গন্ধটা কেমন সন্দেহজনক

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পের নামটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কিংবা পদ্মপালের প্রাক-পঞ্চায়েত ভূমিকার লক্ষণাত্মক অলংকার। লিখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Must read

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সরগরম। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন। উত্তাপ দ্রুতহারে বাড়ছে। অভিযোগ-পালটা অভিযোগ। অকথা-কুকথার বন্যা। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাননীয় রাজ্যপালের (Governor Bose) উত্তপ্ত বাণী। একই সঙ্গে ঘটেছে শিক্ষাক্ষেত্রে নজিরবিহীন ঘটনা, যার প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক স্তরে ইতিমধ্যেই পড়েছে। সেটি হল, গত ৩০ জুন রাজ্যপাল-আচার্য উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন উপাচার্যের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করেছেন। রাজ্যপাল (Governor Bose) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। শুনলাম, হঠাৎ না জানিয়ে একটি কলেজে চলে গিয়েছিলেন, এতে আপত্তির কিছু আছে বলে মনে হয় না। এই রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যাগুলি নিয়ে তিনি আলোচনা করতেই পারেন, বুঝবার চেষ্টা করাটা স্বাভাবিক। আরও জানা গেল, উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি রাজ্য সরকারের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সদ্ভাবের বার্তা দিয়েছেন। সবটাই ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে অন্ধকারে রেখে, বরং বলা যায়, উপেক্ষা করে তিনি এই বৈঠক ডাকলেন কেন? শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তিনি এই বৈঠকের দিন ও স্থান ঠিক করতে পারতেন। আচার্য চাইলে শিক্ষামন্ত্রী (যিনি নিজেও একজন অধ্যাপক) নিশ্চয়ই আপত্তি করতেন না।

উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ও উচ্চশিক্ষা সচিবও থাকতে পারতেন। উচ্চশিক্ষা সচিব রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যের সচিব। সেইক্ষেত্রে আলোচনা আরও ফলপ্রসূ হত। মনে হতে পারে, মান্যবর আচার্য-রাজ্যপাল সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করছেন, যেটা না হলেই ভাল। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে এর আগে আমি একটি প্রবন্ধে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করছি। তখন মহামান্য হাইকোর্টের রায় প্রকাশিত হয়নি। হাইকোর্টের রায়কে মান্যতা দিয়েও এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদমর্যাদাকে সম্মান জানিয়েও বলতে বাধ্যি হচ্ছি, নির্বাচিত সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে, তাঁকে অগ্রাহ্য করে, অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা কি গণতন্ত্রসম্মত হয়েছে? মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার দু’বছর আগে ব্যাপক জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। নিন্দুকরা বলেছেন, যে সমস্ত উপাচার্য আচার্য-রাজ্যপালের একটি নির্দেশ মেনে নিয়েছেন, একমাত্র তাঁদেরই কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, বাকিদের হয়নি। কী সেই নির্দেশ? রাজ্যপাল সাহেব উপাচার্যদের বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত সাপ্তাহিক রিপোর্ট তাঁকে পাঠাতে হবে। সবিনয়ে বলি, এই নির্দেশ বাস্তবসম্মত নয়। সরকারি অফিসে চলতে পারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয়। একজন আধিকারিক সপ্তাহে কতসংখ্যক ফাইল দেখলেন, তার হিসাব নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এটা হয় না। ত্রৈমাসিক রিপোর্ট চাওয়া যেতে পারে। সেটাও পাঠানো হবে শিক্ষা দফতরের মাধ্যমে। কারণ উচ্চশিক্ষা সচিব হলেন আচার্যের সচিব। উচ্চশিক্ষা দফতর (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) আচার্যের সচিবালয়। রাজ্যপালের সচিবালয় হল রাজভবন। এছাড়া প্রশাসনিক শিষ্টতা অনুসারে উপাচার্য সরাসরি রাজ্যপালকে লিখতে পারেন না। যেমন, কোনও সরকারি আধিকারিক সরাসরি মন্ত্রীমহোদয়কে লিখতে পারেন না। তবে আচার্যের এই নির্দেশ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক ও গঠনমূলক সমালোচনা চলতেই পারে। প্রসঙ্গক্রমে একটা বিষয় উল্লেখ না করে পারলাম না। কিছু তথাকথিত বিশিষ্ট ব্যক্তির ‘দুমুখো’ মনোভাব ও দ্বিচারিতা উদ্বেগের বিষয়। একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। সংস্কৃতের জনৈক তথাকথিত পণ্ডিতপ্রবর অধ্যাপক, যিনি নিজেকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন দাবি করেন (সত্যি কি না জানি না, কারণ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই), শিষ্ঠাচারের তাগিদে তাঁর নাম উল্লেখ করছি না, ধরা যাক, তাঁর নাম ‘নরসিংহ অবতার’। তিনি গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায় বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক দেবনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করে বলেন, আচার্যের নির্দেশ মেনে নিতে অর্থাৎ অনতিবিলম্বে সাপ্তাহিক রিপোর্ট পাঠাতে। তা হলে তিনি আরও কয়েক মাস উপাচার্য থাকতে পারবেন। উল্লেখ্য, অস্থায়ী উপাচার্যদের কার্যকালের মেয়াদ ছিল ৩১ মে। একই সন্ধ্যায় ‘নরসিংহ অবতার’ কয়েকবার ফোন করে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। দেবনারায়ণ আমাকে ফোন করে আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে পালটা জিঞ্জেস করলাম, তিনি কী ভাবছেন। উত্তরে তিনি বলেন— ‘‘যে সরকার আমাকে এতকিছু দিয়েছে, দুটো মেয়াদের বেশি উপাচার্য রেখেছে, তার সঙ্গে বেইমানি করতে পারব না (রাজ্য সরকারের পরামর্শ ছিল, উপাচার্যরা কোনও রিপোর্ট সরাসরি রাজভবনে পাঠাবেন না)।” আমি তাঁকে বললাম— ‘‘এটাই আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষা (আমরা উভয়েই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র ছিলাম)।” জানি না, এই ‘অবতার’ অন্যান্য উপাচার্যদের ফোন করেছিলেন কি না। এই ধরনের লোক যে কোনও দল ও সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে অযথা জল ঘোলা করা হল। প্রথমে রাজ্য সরকার প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহার নাম পাঠিয়েছিল। রাজ্যপাল দ্বিতীয় নাম চাইলেন। সেই নামও পাঠানো হল। কিছুদিন নীরব থেকে আরও একটি নাম চাইলেন। তৃতীয় নামটি পাঠানো হয়েছিল কি না জানা নেই। বেশ কিছুদিন ঝুলিয়ে রেখে সিনহা সাহেবকে নিয়োগ করলেন। কেন এই বিলম্ব? এই নিয়োগের ব্যাপারে রাজ্যপালের কোনও ‘স্বেচ্ছাধীন’ (Discretionary) ক্ষমতা নেই। রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে বাধ্য। ভাবুন তো, ভারতের নির্বাচন কমিশনের মুখ্য কমিশনার বা কমিশনার নিয়োগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ কি রাষ্ট্রপতি ঝুলিয়ে রাখতে পারেন বা উপেক্ষা করতে পারেন?

আরও পড়ুন- ফের এক্তিয়ারের বাইরে সিদ্ধান্ত বোসের, ক্ষোভ সর্বত্র

পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজ্যপাল বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই তিনি যেতে পারেন। তবে তাঁর কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করি। তিনি একটি বিশেষ দলের আক্রান্তদের দেখতে যাবেন না, দল-মত নির্বিশেষে সমস্ত আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াবেন, আশা রাখি। তিনি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ২৯ জুন বলেছেন, ‘‘ভোটকে ঘিরে ভয়-ভীত, খুন-জখমের রাজনীতি চলতে পারে না।’’ একদম ঠিক কথা বলেছেন। ব্রিটিশ সংবিধান বিশেষজ্ঞ লর্ড রেগট বলেছিলেন, ব্রিটেনের রাজা মন্ত্রিসভাকে পরামর্শ দিতে, উৎসাহ দিতে এবং সাবধান করতে পারেন। ১৯৯২ এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে একপ্রকার ভর্ৎসনা করে তাঁকে তাঁর সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই ডক্টর সি ভি আনন্দ বোস নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে সতর্ক করতেই পারেন। কিন্তু তিনি প্রশাসনকে নির্দেশ দিতে পারেন না, সেই ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার।

আমাদের রাজ্যপালের (Governor Bose) দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বিদগ্ধ ও পণ্ডিত ব্যক্তি। ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত ভদ্র। তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি প্রশাসনকে সুপরামর্শ দিতে পারেন। সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করতে পারেন। কেন্দ্র-রাজ্য জটিল সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আমরা সাধারণ রাজ্যবাসীরা তাঁর কাছে এই গঠনমূলক ও নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা করি।

Latest article