আরজি কর কাণ্ডের পর একটি বছর অতিক্রান্ত।
নৃশংস ঘৃণ্য ঘটনা। সমর্থনের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সেই সময়টা উত্তাল হয়েছিল যেসব ইন্ধনের প্ররোচনায়, সেইসব ফুলকিগুলোকেও তো চেনা গেল না এই এক বছর ধরে।
যেমন, ধরা যাক, ‘সোমা’ প্রসঙ্গ।
এক বছর আগে ঘন ঘন ভেসে আসত সেই কণ্ঠ। মোবাইলে মোবাইলে শুনেছি, ‘‘…আমি সোমা বলছি…!’’
সোমা বলেছিলেন, তাঁর পুরো নাম সোমা মুখার্জি। দাবি করেছিলেন, আরজি কর হাসপাতালের ভিতরেরই একজন তিনি। তাঁর সৌজন্যেই পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকানে গুলতানিতে উঠে এসেছিল নানা কথা, যেগুলোর সব ক’টাই তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। যদিও কেউ কেউ আবেগের তাড়নায় বলছেন, তদন্তে বিষয়গুলো উপেক্ষিত।
আরও পড়ুন-শুল্ক-হুমকির মুখে মোদি-পুতিন কথা, বাণিজ্যসম্পর্ক বহাল থাকবে
সোমা যে গুজবগুলো ছড়িয়েছিলেন সেগুলোর মধ্যে ছিল, নির্যাতিতারই সাত-আট জন সহ-চিকিৎসক সেদিনকার ঘটনার জন্য দায়ী। তাঁদের মধ্যে এক তরুণীও ছিলেন। আগে ভাগে প্ল্যান করে তাঁরা এই অপকর্মটি করেছিলেন। নির্যাতন করে খুনের আগে এঁরা সকলে মিলে মদ্যপান করেছিলেন। ধর্ষণের সময় নিহত ডাক্তার মেয়েটির দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরতে নাকি সাহায্য করেছিলেন ওই তরুণী ডাক্তারই।
সোমাই প্রথম ছড়ায় পেলভিক বোন, কলার বোন ভাঙার আখ্যান। বলে, নির্যাতিতার মাথাও নাকি থেঁতলে দেওয়া হয়। শারীরিক অত্যাচারের পরে ধর্ষিতার দু’পা দু’দিকে টেনে চিরে ফেলার চেষ্টা হয়।
এসব কিন্তু কিছুই হয়নি, বলছে ময়নাতদন্তের রিপোর্টও।
সুর করে করে শিহরন জাগিয়ে সোমা বলেছিলেন, বিশ্বাস করিয়েছিলেন এক শ্রেণির নাগরিককে, যারা কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াই প্রচার করেছেন, সঞ্জয় রায় সেমিনার রুমে গিয়ে ‘ডেডবডিকে রেপ’ করেন।
প্রথমে পুলিশ এবং পরে সিবিআইয়ের তদন্তের ফল এ-সবের ধারকাছ দিয়েও যায়নি। হ্যাঁ, আবারও বলছি, জোরের সঙ্গে বলছি, পুলিশি তদন্ত কিংবা সিবিআই তদন্ত, কোনওটাতেই এসবকিছু উঠে আসেনি। এসবগুলোর সমর্থন সূচকও কিছু উঠে আসেনি।
একটি ছোট্ট লেখা ছড়িয়ে দেওয়া হয় সোমার তরফে। ছ’জনের তালিকা। এই ‘ষড়-যন্ত্রী’-দের প্রত্যেকেই আরজি করের সিনিয়র বা জুনিয়র চিকিৎসক।
নাহ্! এটাও অপ্রমাণিত এবং সর্বৈব মিথ্যা।
ঘটনার এক বছর পর, সেদিনকার আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তার থেকে শুরু করে রাত দখলের আহ্বায়িকা, সবাই বলছেন, সংবাদমাধ্যমের কাছে চুপিচুপি বলছেন, ‘সোমার অডিও ক্লিপিং শুনেছিলাম, কিন্তু খুব একটা বিশ্বাস করিনি। কনস্পিরেসি মনে হয়েছিল।’ কিন্তু এতদিন তো এসব কেউ বলেননি। মানুষকে জানাননি। মুখ বুজে ওই গুজব ওইসব অপপ্রচারে মদত দিয়েছিলেন।
কেন? কোন বাস্তুঘুঘুদের মদত দেওয়ার অভিপ্রায়ে মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন? কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এখনও নির্যাতিতার বাবা-মাকে মিথ্যে কথা বলে উসকাচ্ছেন? কোন কায়েমি স্বার্থ আপনাদের নীরব থাকতে প্রণোদিত করেছিল?
আন্দোলনের সামনের সারির মুখরা আজ বলছেন, ‘সোমাকে চিনি না। ওই অডিয়ো ক্লিপের দুই থেকে তিন সেকেন্ড শুনলেই বোঝা যায় অবাস্তব।’
কিছুক্ষণেই যা বোঝার সেটা বুঝে গিয়েছিলেন যাঁরা কয়েক সেকেন্ডে, তাঁরা এত দিন এ নিয়ে টুঁ শব্দটাও করেননি।
আরও পড়ুন-বাংলার মনীষীদের ছবি আঁকা ব্যাজ নিয়ে প্রবেশে বাধা কেন? ঋতব্রত
এখন বলছেন, ‘ভক্তি আর অতিভক্তির মধ্যে পার্থক্য থাকে। এই ধরনের অডিয়ো কোনও বিষয়কে যেভাবে অতি ভয়াবহ করার চেষ্টা করে, তাতে ক্ষতি হয়। আমরা সমর্থন করিনি এটা। অতিরঞ্জিত যে কোনও বিষয় থেকেই আমরা দূরে থেকেছি।’
সত্যি? গুজব থেকে নিজেদের বিযুক্ত করার কোনও প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ তো নেননি আপনারা, অন্তত প্রকাশ্যে।
কেন? দ্রোহ বেচে দু পয়সা কামানোর তাগিদে?
আর আপনি? ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী? ঘণ্টাখানেকের আসরে সবচেয়ে বিক্রীত পণ্য ছিল আপনার মিথ্যে কথাগুলো। গণধর্ষণের প্রমাণ খাড়া করার জন্য আপনিই না রটিয়েছিলেন, আরজি করে নির্যাতিতার শরীরে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়া গিয়েছে!
সে-কথার প্রতিবাদও করেননি আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। কেন? সাধারণ মানুষের কাছে তো তুলে ধরেননি শারীর বিজ্ঞানের সত্যিটা।
বলেননি, বীর্যের ক্ষেত্রে তরলের একক মিলিলিটার ব্যবহার হওয়ার কথা, গ্রাম নয়।
বলেননি, একটি পুরুষ শরীর থেকে প্রতি বার বীর্যপাতে ১.৫-৫ মিলিলিটার বীর্য নিঃসরণ হতে পারে। অর্থাৎ, ঘটনাস্থলে ১৫০ মিলিলিটার বীর্য পেতে ধর্ষকের সংখ্যা অন্তত ৩০ জন হতে হবে।
আসল দোষীদের চিহ্ন মুছে ফেলতে আরজি করের সেই ঘটনাস্থল অ্যাসিড দিয়ে ধুয়ে সাফ করে দেওয়া হয়েছিল, এমন দাবিও ছড়িয়েছিল।
একটা দাবিও প্রমাণিত হল?
মিথ্যা চিরকাল প্রমাণবিহীনতায় ভোগে। এটাই মিথ্যের স্বাভাবিক পরিণতি। আরজি কর কাণ্ডে সেটাই পুনঃপ্রমাণিত।
কিন্তু এই নোংরামির খেলায়, মিথ্যাচারের সৌজন্যে, যাঁদের সামাজিক হেনস্থার শিকার হতে হল, তাঁদের ন্যায় বিচার কে দেবে?
যেমন, তৃণমূল বিধায়ক সৌমেন মহাপাত্রের পুত্র। তিনিও আরজি করের একজন ইন্টার্ন। এক স্কুলশিক্ষকের পুত্রকে বিধায়ক-পুত্র বানিয়ে সেই ছবি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সামাজিক অপমানের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয় তাঁকে।
তাঁর অপমানের সুরাহা কী হবে? রাত দখলের কারিগররা সেটা বোধহয় ভাবেনইনি।
একদা সিপিএম রটিয়েছিল, স্টিফেন হাউসের মালিক অতুল্য ঘোষ আর প্রফুল্ল সেন। অতুল্য ঘোষ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতেন উল্টোডাঙা আবাসনের একটা ছোট্ট ঘরে। আর প্রফুল্ল সেন? জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতেন ভাড়াবাড়িতে।
সেই উত্তরাধিকার আসলে গোয়েবলসের পরম্পরা। নাৎসি জার্মানির তথ্যমন্ত্রী গোয়েবল্স। তিনি মনে করতেন, একটি মিথ্যাকে বারবার বলতে থাকলে, প্রচার করতে থাকলে তা বড় সংখ্যার মানুষ এক সময় ‘সত্য’ বলেই বিশ্বাস করবেন।
সেই তত্ত্বই প্রয়োগ করা হয়েছিল এক বছর আগে, শান্ত বাংলাকে অশান্ত করার জন্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী কার্যে বাধা সৃষ্টির জন্য। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।