রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরস্কার’ কবিতায় লিখেছেন,
অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,
নিশিদিন ধরে এ কি ছেলেখেলা!
নির্মলার বাজেট-দাঁড়িপাল্লায় এটাই প্রমাণিত হল। বাজেট বক্তৃতার আগের দিনই দেশের আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্টে দেশের বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, আর্থিক অসাম্য ও মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী কী করা প্রয়োজন বলা হলেও নির্মলার বাজেট প্রস্তাবে কার্যত তার নিরসন অধরাই থেকে গেল। কৃষি বাদে অন্য ক্ষেত্রে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৮০ লক্ষ চাকরি তৈরি, ধনী-দারিদ্রের আর্থিক বৈষম্য মোকাবিলায় কর-নীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, মূলবৃদ্ধি হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ করা, বেসরকারি শিল্পমহলকে নিজ দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান তৈরিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার আবশ্যকীয়তা সম্পর্কে আর্থিক সমীক্ষা রির্পোটে যা সুপারিশ করা হয়েছে নির্মলার বাজেট সেদিকে কোনও দিশা দিতে পারল না বলা যায়।
আরও পড়ুন-ফের বাজেটে ব্রাত্য চা-বলয়
যেখানে উঁচুতলার মাত্র ১ শতাংশ লোকের হাতে ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ কুক্ষিগত, দেশের মোট আয়ের ২২ শতাংশের বেশি কুক্ষিগত এবং অন্যদিকে নিচের দিকের ৫০ শতাংশ লোকের কাছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ রয়েছে এবং মোট আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশের মালিক, সেখানে সমাজ বিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেছিলেন দেশের ১৬৭টি সবচেয়ে ধনীতম ব্যক্তিদের উপর অন্তত দু’শতাংশ সম্পদ কর বসবে, উচ্চতম ১০ হাজার বড়লোকের উপর ১ শতাংশ-২ শতাংশ করা বসানো হবে। কিন্তু এই বাজেট সেটা হতাশ করল। এই অর্থ দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টিতে সকলের জন্য সরকারি বিনিয়োগ হলে দেশের কল্যাণ কিছুটা বাড়ত। কিন্তু নির্মলার বাজেটে যেটা ঘটল তাতে ধনী আরও ধনী হবে অর্থাৎ দেশে আর্থিক বৈষম্য আরও বেশি কুক্ষিগত হবে কতিপয় লোকের হাতে। কার্যত, ভারতে আর্থিক সমৃদ্ধির প্রায় সম্পূর্ণ সুবিধাবভোগী উপরের ১ শতাংশ ধনীরা।
দেশের তীব্র বেকার সমস্যা সমাধান কর্মসংস্থানের যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা আর্থিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে তার কোনও দিশা কার্যত, এ বাজেটে নেই। এই বাজেটে বলা হয়েছে আগামী ৫ বছরে দেশে ৪ কোটি ১০ লক্ষ চাকরি তৈরি হবে। অর্থাৎ প্রতি বছরে প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি ও সরকারি উভয়েরই বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিক চাকরি সৃষ্ট হয়। প্রথমত বেসরকারি বিনিয়োগে কোনও দিশা এই বাজেটে নেই।
গত ৯ বছরে মোদির আমলে ভারতের জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ক্রমশ কমছে। ২০১৫-১৬ সালে ২১.৩% থেকে ২০২৩-২৪ সালে এই অনুপাত ১৫.৩% নেমে এসেছে। বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উৎপাদন শিল্পে। গত অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় এই ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ ৮ লক্ষ কোটি টাকা কমেছে। অথচ দেখুন এই সরকার ২০১৯ সালে কর্পোরেট টাকা ৩০% থেকে ২২%-এ নামিয়ে এনেছে। প্রতি বছর এর ফলে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি পেয়ে চলেছে এই কর্পোরেটরা। অথচ এরা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে বিনিয়োগ ক্রমশ বাডি়য়ে চলেছে।
এবার আসা যাক সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাজেটে গত ৩ বছর ধরে ঢাক পেটানো হচ্ছে বাজেটে সরকারি মূলধনী ব্যয় অন্য কোন সরকারের তুলনায় বিপুলভাবে বাডি়য়ে চলেছে মোদি সরকার। এটা যে কত বড় ধাঁধাঁ তা সহজে মানুষ বুঝতে পারছে না। এই বাজেটে সরকারি মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছে ১১.১১ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু মোদির আমলে সরকারি ক্ষেত্রের উদ্যোগের (Public Sector Enterprises) বিনিয়োগ সমানভাবে কমেছে। ফলে চাকরিটা হবে কোথা থেকে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য থেকে আরও দেখা যাচ্ছে মোদির আমলে নিট আর্থিক পারিবারিক সঞ্চয়ের অনুপাত গত ৫ দশকের সবচেয়ে কম। ২০২২-২৩ আবহে নিট আর্থিক পারিবারিক সঞ্চয় জিডিপির মাত্র ৫.১ শতাংশ। অন্যদিকে গৃহস্থের অরক্ষিত পারিবারিক ঋণ জিডিপির প্রায় ৪০%। তাহলে চাকরিটা হবে কোথা থেকে?
এদিকে খাদ্য দারিদ্রতার সূচক ভারত বিশ্বের মধ্যে ক্রমশ নামতে নামতে প্রায় শেষের দিকে। ২০২৪ সালে খাদ্য-দারিদ্রতার সূচকে ভারত ৯২টি দেশের মধ্যে ৮৪তম স্থানে, এমনকী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নিচে। মর্মান্তিক অবস্থা শিশু-খাদ্যে দারিদ্রতায় ভারতে শিশু খাদ্য ও পুষ্টিতে দারিদ্রতার শিকার শতকরা ৭৬ জন। কেন খাদ্য ও পুষ্টিতে দারিদ্রতা বাড়ছে? বাজেটে তার উত্তর পাবেন। গত বছর সংশোধিত বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় ছিল ২.১২ লক্ষ কোটি টাকা। এবার সেটা কমিয়ে করা হয়েছে ২.০৫ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৯ হাজার কোটি টাকা। যা এই বছরের জিডিপির মাত্র ০.২৭ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির মাত্র ০.৩৭ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে অবস্থা খুবই শোচনীয়।
এবার আসা যাক বাজেটে আঞ্চলিক বৈষম্যের খতিয়ানে। নিম্নলিখিতভাবে ঢালাও বাজেটবরাদ্দ ঘটেছে এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে। অন্ধপ্রদেশ ও বিহারে বিভিন্ন প্রকল্পে ঢালাও বাজেট বরাদ্দ ধরেছে। বিশেষ প্যাকেজের নাম করে, পর্যটনের নাম করে, বিশেষ সড়কের নাম করে, বন্যার নাম করে, বিশেষ করে সেচ প্রকল্পের নাম করে, রেলওয়ে করিডোরের নাম করে অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহার ছাড়াও হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, অসম ইত্যাদি এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলোকে ঢালাও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গ এই বাজেটে সর্বদিক থেকেই অবহেলিত। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চলছে, না একনায়কতন্ত্রে মোদি সরকার চলছে? উত্তরটা পাঠকরাই দেবেন, আশা রাখি।