আর কত কাল চলবে এই মিথ্যার বেসাতি ?

মোদির ভারত মানে কি মিথ্যার ভারত? সবই তো মুখের কথা। পশ্চিমবঙ্গের ১২ হাজার ৯১৮টি সরকারি স্কুলে রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ। অন্যদিকে দেশের মোট ১০ লক্ষ ২২ হাজার ৩৮৬টি সরকারি স্কুলের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে মাত্র ২ লক্ষ ৪৭ হাজার বিদ্যালয়ে। অর্থাৎ, মাত্র ২৪.১৬ শতাংশে। লিখছেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

আচ্ছে দিন। নতুন ভারত। ডিজিটাল ইন্ডিয়া। এবং সবটাই প্রচারসর্বস্ব। ফ্লপ। কারণ, এর বাস্তব রূপ দেখার সৌভাগ্য হয়নি দেশবাসীর। অনলাইন লেনদেন নিয়ে বিপুল চর্চা মানেই কিন্তু তা সফল নয়! কারণ, এই ধরনের ‘যুগান্তকারী’ উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করে সমাজের ভিতের উপর। অর্থাৎ শিক্ষা। আর নরেন্দ্র মোদির এই সাধের স্লোগানের ছিটেফোঁটাও পৌঁছয়নি দেশের সিংহভাগ স্কুলে। সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারই জানিয়েছে, ভারতের ৭৬ শতাংশ সরকারি স্কুলে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। সংখ্যার বিচারে ৭ লক্ষ ৭৫ হাজার ৩৮৬টি। সমাজ গড়ার কারিগর তৈরি হয় বিদ্যালয়ে। আর সেখানেই যখন ন্যূনতম ইন্টারনেট পরিষেবা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে কীসের সফল ডিজিটাল ভারত?

আরও পড়ুন-হিমাচলে বেড়াতে গিয়ে মৃত্যু বাংলার যুবকের

এই মুহূর্তে দেশের কতগুলি সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। তারই লিখিত জবাবে কেন্দ্রীয় শিক্ষা রাষ্ট্রমন্ত্রী জয়ন্ত চৌধুরীর পেশ করা পরিসংখ্যানে চোখ কপালে উঠেছে শিক্ষা মহলের। উদ্বেগের ভাঁজও বেড়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট ১০ লক্ষ ২২ হাজার ৩৮৬টি সরকারি স্কুলের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে মাত্র ২ লক্ষ ৪৭ হাজার বিদ্যালয়ে। অর্থাৎ, মাত্র ২৪.১৬ শতাংশ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বহু বিজেপি শাসিত রাজ্যেই সরকারি স্কুলে ইন্টারনেট সংযোগের হার জাতীয় গড়ের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে কম। যেমন, উত্তরপ্রদেশে মাত্র ৮.৮১ শতাংশ, ত্রিপুরায় ১৬ শতাংশ, উত্তরাখণ্ডে ১৫.৬২ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ১৭.৭৭ শতাংশ, অসমে ১০.২৯ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। আর এক ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্য বিহারের সরকারি স্কুলে এই হার মাত্র ৫.৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ, কেন্দ্রের যে বিজেপি সরকার ডিজিটাল ইন্ডিয়া নিয়ে প্রবল ঢাকঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে, সেই গেরুয়া শিবিরই ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলিতে তা বাস্তবায়িত করতে হিমশিম খাচ্ছে। এরই পাশাপাশি কেন্দ্রীয় শিক্ষা রাষ্ট্রমন্ত্রীর সংসদে পেশ করা রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে দেশের বেসরকারি স্কুলগুলির পরিস্থিতি তুলনায় ঢের ভাল। কারণ, সারা দেশে বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ৮৪৪টি। এর মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে ২ লক্ষ ২৭৪টিতে। অর্থাৎ, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ বেসরকারি স্কুলই ইন্টারনেট পরিষেবা পায়। তার মানে কি সরকারি বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা সার্বিক পরিকাঠামো থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে? এই প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই রীতিমতো চর্চা শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের ১২ হাজার ৯১৮টি সরকারি স্কুলে রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ। রাজ্যের এমন বেসরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫৬৫টি। শিক্ষামন্ত্রকের পরিসংখ্যানেই এর উল্লেখ রয়েছে।

আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগরের প্রস্তুতি বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী, একগুচ্ছ নির্দেশ

‘ভারত নাকি আরও আধুনিক। মোদি জমানায় আরও উন্নত।’ একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি বোঝা যাবে। ২০১৯-২০ আর্থিক বছর থেকে রেলের ডিজেল ইঞ্জিনের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করে শুধুই ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এমন গালভরা দাবি করেছিল কেন্দ্রের মোদি সরকার। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত রেলের বিভিন্ন লোকোমোটিভ কারখানায় যত ডিজেল ইঞ্জিন তৈরি হয়েছে, তাতে কি মিশেছে দুর্নীতির গন্ধ? কারণ, মোদি জমানাকেই কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি। গত ১২ ডিসেম্বর সংসদে পেশ করা তাদের রিপোর্টে সরাসরি নিশানা করা হয়েছে নরেন্দ্র মোদির প্রথম ইনিংসকে। রেল ইঞ্জিন দুর্নীতির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে সেখানেই। বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার হিসেব-বহির্ভূত পেমেন্টের হদিশও মিলছে।
ডিজেল ইঞ্জিন তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘চ্যানেল এয়ার বক্স’ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সরবরাহ করতে না পারায় প্রথমে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে চুক্তিই একপ্রকার বাতিল করে দিয়েছিল রেলের বারাণসী লোকোমোটিভ ওয়ার্কস (বিএলডব্লু)। তখন এর নাম ছিল ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কস (ডিএলডব্লু)। দেরিতে সাপ্লাই আসায় ওই উপাদান গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, পরে কোনও অজানা কারণে ফের সরবরাহের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেটেরিয়াল, যা কয়েকদিন আগেই বাতিলের খাতায় চলে গিয়েছিল, তা নিয়ে নেয় রেল। এর জন্য আলাদাভাবে পেমেন্ট করা হয় কয়েক কোটি টাকাও। যাবতীয় প্রশ্ন এখানেই। প্রথমত, চুক্তি বাতিল হওয়ার পর হঠাৎ কার নির্দেশে পুনর্নবীকরণ হল? সাপ্লাইয়ের সময়সীমাই বা বাড়ল কীভাবে? দ্বিতীয়ত, ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকার হিসেব-বহির্ভূত (ইররেগুলার) পেমেন্ট। এই পেমেন্ট যদি বাড়তি হয়, তাহলে তা কার নির্দেশে হয়েছে? আম জনতার করের টাকা তো খোলামকুচি নয় যে, যাকে খুশি দিয়ে দেওয়া যাবে! সংসদে পেশ করা রিপোর্টে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি সাফ জানিয়েছে, কার নির্দেশে কেন এভাবে সময়সীমা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তা জানতে কোনওরকম পদক্ষেপ নেয়নি রেলমন্ত্রক। এক্ষেত্রে একমাত্র লাভ হয়েছে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সরবরাহকারী সংস্থাটির। সময়সীমা পেরনোর পর সাপ্লাই দেওয়া সেই উপাদান গ্রহণ না করায় প্রথমে বিপুল আর্থিক লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। তা ভরপাই করতেই কি হিসেব-বহির্ভূত পেমেন্ট? এই প্রশ্নের ভিত্তিতেই পিএসি’র উল্লেখ, বেনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা পুরোমাত্রায় রয়েছে।

আরও পড়ুন-উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী, ক্রিসমাস উৎসব শুরু হবে ১৯ ডিসেম্বর

উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই ব্যাপারে রেলমন্ত্রকের ‘অ্যাকশন টেকেন রিপোর্টে’ও বিশেষ সন্তুষ্ট হয়নি ওই সংসদীয় কমিটি। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালের মে মাসে ৬৬০টি চ্যানেল এয়ার বক্স কেনার বরাত দেওয়া হয় ওই বেসরকারি সংস্থাকে। চুক্তি অনুযায়ী স্থির হয়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সেগুলি সরবরাহ করতে হবে রেলকে। কিন্তু আদতে তা এসে পৌঁছয় আরও ছ’মাস পর। অর্থাৎ, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। সরবরাহের সময়সীমা পূরণ করতে না পারায় প্রাথমিকভাবে তা ‘রিজেক্ট’ করে বিএলডব্লু। এরপরই নতুন ট্যুইস্ট! ঘটনার এক বছর পর, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বিএলডব্লু তার সিদ্ধান্ত পাল্টায়। ‘রেট্রোস্পেকটিভ’ সিদ্ধান্ত মতো সরবরাহের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ৩৬ শতাংশ ছাড়-সহ ‘রিজেক্ট’ করা সমস্ত চ্যানেল এয়ার বক্স ‘ছাড়’ পায়। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় রেল জানায়, ২০১৮ সালের ১ জুন ‘জয়েন্ট প্রসিডিওর অর্ডার’ (জেপিও) মেনেই সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল। এতেও সন্তুষ্ট হয়নি সংসদীয় কমিটি। নতুনভাবে পর্যালোচনারও সুপারিশ করেছে তারা।
মোদির ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’র ঢক্কা-নিনাদ নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। নতুন ভারত। মোদির ভারত। এবার কি রেল ইঞ্জিন দুর্নীতির ভারত?

Latest article