জিডিপি (GDP-India) বাড়লেই নাকি দেশের উন্নতি! কর্মসংস্থান নাকি এতেই বাড়বে। সত্যি কি তাই?
মানুষের হাতে টাকা থাকলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার পর তারা তা ভোগ্যপণ্যের পিছনে খরচ করে। ভোগ্যপণ্যের স্থিতিশীল মার্কেট একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে জরুরি। মানে, চাল-ডাল, ফোন বা কেবল টিভির বিল, যাতায়াতের খরচ, বাড়িভাড়া, ডাক্তার-ওষুধের পিছনে টাকা ঢালার পর কিছু যদি বেঁচে থাকে তা যায় ভোগ্যপণ্যে। এই ধরনের জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়লে সংস্থাগুলি তাদের উৎপাদন বাড়ায়। তখনই কর্মসংস্থান বাড়ে।
কিন্তু সেই প্রবণতা মোদির ভারতে কোথায়? হোটেল, পরিষেবা ক্ষেত্র, নির্মাণ, কৃষি, এমনকী খনিজ শিল্পের থেকেও কিন্তু ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের বৃদ্ধির হার কম। মানেটা খুব পরিষ্কার— মানুষের হাতে টাকার জোগান নেই। তাই বাজার অর্থনীতি থমকে গিয়েছে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক কারখানা। বাড়ছে প্রতারণার সংখ্যা। সাধারণ চুরি-ডাকাতি এখন ব্যাকডেটেড। ডিজিটাল ফ্রডই ভারতের বর্তমান এবং আগামী।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে পারিবারিক দেনার হার বেড়ে হয়েছে জিডিপির (GDP-India) ৩৭.৬ শতাংশ। পাঁচ বছরের মধ্যে সঞ্চয় সর্বনিম্ন। হবেই তো। মোদি-শাসিত ভারতে এটা খুবই স্বাভাবিক। ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ গত পাঁচ বছরে প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে, চিকিৎসার খরচ হয়েছে দ্বিগুণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের এখন আকাশছোঁয়া দাম। গত ন’বছরে কর্পোরেট সংস্থাগুলি যে পরিমাণ ছাড়ের সুবিধা পেয়েছে, যত হাজার কোটির অনাদায়ী ঋণ মকুব করা হয়েছে, তার ফলে স্রেফ তেলা মাথায় তেল পড়েছে, আর সাধারণ মানুষের ভাঁড়ার শূন্য। এটাই মোদির অর্থনীতি। ভোটের দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ১০ লক্ষ চাকরি হবে। তিনি রোজগার মেলা করছেন। নিয়োগের পরিসংখ্যান বাড়ছে। কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন, আমাদের দেশে পাশ-করা গ্র্যাজুয়েট যুবক-যুবতীর সংখ্যা কত? ১২ কোটির বেশি। তার মধ্যে বেকার কতজন? প্রায় ৫ কোটি ৯২ লক্ষ। তাহলে ১০ লক্ষ চাকরি দিয়ে কী হবে? বেকারত্ব বাড়ছে। বাড়বে। জিডিপির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। আর মোদি সরকার লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে নোট বাতিলে, জিএসটিতে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়, আর অবশ্যই অমৃতকালে। কী এই অমৃতকাল? নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর দেশ কত উন্নত হয়েছে, তার খতিয়ান। পেটে খিদে চেপেই মানুষ দেখবে তাঁদের প্রধানমন্ত্রীকে, শুনবে তাঁর প্রচার। আর ভারত পৌঁছে যাবে অর্থনীতির খাদের কিনারায়। সুহার্তোর শাসনে ইন্দোনেশিয়ার যা পরিণতি হয়েছিল, কিংবা হু জিনতাওয়ের ক্ষমতাকালে চিনের, ভারত আজ সেই পথের যাত্রী। মাইক্রো ইকনমির দিকে জোর দিতে গিয়ে বাজার অর্থনীতি আজ প্রায় পঙ্গু।
আগে মানুষ চোর-ডাকাতদের ভয়ে টাকা, সোনা ঘরের মেঝেয়, দেওয়ালে গর্ত করে হাঁড়ির মধ্যে রেখে দিত। ডাকাতরা গৃহস্থকে মারধর করে গর্ত খুঁড়িয়ে সেসব লুট করত। ফলে অবস্থাপন্নরা রাত হলেই ডাকাতির আতঙ্কে ভুগত। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করায় দেশবাসী আর নিশ্চিন্ত হয়েছিল। চালু হল লকার। বাড়ির সোনার গয়না ঢুকে গেল ব্যাঙ্কের সুরক্ষিত ভল্টে। ব্যাঙ্ক যখন ছিল না তখন আতঙ্ক ছিল কেবল রাতটুকুর। ভোরের আলো ফুটলেই সেই ভয় দূর হত। ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র চক্করে পড়ে আতঙ্ক হয়ে গেল দিনরাতের। কিন্তু ব্যাঙ্কের সুরক্ষিত টাকা কেন আজ অরক্ষিত? কেন মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রেখেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না?
আরও পড়ুন- ভারত প্যালেস্তাইনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে : বিদেশ মন্ত্রক
এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? অবশ্যই নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪ সালে সুইস ব্যাঙ্কের ‘কালা ধন’ ফিরিয়ে আনার গল্প শুনিয়েই তিনি নির্বাচনে বাজিমাত করেছিলেন। কালো টাকা ফেরানো, ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা শোধ না করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া মেহুল চেকসি, নীরব মোদিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। পারবেনও না। তাই তিনি ব্রতী হলেন দেশের অন্দরে ‘কালো টাকা’ দমনে। বের করা হল নতুন রাস্তাও। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে আধারকার্ড। বলা হল, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধারকার্ড যুক্ত না করলে গ্যাসের ভর্তুকি মিলবে না। সেই সময় সিলিন্ডার-পিছু ভর্তুকির পরিমাণটা ছিল ২০০ টাকার বেশি। এখনকার মতো পিঁপড়ের পিছন টিপে ১৯ টাকা দিত না। এই ঘোষণামাত্র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধারকার্ড লিঙ্ক করার ধুম পড়ে গেল। তারপর এল আধারের সঙ্গে প্যানকার্ড যুক্ত করার ফরমান। এক্ষেত্রেও সরকার সেই ‘কুমিরের ছানা’ কালো টাকা। বলা হল, উভয় কার্ডের মধ্যে লিঙ্ক হলেই সরকার বুঝে যাবে, একজনের কতগুলো অ্যাকাউন্ট আছে। তাতেই জানা যাবে, জমা টাকার পরিমাণ কত? ফলে কেউ আর ‘কালা ধন’ লুকিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারি নির্দেশ অমান্য করলে ধার্য হল জরিমানা, ১০০০ টাকা। ফাইন আর ফি মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘরে ঢুকল মোটা টাকা। সেই সঙ্গে উন্মুক্ত হয়ে গেল আম জনতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সাফা করার রাস্তাও।
তবে, সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হল কার্ডলেস ক্যাশ সিস্টেম চালুতে। যার পোশাকি নাম আধার এনাবেল পেমেন্ট সিস্টেম (এইপিএস)। এই পদ্ধতিতে কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্টে আঙুলের ছাপ দিয়ে দিনে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত তোলা যায়। আর মোবাইল লিঙ্ক না থাকলে মেসেজও যাবে না। আগে কেবল ওটিপি শেয়ার করলে টাকা গায়েব হত। এখন টাকা-চোরেরা ওসবের ধারই ধারছে না। জমির দলিলে কিংবা সিম কার্ড নেওয়ার সময় দেওয়া আঙুলের ছাপ ক্লোন করে তুলে নিচ্ছে টাকা। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করার জন্য অপরাধীরা রীতিমতো গবেষণা চালাচ্ছে। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশের প্রধানমন্ত্রী নতুন সিস্টেম চালু করলে তার সুরক্ষা নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়। তার উপর তিনি এমন প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজেকে কখনও চৌকিদার, কখনও পাহারাদার বলেন। প্রয়োজন পড়লে ৫৬ ইঞ্চি ছাতির কথাও মনে করিয়ে দেন। আবার ‘গ্যারেন্টার’ও হয়ে যান। সেই চৌকিদারের আমলে চালু হওয়া সিস্টেমেই আমজনতার সুরক্ষিত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও হয়ে গিয়েছে ‘চিচিং ফাঁক’! এটাই মোদিজির স্টাইল।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই মোদি-শাসিত দশা!