নাটক করে, কুমিরের কান্না কেঁদে কত ড্যামেজ কন্ট্রোল করবেন

দাবি এক, দফা এক : মোদি-শাহের পদত্যাগ। পহেলগাঁওতে জঙ্গি হানার পর একমাত্র এই আওয়াজটাই ওঠা দরকার। নিরন্তর ব্যর্থতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টায় পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের হানাদারিকে হিন্দুর ওপর মুসলমানের আক্রমণ বলে দেখানোর নোংরা চেষ্টা করছে বিজেপি। প্রতিবাদে প্রতিরোধে কলম ধরলেন পার্থসারথি গুহ

Must read

মাত্র ক’দিন আগের কথা। আমের আঁতুড়ঘর মালদার মোথাবাড়িতে আগুন লাগানোর খেলায় চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে মুর্শিদাবাদে ধর্মান্ধতার বিষবৃক্ষ রোপণে ব্যস্ত বিজেপি। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা, গুজরাত, রাজস্থান প্রভৃতি গোবলয়ের কিছু অপ্রীতিকর ছবি বেমালুম এ-রাজ্যের বলে চালিয়ে দিয়ে রীতিমতো আসর গরম করতে ব্যস্ত বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রের ‘হাফ প্যান্ট’ মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ থেকে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু কত কী ‘মামার বাড়ির আবদার।’ কড়া হাতে মুখ্যমন্ত্রী রাশ ধরায় সে যাত্রা কিস্‌সু করে উঠতে পারেননি ধর্মের বিকিকিনি করা গোবলয়ের গোয়েবলসদের বঙ্গজ সংস্করণ সুকান্ত-শুভেন্দু-দিলীপরা।
ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে () জঙ্গিদের হাতে নিহত ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের নিরাপত্তা দিতে ডাহা ফেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর পদত্যাগের দাবি কেন উঠবে না তাহলে? নোটবন্দি ও ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীর নাকি উগ্রপন্থীমুক্ত বলে স্বগতোক্তি করা মোদি-শাহের বিরুদ্ধে কেন আওয়াজ উঠবে না ‘দফা এক দাবি এক, আপাদমস্তক ব্যর্থ মো-শা’র পদত্যাগ।’ নাকি সানি দেওল, অক্ষয় কুমার, ভিকি কৌশলদের মতো বলিউড তারকাদের নিয়ে রক্তে ভেজা পহেলগাঁও নিয়ে একটা ‘কুমিরের কান্না’ মার্কা সিনেমাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে ৫৬ ইঞ্চির দৌড়।
দেশে যদি উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি ক্ষমতাসীন হয়, তাহলে সীমান্তের ওপারেও রমরমা বাড়ে অন্য কোনও রঙের সাম্প্রদায়িকতার। ছলে, বলে, কৌশলে মানুষকে বোকা বানিয়ে ধর্মের আফিমে বুঁদ করে রাখে এই চরমপন্থীরা। এখানে বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএসের পোষ্যপুত্র বিজেপি ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে,গুজরাতে সংখ্যালঘুর রক্তে নরমেধ যজ্ঞ করে, গো-মাংস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে খুন করে। আর ওয়াঘার ওপারে আরেক হিংস্র দল সারাক্ষণ ছক কষে কীভাবে ভারতে আঘাত হানা যাবে। সেই অত্যাচারের ফসল হিসেবে নিরীহ পর্যটকদের বলি চড়ানো হল ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে। ইতিমধ্যে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকার করেছে লস্কর-ই-তৈবা। অদ্ভূতভাবে পর্যটকদের নির্বিচারে খুন করার সময়ে টিকিটুকুও দেখা যায়নি সেনাদের। যেখানে কাশ্মীর নাকি সেনা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়। ২৬ জন খুন হওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক পর সেনাবাহিনীর পদার্পণ ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, শুধুমাত্র মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ সামরিক জওয়ানরা দ্রুত এলে বেশ কয়েকজনকে বাঁচানো সম্ভব ছিল।
এতো সিনেমার পুলিশের কথা মনে করাচ্ছে। অকুস্থলে পুলিশের দেরিতে আসা গতেবাঁধা ঘটনা। তাবলে সামরিক বাহিনী এত দেরি করে আসবে? ডাল লেকের কাশ্মীরে ডাল মে কালা হ্যায়-এর এই তো শুরু। তারওপর আবার নিরীহ মানুষগুলির ওপর পশুর মতো হত্যালীলা চালানোর সময়ে এত সময় নেওয়া। জঙ্গিরা নাকি খুন করার আগে ধর্মপরিচয় জানতে চায়। কলমা পড়তে বলে। কেউ কেউ তো আরও এককাঠি ওপরে উঠে এমনও দাবি করেছে, যে পুরুষদের হত্যার আগে তাঁদের গুপ্তস্থান পর্যন্ত দেখতে চেয়েছিল নাকি জঙ্গিরা। এ যেন রীতিমতো ইন্টারভিউ বোর্ড বসিয়ে কোতল করা।

আরও পড়ুন-কোথায় গেল চৌকিদার? নিরাপত্তার দিকে নজর নেই, শুধু বড়বড় কথা!

জওয়ানদের অকুস্থলে পৌঁছতে দেরিটা যদি ডাল মে কালা’র মসুর ডাল হয় তাহলে এই তথ্যটা নিঃসন্দেহে মুগ ডাল। যা হজম হতে অত্যধিক সময় লাগছে। টিভিতে যতটুকু দেখা গিয়েছে তাতে স্পষ্ট, প্রত্যক্ষদর্শীরা মোটেই এমন সম্ভাবনার কথা বলেননি। অথচ ভূভারতে ছড়িয়ে পড়ল যে, জঙ্গিরা নাকি বেছে বেছে হিন্দুদের খুন করেছে। অথচ যে স্থানীয় মুসলমান টাট্টু চালক সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ নিজের জান দিয়ে ভূস্বর্গের অতিথিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁর কথাটা কাগজের ভিতরের পৃষ্ঠায় গুঁজে দেওয়া হল। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে উহ্যই থাকল প্রায়। পাকিস্তানে প্রায়শই মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটানোর খবরে শিউরে উঠি আমরা। যে অসংখ্য মানুষের রক্তে ভেজে পবিত্র ধর্মস্থান তাঁরা কিন্তু মুসলমান। এখানেই পরিষ্কার সন্ত্রাসবাদীদের কোনওদিন কোনও ধর্ম হয় না। তবে কী ধরে নিতে হবে পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ড পুলওয়ামার মতো বড় কোনও ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশা তো বটেই। পুলওয়ামার ভয়ঙ্কর ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ঠিক আগে। শহিদ জওয়ানদের বলিদানের পরিপূর্ণ ফসল বিজেপি কুড়িয়ে নেয় ভোটবাক্সে। বলাবাহুল্য দেশপ্রেমের সুড়সুড়িতে। আর পহেলগাঁও ঘটল নাগপুরে মোহন ভাগবতের সঙ্গে ‘নিষ্ফলা’ বৈঠক শেষে মোদির হতোদ্যম হয়ে ওঠার পর। গন্ধটা সত্যিই সন্দেহজনক।
নচেৎ যে বিজেপি এবং মোদি-শাহ জুটি বারংবার দাবি করেছে নোটবন্দি এবং ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীর পুরো শান্ত সেখানে কী করে অবলীলাক্রমে খুনি ঘাতকরা ঢুকে পড়ল। শোনা যাচ্ছে শুধু ঢুকে পড়াই নয়, বেশ কিছুদিন ধরে রেইকি পর্যন্ত চালিয়েছিল সন্ত্রাসবাদীরা৷ পালটে যাওয়া কাশ্মীর কি তাহলে জঙ্গিদের মামার বাড়ি? এত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যেও কালনাগিনী এল কী করে?
এতো গেল পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড পর্বের। এরপর থেকে আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে মোদি মিডিয়া আদ্যশ্রাদ্ধ শুরু করেছে এদেশের রক্তমজ্জার সঙ্গে মিশে থাকা মুসলমানদের। বিজেপি থুড়ি এনডিএ সরকারের এত বড় গাফিলতি ঢাকতে সফট টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের। অথচ ২০০০ সালে, বিল ক্লিন্টনের ভারত সফরের সময় এই লস্কর-ই-তৈবা যে ৩৫ জন শিখকে হত্যা করেছিল সেই তথ্য বেমালুম ভুলে মেরে দেওয়া হচ্ছে। ইজরায়েল যে দিনের পর দিন অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডকে দুনিয়ার ম্যাপ থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে তা নিয়ে কোনও হেলদোল নেই কারও। কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদীরা যেমন মানবতার শত্রু, ঠিক তেমনই গুজরাত দাঙ্গাকারী থেকে অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ও হালে জৈন মন্দিরের ওপর আক্রমণ চালানো ব্যক্তিরা কি খুব সাধুপুরুষ? ওড়িশায় গ্রাহাম স্টেইনস ও তাঁর পরিবারকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া খুনিরা আইনের বেড়াজাল পেরিয়ে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে৷ তাদের ঘটা করে সংবর্ধনা দিয়েছে আরএসএস এবং তাদের বশংবদরা। ঠিক যেমন গুজরাতে গর্ভবতী বিলকিস বানোর হত্যাকারীদের মালা পরানো হয়েছে। বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। দেশের সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি যাদের মনে এত বিদ্বেষ তাদের আমলেই এদেশে ঘটে গিয়েছে একের পর এক জঙ্গি হানা। অদ্ভুত! সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মতবাদ অথচ হত্যালীলায় কী ভীষণ মিল। এভাবেই একদল উগ্র ধর্মান্ধ চুম্বকের মতো টেনে আনে অন্য সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক শত্রুদের। এমতাবস্থায় কেবল ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাবান দলগুলোর শক্তিশালী হওয়া আশু প্রয়োজন।
এরা যত কলেবরে বাড়বে ততই বিজেপি, আরএসএসের মতো সাম্প্রদায়িক শয়তানরা লেজ গুটিয়ে পালাবে।

Latest article