আর কতদিন এভাবে চলবে?

ভারতীয় রেলের অন্তর্জলি যাত্রা প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছেন বর্তমান রেলমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদির জমানায় রেল চূড়ান্ত অব্যবস্থার সম্মুখীন। মৃত্যুর খতিয়ানে উন্নয়ন! এ আবার হয় নাকি! লিখছেন জিয়ান কর্মকার

Must read

১৭২ বছরের ঐতিহ্যকে সাথী করে ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থাকে উল্লেখযোগ্য আকার দিয়েছে ভারতীয় রেল। ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল সাহিব, সুলতান এবং সিন্ধু নামে তিনটি লোকোমোটিভ দ্বারা পরিচালিত ভারতীয় রেল বরিবন্দর (বোম্বে) এবং থানের মধ্যে প্রথম যাত্রিবাহী রেল চলাচল করলেও, রেলপথের সূচনাটা আরও ১৬ বছর আগে ১৮৩৭ সালে মাদ্রাজে বাষ্পচালিত রেল চালুর মাধ্যমে। যত দিন গেছে ভারতীয় রেলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯০১ সালে রেলওয়ে বোর্ডের প্রতিষ্ঠা রেলের কার্যক্রমকে আরও উন্নত করেছে।

আরও পড়ুন-বিধানসভায় ঢোকার আগে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা মুখ্যমন্ত্রীর, স্কুল সংস্কারে সাহায্যের আশ্বাস

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতীয় রেলওয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক এবং এটি প্রায় ১.২ লক্ষ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। তবে বিগত কয়েক বছরে বারংবার দুর্ঘটনার কারণে ভারতীয় রেলওয়ে এখন সংবাদ শিরোনামে। ২০২১ থেকে ২০২৫-এ রেল দুর্ঘটনার কিছু তথ্য তুলে ধরা যাক, ২০২১ সালে ১৭ জানুয়ারি কেরলের ইদাভাই রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ভারকালা এবং পারাভুরের মাঝে মালাবার এক্সপ্রেসের পণ্যবাহী কামরায় আগুন ধরে যায়, সৌভাগ্যক্রমে কোনও প্রাণহানি ঘটেনি। ২০২১ সালে ৭ মে তেলেঙ্গানার মেহবুবাবাদ স্টেশনের কাছে কোনার্ক এক্সপ্রেসের ধাক্কায় দুই রেলকর্মীর মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে ১ জুন দক্ষিণ রেলের আম্বুর স্টেশনের কাছে সিগন্যাল মেরামত করার সময় মালগাড়ির ধাক্কায় দুই রেলকর্মীর মৃত্যু হয়৷ ২০২১ সালেই ২৫ অগাস্ট লাইনচ্যুত হয় গুয়াহাটি-হাওড়া সরাইঘাট কোভিড স্পেশাল ট্রেন। ২০২২ সালে ১৩ জানুয়ারি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিকানের গুয়াহাটি এক্সপ্রেস, তাতে মৃত্যু হয়েছিল ৯ জন যাত্রীর, আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন যাত্রী। ২০২২ সালে ২৫ মার্চ মুম্বই-নয়াদিল্লি দুরন্ত এক্সপ্রেসের ধাক্কায় দুই রেলকর্মীর মৃত্যু হয়। ২০২৩-এর ২ জানুয়ারি লাইনচ্যুত হয় সূর্যনগরী এক্সপ্রেস, তাতে আহত হন ১০ জন যাত্রী। ২০২৩- এর ১৫ মে চেন্নাই বেঙ্গালুরু ডাবল ডেকার এক্সপ্রেসের কামরা লাইনচ্যুত হয়। ২০২৩- এর ২ জুন ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা ৭টা, ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানাগায় মালগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হয় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের, তাতে প্রাণ যায় ৩০০ জনের কাছে, আহত হয়েছিল প্রায় ১২০০ জন। ২০২৩-এর ৭ জুলাই তেলেঙ্গানার ইয়াদান্ডি-ভুবনগিরি জেলায় হাওড়াগামী ফলকনামা এক্সপ্রেসের তিনটি কামরায় আগুন লেগেছিল। ২০২৩-এর ১১ অক্টোবর নর্থ-ইস্ট এক্সপ্রেসের দুটি কামরা লাইনচ্যুত হয়, সেখানে ৪ জন যাত্রী প্রাণ হারান এবং আহত হন কমপক্ষে ৭০ জন। ২০২৩-এর ২৯ অক্টোবর অন্ধ্রের কোট্টাডালনা স্টেশনের কাছে বিশাখাপত্তনম রায়গদা এবং বিশাখাপত্তনম পালাসা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সংঘর্ষে প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু ও কমবেশি ৫০ জন আহত হন। ২০২৪-এর ১৬ জুন ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৯টা, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, রাঙাপানি স্টেশনের কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস মালগাড়ির পিছনে ধাক্কা মারে তাতে মৃত্যু হয় কমবেশি ৮ জন যাত্রীর এবং আহত হন বহু যাত্রী।

আরও পড়ুন-কাগজ ছোড়া : জবাব মুখ্যমন্ত্রীর

এই বছরে ২২ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের জলগাওঁ-এর কাছে পুষ্পক এক্সপ্রেসে আগুন আতঙ্কে লাইনে ঝাঁপ দেন কিছু যাত্রী তাতে উল্টো দিক থেকে আসা কর্নাটক এক্সপ্রেসের ধাক্কায় চোখের নিমিষে ১৭ জন যাত্রী প্রাণ হারান এবং আহত হন আরও ১২ জন। ২০১৪-’২৪ ভারতীয় রেলের প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬৭৮টি, অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর ৬৮টি। যদি আমরা শেষ ৫ বছর দেখি তাহলে (২০২৩-২৪ এর আগস্ট) এই পর্যন্ত দুর্ঘটনার সংখ্যা যথাক্রমে ৫৫, ২২, ৩৫, ৪৮ ও ৪০টি। যেখানে দেখানো হচ্ছে ২০২৩-’২৪ সালে রেকর্ড ২৫৬৬৯৩ কোটি টাকা আয় হয়েছে রেলওয়ে থেকে, সেখানে যাত্রী সুরক্ষায় কি জোর দেওয়া হচ্ছে?
কবচ সিস্টেমে ৪.০ RDSO (Research Design Standard Organisation) approved করেছে তাতে দেখানো হয়েছে ২০২৪-এ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১২১৬.৭৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, আয়ের সঙ্গে সুরক্ষা ক্ষেত্রে এই খরচ কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? তা কিন্তু আমাদের ভেবে দেখা দরকার। ১৯৯৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেলের উন্নয়নে এক অভূতপূর্ব জোয়ার এসেছিল। রেলমন্ত্রী হিসেবে দুই দফায় প্রায় ৫ বছরের দায়িত্বে রেলের যে দস্তুর, ভাড়া বাড়িয়ে রেলে রোজগার বাড়ানোর রীতি, তা তিনি বদলে রেলের অভ্যন্তরীণ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে রেলকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিলেন এবং সেই কাজে তিনি সফলও হয়েছিলেন। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি বারংবার যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টি তিনি গুরুত্ব সহকারে দেখেছিলেন। আ্যন্টি কলিশন ডিভাইস যন্ত্র কিন্তু তাঁর আমলেই প্রথম ব্যবহার হয়। বলে রাখা ভাল তাঁরই সময়কালে রাজধানী এক্সপ্রেস, দুরন্ত এক্সপ্রেসের মতো উন্নত ট্রেন ভারতীয় রেলওয়ে পেয়েছে। কলকাতা মেট্রোরেলের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ তাঁর আমলেই। বিগত কয়েকবছরে ভারতীয় রেলের পরিষেবা আরও উন্নত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে ঠিকই কিন্তু যাত্রীদের দুর্ঘটনার স্মৃতি আজও কিন্তু অমলিন। উন্নত মানের কোচ, GPS System, CCTV-এর মোড়ক সত্ত্বেও দুর্ঘটনা কমার কিন্তু কোনও লক্ষণ নেই। এরপর এখন যোগ হল দিল্লি স্টেশনে কুম্ভমেলায় যাওয়ার সময়ের দুর্ঘটনা, রেল প্রশাসনের কাছে আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও চরম অব্যবস্থায় পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল প্রায় ১৮ জন যাত্রীর এবং আহত আরও অনেকে।

আরও পড়ুন-বিধানসভায় ঝোড়ো ব্যাটিং মুখ্যমন্ত্রীর, কুৎসার কড়া জবাব ঢালাও উন্নয়নের তালিকা

যতদিন যাচ্ছে যাত্রী-ভাড়া পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে যাত্রী সুরক্ষা। এখন আর আলাদা করে রেল বাজেট হয় না, সুতরাং রেলের উন্নয়নে কোন খাতে কত বরাদ্দ হল তা আর জানতে পারে না সাধারণ মানুষ। বিগত সময়ে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে রেলমন্ত্রীরা রাজ্যগুলিকে নানান নতুন নতুন ট্রেন উপহার দিতেন, কিন্তু ইদানীং সময়ে সেই প্রচলনও অবলুপ্তির পথে। বন্দে ভারত চালু হওয়ার পর তার করুণ পরিস্থিতিও আমরা চাক্ষুষ করছি, কখনও ছাদ থেকে জল পড়ছে তো কখনও গাছ পড়ে ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন দুর্ঘটনার খবরে রেলযাত্রীরা শিউরে উঠলেও যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলের বিকল্প কিন্তু রেলই। সুতরাং যতদিন যাচ্ছে যাত্রীরা চরম উৎকণ্ঠায় ও ভয়ের বাতাবরণে রেলভ্রমণ করছেন।

Latest article