বইমেলার ভরা জোয়ারে মানুষের ভিড় মমতাময়

বইমেলা এক মাঠ হইহই মেলা। আজই তার শেষ দিন। কিন্তু বইমেলার অন্তিম বিন্দুতে ফি বছর রচিত হয় অনন্তের ইঙ্গিত। বইমেলার তাই কখনও শেষ হয় না। লিখছেন পার্থসারথি গুহ

Must read

বইমেলার ভরা মাঘে পাঠকের অবস্থা যেন কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি (পড়ুন পড়ি)! সাহিত্যাকাশে কতরকম গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রদক্ষিণ করছে পাঠকদের। সামাজিক, ঐতিহাসিক, ভৌতিক, গোয়েন্দা অমনিবাস, রোমাঞ্চ, হাস্যকৌতুকের হাজার হাজার উপকরণ। এর মাঝারেই ‘পাইলেই পাইতে পারো অমূল্য রতন’ নিঃসন্দেহে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি দেড় শতাধিক বই।
বস্তুত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামটাই যেন আস্ত একটি বই। জীবনটা যাঁর থরে থরে সজ্জিত সংকলন। সরগমের সারেগামাপাধানিসার মতো একের পর সুরের মেলবন্ধন। সবটা মোটেই মণিমুক্তোখচিত নয়। ক্যাকটাসের কণ্টকময় সংগ্রাম ও অবিরাম রক্তপাতেও পাঠকের দু’চোখ ছাপিয়ে অশ্রুধারা নেমে আসতে বাধ্য। গোলাপের পরতে পরতে কাঁটা তো থাকবেই। আসমুদ্রহিমাচলের মতো জীবনযুদ্ধ জুড়ে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা, ছড়ার ছড়াছড়ি। সমুদ্র যেখানে আকাশের সঙ্গে মিলে যায় তেমনই ফিকশন আর নন-ফিকশন কোথায় যেন এক সরলরেখায় ধরা দেয় তাঁর মমতাময়ী লেখায়।
রোজকার যুদ্ধকালীন ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়ম করে শরীরচর্চা করেন মুখ্যমন্ত্রী। হাঁটেনও প্রচুর। এমনকী লগ্নি আনতে বিদেশে গেলেও অন্যথা হয় না। শরীরচর্চা এবং কাজের ফাঁকে সামান্য যেটুকু অবসর বা অবকাশ পান তার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়েন সাহিত্য সাধনায়। যার ফসল হিসেবে বাংলা পেয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অমোঘ সব সৃষ্টি।

আরও পড়ুন-চল্লিশেও রোনাল্ডো গোল মেশিন

২০২৫-এর আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা চলছে হইচই করে। রোজ নবীন, প্রবীণ সাহিত্যিকদের কত বই মুক্তির আলোকে প্রজ্বলিত হচ্ছে। লেখক, পাঠক এবং অতি অবশ্যই প্রকাশকের মহামিলনতীর্থ হয়ে উঠেছে বইমেলা। এও যেন ত্রিবেণীর গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর যোগসূত্র স্থাপন। মহাকুম্ভের পুণ্য দিব্য অর্জন করা যাচ্ছে বইমেলা টো টো করে। বইয়ের অবগাহনে।
রাজ্য শাসনের গুরুদায়িত্ব সামলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অতি প্রিয় সাহিত্যযাপনেও সময় বের করেছেন। ৪৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিনটি। ইতিমধ্যেই তাঁর বইয়ের সংখ্যা ১৫৩-এ পৌঁছেছে। আজকের আইপিএলের জমানায় ব্যাটারদের স্ট্রাইক রেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে ক্রিকেটীয় ভাষায় বলাই চলে অচিরেই বইয়ের সংখ্যায় দ্বিশতরান করবেন মমতা। যদিও সংখ্যাধিক্যে নয়, মুখ্যমন্ত্রীর বই গুণমান ও বৈচিত্র্যের নিরিখে আবালবৃদ্ধবনিতার মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। বলাবাহুল্য, বরাবরের মতো বৈচিত্র্যের সমাহারে ভরপুর। বাংলাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন যিনি তাঁর বইয়ের ত্র্যহস্পর্শে রয়েছে ‘স্যালুট’-এর দ্বিতীয় অধ্যায়। যাতে পাঁচজন বিশিষ্ট মহিলা ছাড়াও পঞ্চাশজন বাঙালিকে লেখনীর মাধ্যমে সম্মান জানিয়েছেন তিনি। নতুন প্রজন্মের জন্যও যথারীতি ভেবেছেন তিনি। নয়া প্রজন্মকে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের ইতিহাসের ছায়াপথ দেখানোর আঙ্গিকে তাঁর ‘বাংলার নির্বাচন ও আমরা’ অবশ্যপাঠ্য। একের পর নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কী অসম্ভব লড়াই ও কুৎসার বিরুদ্ধে যুঝে মহীরুহর আকার ধারণ করেছে তা সবিস্তারে উল্লেখিত হয়েছে এই অমূল্য সম্পদরূপী বইতে। মানুষের স্মৃতি দুর্বল। তার ওপর দিল্লির বর্তমান সরকারের ইতিহাস ভোলানোর অপচেষ্টা। তার প্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সরকারের রেলমন্ত্রী হিসেবে বাংলা তথা সমগ্র দেশে যে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছিলেন তার আক্ষরিক রূপ ফুটে উঠেছে ‘লিপিবদ্ধ কিছু কাজ’-এ।— এই তিনটি বই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের বাগিচার তিনটি সদ্যফোটা ফুল মাত্র। মুখ্যমন্ত্রীর বইয়ের সৌরভে তাঁর সাহিত্যের বাগান পাঠকদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। হরেকরকমের সৌন্দর্যময়ী গোলাপ, ডালিয়া, বোগেনভুলিয়া, সৌরভের সওদাগর জুঁই, টগর থেকে মায়ের রাঙা পায়ে নিবেদিত রক্তজবা— কী নেই! মুখ্যমন্ত্রীর সাহিত্য সত্তা পাঠকের বহুমুখী চাহিদাকে অনায়াস আকর্ষণ করে। সেজন্য তাঁর সৃষ্টির মধ্যে উপলব্ধি, নন্দীগ্রামের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের নন্দীমা, আন্দোলনের কথা, মা-মাটি-মানুষ, মা, জাগো বাংলা, নেতাই-য়ের মধ্যে যেমন বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন রক্তঝরা প্রচণ্ড সংগ্রামের টাটকা স্মৃতি বিদ্যমান তেমনই আবার রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাঁর একের পর এক উন্নয়নযজ্ঞের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে কন্যা চোখে কন্যাশ্রী, বিশ্ববাংলা, পথের সাথী, আমার পাহাড়, আমার জঙ্গল, সরণীর মতো অসাধারণ সৃষ্টিতে।

আরও পড়ুন-ম্যান ইউ জিতলেও সঙ্গে থাকল অফসাইড বিতর্ক

সেরা মমতা, আজব ছড়া একান্তে, কথাঞ্জলি, নামাঞ্জলি, জন্মাইনি-তে ধরা দিয়েছেন পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গদ্য, পদ্য সবেতে সমানভাবে বিচরণ করেছেন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুদের তিনি প্রচণ্ড ভালবাসেন। এখনও জেলায় জেলায় সফরে গেলে শিশুদের কোলে তুলে নেন। তাদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেছেন শিশুকথা, শিশুসাথীর মতো সারল্যে ভরপুর লেখা। এভাবেই তাঁর লেখার কোলাজে সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলা সাহিত্য ও পাঠকবৃন্দ। নিঃসন্দেহে বলা যায় সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যগগনে বিচরণ করছেন তিনি। আরও কত মণিমাণিক্য যে তিনি মেলে ধরবেন তা সময় বলবে। তবে পাঠকের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণে তিনি যে কল্পতরু হবেন তা বলাই বাহুল্য। আসলে কোনও কিছুতেই যে ফাঁকফোকর রাখেন না তিনি। প্রশাসন সামলানো, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজ্যকে সর্বস্তরে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার মতো সাহিত্যাভ্যাস তিনি চালিয়ে যাবেন স্বভাবসিদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ততায়।

Latest article