গত দু’বছর অতিমারির কালো ছায়ায় ঢেকেছিল বিশ্ব চরাচর। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণেও ছাপ ফেলেছিল সেই ছায়া। তাল কেটেছিল সব উৎসবের। অতিমারি পেরিয়ে এবার তাই সুদে-আসলে দু’বছরের সব খামতি পুষিয়ে নিতে চায় বাংলার মানুষ। আর বাঙালির সেই উৎসব যাপনের প্রকৃত অর্থেই সূচনা হতে চলেছে আগামী ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে। এ-বছর স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি সেই উৎসবের আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। তাই উৎসবের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে আগেভাগেই। সরকারি ভাবেও শুরু হয়েছে স্বাধীনতার প্লাটিনাম জয়ন্তী পালনের তোড়জোড়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বাঙলার সরকারও নিজেদের মতো করে নানা কর্মসূচি নিয়েছে। তবে কেন্দ্রের ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে রাজ্যের সরকারের নেওয়া কর্মসূচির মূলগত কিছু পার্থক্য থাকছে। তাই কেন্দ্রের বহুল প্রচারিত ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ তাদের ধরাবাঁধা পথে এ-রাজ্যে পালিত হবে এ-কথা বলা যাবে না।
আরও পড়ুন-সার্বিক মূল্যায়নে স্বাধীনতা ৭৫
বাংলার সরকার তথা তার কাণ্ডারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে চান দেশমাতৃকার সেই বীর পুত্রদের যাঁদের বীরত্ব, আত্মদানের বিনিময়ে লব্ধ এই স্বাধীনতা। এবং শুধুমাত্র ১৫ অগাস্ট একদিন নয়, লাগাতার নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপন করবে রাজ্য। তবে সব কর্মসূচিরই কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছে স্বাধীনতার বীর শহিদদের স্মৃতিতর্পণ, যাঁদের সিংহভাগই এই বাংলার ভূমিপুত্র। এই উৎসব পালনের সূচনা হবে সোমবার ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসে। রাজধানী কলকাতা ও জেলায় জেলায় স্বাধীনতার উৎসব পালনে একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়েছে রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকারের স্বাধীনতা দিবস পালনের মূল অনুষ্ঠানটি হবে কলকাতার রেড রোডে। সেখানে প্রতিবছরই স্বাধীনতা দিবসে সেনাবাহিনী এবং কলকাতা পুলিশের কুচকাওয়াজের পাশাপাশি একাধিক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে গত দু’বছর নমো-নমো করে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তাই এ-বছর স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সঙ্গতভাবেই রেড রোডের অনুষ্ঠানের জৌলুস আরও বাড়ছে। রেড রোডের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে সম্প্রীতি আর উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার।
আরও পড়ুন-কিছু উপলব্ধি কিছু বেদনা
জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুষ্ঠান মঞ্চে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিতে মালা দেবেন। হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি হাতে নিয়ে কুচকাওয়াজে শামিল হবে স্কুল পড়ুয়ারা। এ-ছাড়া বিভিন্ন দফতরের ট্যাবলোর মধ্যে দিয়েও দেশের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের চিরায়ত ছবিটি তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়েছে মা মাটি মানুষের সরকার। তাই এবার রেড রোডে স্বাধীনতার দিবসের অনুষ্ঠানে যে সমস্ত ট্যাবলো নামানো হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হিসাবে থাকছে ‘একতাই সম্প্রীতি’ শীর্ষক একটি ট্যাবলো। একইসঙ্গে কন্যাশ্রী, ঐক্যশ্রী, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, স্বাস্থ্যসাথী, দুয়ারে রেশনের মতো রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কল্যাণকর পদক্ষেপের দিকগুলিও ট্যাবলোর মাধ্যমে তুলে ধরা হবে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজে। সাম্প্রতিককালে শহিদ হওয়া সেনা জওয়ানদেরও শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ কর্মসূচি থাকছে। গত পয়লা জুলাই মণিপুরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ-রাজ্যের কয়েকজন সেনা জওয়ান প্রাণ হারান।
আরও পড়ুন-বেলুড় বালিকা বিদ্যালয় পেল নতুন রূপ
স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের নিকট আত্মীয়দের ক্ষতিপূরণ ও চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেবেন। পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকদেরও দক্ষতার জন্য আলাদাভাবে সম্মানিত করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের পদক দিয়ে সম্মানিত করবেন। আবার সদ্য প্রয়াত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্টদের শ্রদ্ধা জানাতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, শঙ্খ ঘোষ, বাপ্পি লাহিড়ী, শাঁওলি মিত্র, পার্থ ঘোষ ও অভিষেক চট্টোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে আলাদা ট্যাবলো তৈরি করছে তথ্য সংস্কৃতি দফতর। ইউনেস্কোর রাজ্যের দুর্গা পুজোকে আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টিকেও বড়সড় প্রাপ্তি হিসাবে দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই এই বিষয়টিও এবার উঠে আসছে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে রাজ্য সরকারের আরও একটি বড় উপহার আলিপুর জেলে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স মিউজিয়াম’। যেটি তৈরির কাজ শেষের পথে। স্বাধীনতা দিবসেই মখ্যমন্ত্রীর হাতে মিউজিয়ামের সূচনা হতে পারে। আলিপুর সংশোধনাগারকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। আন্দামানের সেলুলার জেলের মতো এখানেও লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো চালু হবে। এই কারাগারে বন্দি থেকেছেন জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস থেকে শুরু করে বিধানচন্দ্র রায়ের মতো বিশিষ্টরা। তাঁরা জেলের যে সব কুঠুরিতে থাকতেন, সেগুলিকে আগেই হেরিটেজ ঘোষণা করে মূর্তি এবং স্মৃতিফলক বসিয়েছে রাজ্য সরকার। এবার লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের মাধ্যমে তাঁদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের অবদান তুলে ধরা হবে। প্রায় ৪০ মিনিটের এই শো শোনা যাবে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজিতে। ভাষ্যপাঠে থাকছেন খ্যাতনামা কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতার।
আরও পড়ুন-স্বাধীনতা-৭৫ আর জাতীয় পতাকা
ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম এলইডি লাইট। থাকবে লেজার লাইট, ডিমার, লেজার হাউজিং প্রোটেকশন কভার। সাউন্ডে ব্যবহার করা হবে মিক্সার অডিও ও ডিজিটাল সিগন্যাল প্রসেসর। মিউজিয়াম চালু হলেই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-ও শুরু হবে। আলিপুর জেলের ফাঁসিকাঠে মৃত্যুবরণ করেছিলেন দীনেশ গুপ্ত, প্রমোদরঞ্জন চৌধুরী, দীনেশ মজুমদারের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী। সেই ফাঁসির মঞ্চটিকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। এখানে যে ওয়াচটাওয়ার ছিল, সেটিকেও মেরামত করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে বাহারি আলো। মিউজিয়াম উদ্বোধনের দিন বন্ধ আলিপুর সংশোধনাগারের দেওয়ালে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাবনা মাথায় রেখে ছবি আঁকবেন শুভাপ্রসন্ন, যোগেন চৌধুরী-সহ ১০ জন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী। মুখ্যমন্ত্রীও অংশ নেবেন।
আরও পড়ুন-সীমান্তে শক্তি বাড়াতে অত্যাধুনিক রুশ বোমারু বিমান কিনছে ভারত
তবে রাজ্য সরকার বা তৃণমূল কংগ্রেসের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের কর্মসূচি শুধুমাত্র কলকাতা বা রেড রোডে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং জেলায় জেলায় এই উৎসবকে সমান ভাবে ছড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী। উত্তর থেকে দক্ষিণ, রাজ্যের প্রতিটি জেলাতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে একাধিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে ব্লক স্তর পর্যন্ত। বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের কর্মসূচির দিকে একবার তাকিয়ে দেখা যাক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মস্তিষ্কপ্রসূত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের কর্মসূচির মূল অঙ্গ ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ কর্মসূচি। স্বাধীনতা দিবসের দেশের প্রতিটি পরিবারকে জাতীয় পতাকা দিয়ে বাড়ি সাজানোর ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকায় রাস্তা অফিস বা বাড়ি সাজানো নতুন কিছু নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী নতুনভাবে এই কর্মসূচি পালনের ডাক দেওয়ায় সুবিধা পেয়েছেন বিজেপির একশ্রেণির নেতারা। সরকারি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তাঁরা নিজেদের পার্টি অফিসে রীতিমতো জাতীয় পতাকার দোকান দিয়ে বসেছেন। চলছে মুনাফার ব্যবসা।
আরও পড়ুন-ভারতের আপত্তি উড়িয়ে শ্রীলঙ্কায় আসছে চিনা নজরদারি জাহাজ
বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে এই ছবি দেখা গিয়েছে। কিন্তু যাঁদের ঘাম রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা, সেই বীর বিপ্লবী / স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রের কোনও কর্মসূচির কথা এখনও শোনা যায়নি। অনেকের মতে স্বাধীনতার ইতিহাসে নিজের পূর্বসূরিদের ভূমিকা চিরকালই বিজেপি তথা সংঘীদের একটু অস্বস্তিতে রাখে। যা দেশের জনমানসে এখনও তাজা। সেই অস্বস্তি ঢাকতেই স্বাধীনতার ইতিহাস চর্চার বদলে পতাকা বিলি আর ফেসবুকের প্রোফাইল ছবি বদলের লোক দেখানো সস্তা কৌশলের আড়ালে মুখ লুকানোর এই প্রয়াস।