিন্দু-বিদ্বেষ দেখাতে গিয়ে অনেকেই অনেকখানি কালি খরচ করে ফেলেন জিজিয়া করের প্রসঙ্গে। ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলমান নাগরিকদের ‘জান-মান-ইজ্জত’ রক্ষার জন্য তাঁদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থই হল ‘জিজিয়া কর’। অমুসলমান প্রত্যেককেই কিন্তু এই কর দিতে হত না। অশক্ত, বৃদ্ধ, পাদরি, পূজারি, বেকার, বিকলাঙ্গ ও মহিলাদের এই কর দিতে হত না। প্রসঙ্গত, ইসলামি শাসনব্যবস্থায় এমন কিছু কর ছিল, যা শুধুমাত্র মুসলমানদেরই দিতে হত। জিজিয়ার সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল বছরে ৪৮ দিরহাম ও সর্বনিম্ন বছরে ১২ দিরহাম। আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করেই এই কর ধার্য হত। যেহেতু এই করের বিনিময়ে সরকার কর প্রদানকারীর প্রাণরক্ষায় দায়বদ্ধ ছিল, তাই এই কর প্রদানকারীকে সরকার যুদ্ধে যোগদান করতে বাধ্য করতে পারত না। অথচ, প্রত্যেক মুসলমান নাগরিক যুদ্ধে যোগদান করতে বাধ্য ছিলেন। যদি দেখা যেত, সরকার কর প্রদানকারীর ধন-প্রাণ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে, তা হলে সেই কর সংশ্লিষ্ট নাগরিক বা তাঁর পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়া হত। যদি ঔরঙ্গজেবের হিন্দু-বিদ্বেষই হত কর আদায়ের কারণ, তা হলে করের হারে তারতম্য ঘটত না।
জিজিয়া করটি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হিন্দুদের প্রদেয় প্রায় ৭০টি কর তুলে দিয়েছিলেন। স্যর যদুনাথ সরকার তাঁর হিস্ট্রি অব ঔরঙ্গজেব গ্রন্থে এরকম ৬৫টি কর তুলে দেওয়ার কথা লিখেছেন। একথা সত্যি যে, আওরঙ্গজেবের আমলে বেশ কিছু মন্দির ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু হিন্দু মন্দির ধ্বংসই তাঁর অভিপ্রায় হলে আরও অনেক মন্দির তাঁর নাগালে থাকলেও অক্ষত থাকত না। আওরঙ্গজেবের উদারনীতি প্রসঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন, “তাঁর আমলে হিন্দুদিগের বড় বড় পদ, মর্যাদা ও জায়গীর দেওয়া হয়েছে। এমনকি সম্পূর্ণ মুসলমান প্রদেশ আফগানিস্তানের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন একজন হিন্দু। জয় সিংহ, যশোবন্ত সিংহ, রসিকজান প্রমুখ সাতাশ জন হিন্দু তাঁর আমলে উচ্চপদে আসীন হন। সেনাদলেও ছিল হিন্দুদের আধিক্য।” আওরঙ্গজ়েব হিন্দু পণ্ডিতদেরও জায়গির দান করতেন। তিনি যাঁদের জায়গির দান করেছেন তাঁদের মধ্যে বারাণসী জেলার গিরিধর, মহেশপুরের যদু মিশ্র ও পণ্ডিত বিল্বধর মিশ্রের নাম ইতিহাসসিদ্ধ।
ইতিহাসবিদ আলেকজ়ান্ডার হ্যামিল্টন ঔরঙ্গজ়েবের আমলে দীর্ঘকাল ভারতে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ইসলাম এখানকার রাষ্ট্রধর্ম, তবে প্রজাদের শতকরা ৯০ জনই হিন্দু এবং তাঁদের পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কাজকর্ম পরিচালনায় যোগ্যতাই বিবেচনা করতেন আওরঙ্গজ়েব, ধর্ম নয়। এই বিষয়ে নানা সাক্ষ্য মেলে।

Latest article