মিথ্যের বেসাতি আর কতকাল !

জ্যোতি মালহোত্রা কিংবা মহেন্দ্র প্রসাদ, দুজনের কেউই সংখ্যালঘু (minority) সম্প্রদায়ের মানুষ নন। দুজনের কাউকেই অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করা যাবে না। আর ওদিকে, উনিজি বলে চলেছেন এক ভুয়ো তত্ত্ব, আরএসএস নাকি দেশপ্রেমী সংগঠন! সত্যি নাকি? বিস্ময়ে কলম তুলে নিলেন অনির্বাণ সাহা

Must read

নাম জ্যোতি মালহোত্রা। পাকিস্তানের হয়ে চরবৃত্তির প্রমাণ মিলেছে হরিয়ানার এই নেটপ্রভাবীর বিরুদ্ধে। তাঁকে কাজে লাগিয়ে তথ্য হাতিয়ে নিয়েছেন পাকিস্তানের এজেন্টরা। এমনই তথ্য দিয়েছে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে ২৫০০ পাতার চার্জশিট পেশ করেছে তারা। সিট দাবি করেছে, জ্যোতিকে ‘টুল কিট’ হিসাবে ব্যবহার করেছে পাকিস্তান। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লাগাতার জ্যোতির কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছেন। জ্যোতিও পাক এজেন্টদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। সিটের দাবি, পাকিস্তান ভ্রমণের সময় এজেন্টদের সঙ্গে জ্যোতির যোগাযোগ ছিল। তাঁর ফোন থেকে উদ্ধার হওয়া তথ্য কিন্তু সে-দিকেই ইঙ্গিত করছে। দিল্লিতে পাক হাইকমিশনে কর্মরত দানিশ আলির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন জ্যোতি। তাঁদের দু’জনের কথোপকথনের তথ্যও পুলিশের হাতে এসেছে। শুধু দানিশ নয়, পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্ট শাকির, হাসান আলি এবং নাসির ধিঁলোর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল জ্যোতির। নাসিরের সঙ্গে জ্যোতির কথোপকথনের তথ্যও উদ্ধার করেছে পুলিশ। জ্যোতির ঘনঘন বিদেশযাত্রা নিয়েও চার্জশিটে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১৬ মে গ্রেফতার হন জ্যোতি। তার পর থেকেই বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন-বনমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে আবদার পড়ুয়াদেরও

রাজস্থানের এক যুবক, নাম মহেন্দ্র প্রসাদ। ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন সংস্থার (ডিআরডিও) জয়সলমেরের অতিথিশালার (গেস্ট হাউস) ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতেন মহেন্দ্র। ভারতের বেশ কিছু সংবেদনশীল তথ্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগ ছিল তাঁর। শুধু তা-ই নয়, ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কাজের বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্যও আইএসআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিবসে নাশকতা বা সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড যাতে না ঘটে, সেদিকে কড়া নজর রাখতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযানও চলছিল রাজস্থানে। সেই সময়ই নজরে আসে মহেন্দ্রর বিষয়টি। তাঁর বিরুদ্ধে গোপনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কিছু তথ্য মেলে। সেই সব তথ্যের ভিত্তিতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মহেন্দ্র জয়সলমেরের ডিআরডিও-র ওই অতিথিশালায় চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসাবে কাজে ঢুকেছিলেন। সামলাচ্ছিলেন ম্যানেজারের দায়িত্ব। কর্মসূত্রে জয়সলমেরে থাকলেও মহেন্দ্র আদতে উত্তরাখণ্ডের আলমোড়ার পালিয়ুনের বাসিন্দা। তদন্তে জানা গিয়েছে, সমাজমাধ্যমে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল মহেন্দ্রর। মহেন্দ্র তাঁর হ্যান্ডলারকে ডিআরডিও-র বিজ্ঞানী এবং ভারতীয় সেনার আধিকারিকদের গতিবিধি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতেন। উল্লেখ্য, ক্ষেপণাস্ত্র এবং নানা ধরনের অস্ত্র পরীক্ষার জন্য প্রায়শই ভারতীয় সেনার আধিকারিকেরা জয়সলমেরের চন্দন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ পরিদর্শনে আসেন। সেই সময় ওই গেস্ট হাউসেই থাকেন তাঁরা।
গ্রেফতারির পর নিরাপত্তা সংস্থাগুলি যৌথ ভাবে মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এখনও পর্যন্ত কী কী গোপন তথ্য তিনি পাচার করেছেন, তা জানার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি, তাঁর সঙ্গে আর কার কার যোগ রয়েছে, সেই তথ্যও খুঁজছেন তদন্তকারীরা। অভিযুক্তের মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
পহেলগাঁও-কাণ্ডের পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত। যদিও প্রথম থেকে নয়াদিল্লির দাবি অস্বীকার করেছে ইসলামাবাদ। সেই আবহে ভারত জুড়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের শনাক্তকরণের কাজ শুরু করে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি। পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার অভিযোগে গ্রেফতার হন অনেকেই। হরিয়ানার ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রার গ্রেফতারির পর পাক চরবৃত্তির বিষয় নিয়ে জোরকদমে তদন্ত এবং তল্লাশি অভিযান শুরু হয়। তার পর একে একে পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার অভিযোগে গ্রেফতার হন অনেকেই। এ বার সেই তালিকায় যোগ হল মহেন্দ্রের নাম।
এখন লক্ষ্য করার বিষয় দুটি।

আরও পড়ুন-বৃষ্টির অভাবে ধানচাষে ব্যাঘাত, পাশে কৃষি দফতর

এক, দুই গুপ্তচরের কেউ ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন।
দুই, দুজনের কেউই অনুপ্রবেশকারী নন।
প্রথমটি যদি হত, তবে হিন্দু খতরে মে আওয়াজ তুলে বিজেপি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা নেমে পড়ত মুসলমান বিতাড়নের কাজে। আর দ্বিতীয় কথাটি সত্য হলে, লালকেল্লার বুকে দাঁড়িয়ে মোদি যা বলেছেন, সেটা মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু দুটোর কোনওটাই ঘটেনি।
অর্থাৎ, সংখ্যালঘু নিধনের কোনও ইস্যু উঠে আসছে না। অনুপ্রবেশের তত্ত্বও জল মেশানো অপপ্রচার। ফলত, ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দিচ্ছে বিজেপি বেজায় ফাঁপরে। ঘুরিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে টার্গেট করতে গিয়ে ওরা এখন নিজেরাই বেকায়দায়।
সত্যি কথা বলতে কী, লালকেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি নিজেদের ভোট চুরি থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে গিয়ে মোদি, সোজা কথায়, ছড়িয়ে লাট করেছেন।
কী বলছেন উনি? আরএসএস ১০০ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও-র ভূমিকা পালন করে আসছে। আরএসএস নাকি মহাদেশপ্রেমী।
মেনে নিতাম মোদির মিথ্যে, যদি ইতিহাস না জানত, হেডগেওয়ার কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে এসে অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন। তিনি মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে একটাও বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন কি? সাভারকার মুক্তির পর ইংরেজ-বিরোধী অবস্থান আর গ্রহণ করেননি। ভাই পরমানন্দ একই পথে গেছেন। আশুতোষ লাহিড়ীও তাই। শ্যামাপ্রসাদ তো জেলেও যাননি। সংগঠন হিসেবে হিন্দু মহাসভা বা আরএসএস সক্রিয় ভাবে ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেছে এমন প্রমাণ নেই। দল হিসেবে করেনি। ব্যক্তি বিশেষ কংগ্রেসি আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন হয়তো। এঁরা সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছেন মুসলিম বিরোধিতায়। জিন্না ও তাঁর দলবল শক্তি ব্যয় করেছেন হিন্দু বিরোধিতায়। দুজনেই সমান দোষী।
ভাগ্যের বিড়ম্বনা যে এরাই আজ খাঁটি দেশভক্ত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মতবাদের যোগদান শূন্য। এই কথা জনে জনে প্রচার করা হোক।
মোদির ভোট চুরি নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, যদি ইতিহাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাত, বাংলার বিপ্লবীদের একাংশ পরবর্তীকালে হিন্দু মহাসভায় যুক্ত হন। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পুলিন দাস, মাখনলাল সেন, আশুতোষ লাহিড়ী প্রমুখ। মহাসভায় যুক্ত হওয়ার আগেই তাঁদের গৌরবময় বিপ্লবজীবনের সমাপ্তি ঘটে গেছে। এর পরে তাঁরা আর কোনও বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার অংশ হননি। উল্টে যুগান্তর দল তাঁদের থেকে এই কারণে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। বিবেকানন্দ-ভ্রাতা ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত স্বয়ং একথা লিখে গেছেন। শুধু তাই নয়, এঁরাই ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন দখল করে দেশবন্ধু প্রণীত হিন্দু-মুসলিম বা বেঙ্গল প্যাক্ট নাকচ করে বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চরম ক্ষতি করেন। এই হল বাংলার রাজনীতিতে গেরুয়াপন্থীদের একটি বিরাট অবদান।
এবং সেই সঙ্গে এই জিনিস যদি না দেখতাম, কেবল একটা বিধানসভার ডেটা বার করতে বিরোধী নেতার লাগল ছয় মাস। আর অনুরাগ ঠাকুর ছটি লোকসভার ডেটা নিয়ে চার দিনে হাজির প্রেসের সামনে? কোথা থেকে পেল? অর্থাৎ নির্বাচনী কমিশন বিজেপি-কে এসব ডেটা সাপ্লাই করছে, কেবল বিপক্ষের বেলায় চুপ।
অনুরাগ ঠাকুর অবশ্য সেম সাইড গোল দিয়ে বসলেন শেষ পর্যন্ত। আর আমাদের মোদিজি পাগড়ি পরে লালকেল্লা থেকে যথারীতি ভাট বকে পালিয়ে গেলেন।
বলা বাহুল্য, পিকচার অভি বাকি হ্যায়।

Latest article