কবির সুমনের একটা গান। তারই কতিপয় কলি—
কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা
যায় / কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়।
এই কলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গাইতে ইচ্ছে করছে, জানতে ইচ্ছে করছে, বুঝতে ইচ্ছে করছে, কতটা দাম বাড়লে তবে মোদি সরকার পেট্রোপণ্যের এই বেলাগাম ঊর্ধ্বগতিতে (Petrol Diesel Price Hike) কিঞ্চিৎ লাগাম পরানোর দায় পালন করবেন?
প্রশ্নটা স্বাভাবিক। এবং প্রশ্নটা আদৌ অসঙ্গত নয়, কারণ, ১৭ দিনে ১৪ বার বেড়েছে পেট্রোলের দাম।
১৩৮ দিন বন্ধ ছিল এই উড়ান। পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের জন্যই সম্ভবত রাশ টানা হয়েছিল পেট্রোল-ডিজেলের দামবৃদ্ধিতে। তারপর, ভোট মিটতেই বড়সড় লাফ। এক লাফে ১০ টাকারও বেশি বৃদ্ধি (Petrol Diesel Price Hike) দামে। এপ্রিলের ৭ তারিখে দিল্লিতে পেট্রোলের দাম লিটারপিছু ১০৫ টাকা ৪১ পয়সা। মুম্বইয়ে ১২০ টাকা ৫১ পয়সা। কলকাতায় ১১৫ টাকা ১২ পয়সা। চেন্নাইয়ে ১১০ টাকা ৮৫ পয়সা। এই দামে যেটুকু ফারাক, সেটা রাজ্যের করের পার্থক্যের কারণে।
দামটা বাড়ছে কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কোনও রকেট-বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। মার্চ ২২, ২০২২ পর্যন্ত ধরলে টানা ১৩৮ দিন পেট্রোলের দাম বাড়েনি। দীপাবলির সময় সেন্ট্রাল এক্সসাইজ ডিউটি বা কেন্দ্রীয় শুল্কে কিছুটা কাটছাঁট করা হয়েছিল। কোনও কোনও রাজ্যে ভ্যাটের হারও হ্রাস করা হয়েছিল। ফলে পাঁচ রাজ্যে অনুষ্ঠিতব্য বিধানসভা নির্বাচনের কারণে দীর্ঘ সময় পেট্রোলের দামে লাগাম পরানো ছিল। এখানে, পেট্রোলের দাম বলতে খুচরা বাজারে পেট্রোলের লিটারপিছু দাম বোঝানো হচ্ছে। জানুয়ারি, ২০২২-এ অপরিশোধিত তেলের দাম চড়তে থাকে। সেপ্টেম্বর, ২০২১ থেকে নভেম্বর, ২০২১-এর মধ্যে, অর্থাৎ যখন কেন্দ্রীয় শুল্কবাবদ কর কমানো হয়েছে, তখনও অপরিশোধিত তেলের দাম ১০১.৩৪ টাকা থেকে বেড়ে ১০৯.৬৯ টাকা হয়েছে।
জানুয়ারি, ২০২২ থেকেই মার্চ, ২০২২-এর মধ্যে ব্যারেলপিছু অপরিশোধিত তেলের দাম আরও বাড়তে থাকে। ৭৭ ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে ১০২ ডলার হয়। ৯ মার্চ তা দাঁড়ায় ১২৮ ডলারে। এর মধ্যে মোদি সরকারের সৌজন্যে ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়তে থাকে। ডলারপিছু টাকার মূল্য ৭৪.৫১ টাকা থেকে ৭৫.৮১ টাকা হয়।
অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ছে। টাকার মূল্য কমছে, তা-ও, স্রেফ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে, ভাঁওতা দিয়ে ভোট নেওয়ার চেষ্টায়, আচ্ছে দিনের গোলাপি-খোয়াব বজায় রাখার অভিপ্রায়ে, পেট্রোলের দাম বাড়তে দেওয়া হয়নি। যখন ভোট মিটল তখনই বাঁধা-গরু ছাড়া পেল এবং তা তিড়িংবিড়িং করে দৌড়তেও শুরু করল।
আর এই ঊর্ধ্বশ্বাসে ঊর্ধ্বগতি এখনই থামবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে গত কয়েক দিনের গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, যে অস্বাভাবিক দ্রুততায় পেট্রোলের দাম বাড়ছিল, সেই ত্বরণে খানিকটা মন্দন দেখা দিলেও দিতে পারে। দাম বাড়বে তবে এত ঘন ঘন হয়ত বাড়বে না। সেটাকে মোদি সরকার আর গেরুয়া ঢাকপেটানো বহিনী যদি ৫৬ ইঞ্চি ছাতির বিরাট কোরামতি বলে তুলে ধরতে চায়, তবে তা তাদের তরফে আরও একটা মিথ্যাচারের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এ-কথা বলার কারণ, যখন কেন্দ্রীয় শুল্ক কমানো হয়েছিল, সেই নভেম্বর ৪, ২০২১-এ অপরিশোধিত তেলের দাম ৮০ ডলারের আশেপাশে ছিল। এখন তা ১০০ ডলারের উপর, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও অনস্বীকার্য যে, মার্চের বিভিন্ন সময়ে তা বাড়তে বাড়তে ১১৭ ডলার বা ১২৮ ডলার ব্যারেলপিছু দামে পৌঁছেছিল, বর্তমানে সেই সর্বোচ্চ মূল্যের কিঞ্চিৎ নিচে ব্যারেলপিছু অপরিশোধিত তেলের দাম, একই সঙ্গে বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও ভারতীয় টাকা একটু হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ৭৫ টাকা ৮১ পয়সা থেকে ডলার-প্রতি ৭৫ টাকা ৬০ পয়সা হয়েছে। এই দুটি অর্থনীতিক কারণে তেলের দামে খানিকটা লাগাম পড়লেও পড়তে পারে। অন্তত, সাদামাঠা অর্থনীতিক যুক্তিতে তেমনটাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু তেমনটা না-হওয়ার সম্ভাবনাই সমধিক। কারণ, মোদি সরকার।
জনবিরোধী এই সরকারের, মানুষের প্রতি অসংবেদনশীল এই সরকারের, জনগণের জীবনজীবিকার প্রতি উদাসীন এই সরকারের এক্সাইজ ডিউটি কমানোর কোনও সদিচ্ছা নেই।
পেট্রোলের খুচরা বাজারে যা দাম তার ২৭ শতাংশ এই এক্সাইজ ডিউটি। অর্থাৎ, আপনি-আমি যখন পেট্রোল পাম্প থেকে ১০০ টাকার তেল ভরছি গাড়িতে বা মোটর বাইকে তখন ২৭ টাকা তুলে দিচ্ছি কেন্দ্রের সরকারকে।
মোদি-জমানার আগে, ২০১৪-তেও পেট্রোল কিনলে দামের একাংশ কেন্দ্রের কোষাগারে যেত। তবে তা এতটা ছিল না। ১০০ টাকার তেল ভরলে কেন্দ্র পেত ১৪ টাকা। কিন্তু যবে থেকে ‘অচ্ছে দিন’ আনার সরকার দিল্লিতে বসেছে, তবে থেকে, অপরিশোধিত তেলের দাম কমলেই কেন্দ্রের এক্সসাইজ ডিউটি বাড়ানো হয়েছে। আর বাড়তে বাড়তে ব্যাপারটা এই মাত্রায় পৌঁছেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমলে তার সুফল আম-জনতার কাছে পৌঁছতে দেয়নি যে সরকার, মুনাফা লোভী ‘বেওসায়ি’র মতো স্রেফ নিজের আখেরের কথা ভেবে কেন্দ্রীয় শুল্ক বাড়িয়ে গিয়েছে, সেই সরকার এখন এই অবস্থাতেও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপিছু অপরিশোধিত তেলের দামে পতন ও টাকার মূল্যের অধোগতি থেকে কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বমুখী হওয়া— এই যুগ্ম কারণের ইতিবাচক প্রভাব জনতার কাছে পৌঁছতে দেবেন, এমন আশা নিছকই দুরাশামাত্র।
সে-কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।