আজ ২১ জুলাই। আজ শহিদদের তর্পণ করার দিন। আজ আবার নতুন করে সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন।
১৯৯৩ সালের সেই রক্তাক্ত ২১ জুলাইয়ের প্রতিটি মুহূর্ত আমার মনে আছে, মনে থাকবে। তখন আমি রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রী। সিপিএমের অত্যাচার, ভোট রিগিং চলছে। কংগ্রেস নেতৃত্ব নিষ্ক্রিয়। আমি আওয়াজ তুলেছিলাম ‘নো আই কার্ড, নো ভোট।’ ভোটারদের সচিত্র পরিচয়পত্র চাই। সেই দাবিতেই মহাকরণ অবরোধ, কারণ তখন মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক মহাকরণে বসতেন। আমাদের কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন পয়েন্টে জমায়েত ও সভা। সিপিএম চায়নি এটা হোক। দু’-তিনদিন আগে থেকেই প্ররোচনা, হুমকি, বাধা, চক্রান্ত শুরু করে। এরপর ২১ জুলাই সকাল থেকে তা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছায়।
সেদিন সিপিএমের পরিকল্পনা ছিল আমাদের কর্মীদের রাস্তায় আটকানো, তারপর সভাগুলো ভেঙে দেওয়া, তারপর আমাকে খুন করা। ওরা ভেবেছিল এমনভাবে রক্তের হোলি খেলবে যে এরপর আর কেউ আন্দোলনের সাহস পাবে না।
আরও পড়ুন-গুরু ও পূর্ণিমা
২১ জুলাই সেদিন ছিল এক ভয়ঙ্কর দিন, গণতন্ত্রের লজ্জা। সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের কর্মীদের মেরেছে। তারপরেও যখন দেখল সভাগুলো জনসমুদ্র, তখন তাণ্ডব শুরু করল পুলিশ আর সিপিএম ক্যাডাররা। ব্রেবোর্ন রোড, ধর্মতলা, মেয়ো রোডে পৈশাচিক আক্রমণ হল নিরস্ত্র রাজনৈতিক কর্মীদের উপর। মেয়ো রোড, ধর্মতলায় গণহত্যা হল, আরও কতজন আহত। অসহায় সমর্থকদের শরীর লক্ষ্য করে গুলি চালানো হল। ব্রেবোর্ন রোডে চারদিক দিয়ে ঘিরে আমাকে মারা হল। আমার দিকে বন্দুক তোলা হয়েছিল। তখন আমার নিরাপত্তারক্ষী কলকাতা পুলিশেরই কর্মী মাইতিদা বন্দুক বার করে চিৎকার শুরু না করলে সেদিন আমাকে ওরা মেরেই ফেলত। প্রবল ধস্তাধস্তিতে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে দু’-একজন শুভানুধ্যায়ী আমাকে পুলিশের গাড়ি থেকে অন্য একটি গাড়িতে তুলে হাসপাতালে ভর্তি করেন। তখনও জ্ঞান একটু ফিরতেই আমি ঘটনাস্থলের খোঁজ নিয়েছি। সেদিন সিপিএম আমার তেরোজন ভাইকে হত্যা করেছিল।
একটু সুস্থ হতেই আমি শুরু করি ক্ষতিপূরণের কাজ, শহিদ পরিবারগুলির পাশে থাকার দায়িত্বপালন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কমিটি হয়। ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। মানুষ সাড়া দেন। তাছাড়া পরে সুযোগমতো সব পরিবারে চাকরির ব্যবস্থাও করে দিই। কোনও গণআন্দোলনে শহিদ পরিবারগুলির পাশে থাকার এই দায়িত্বপালন, এর অন্য কোনও নজির নেই। আমরা চেষ্টা করি কর্তব্যপালনের।
সেই থেকে প্রতি বছর ২১ জুলাই আমরা পালন করি শহিদ তর্পণ সমাবেশের মধ্যে দিয়ে। যেহেতু ধর্মতলায় গুলি চলেছিল, তাই ওখানেই সভা হয়। শুধু ২০১১ সালে পরিবর্তনের পর সভা হয়েছিল ব্রিগেড ময়দানে। এবারও সভা ধর্মতলাতেই। ১৯৯৮ সাল থেকে, অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মের পর, তৃণমূল পরিবারের তরফ থেকেই এই কর্মসূচি করা হয়, কারণ আমরাই সেদিনের সেই আন্দোলনের মূল ধারা।
২১ জুলাই দিনটি একটি আলাদা আবেগ; শহিদ তর্পণের পাশাপাশি ক্রমশ এটি আমাদের জীবনে একটি সার্বিক পথনির্দেশিকার দিন হয়ে উঠেছে। কর্মী-সমর্থকরা আসেন, কত কষ্ট করে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন, প্রতিবার নতুন শপথ নেন। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে কত নাটকীয় মোড়, কত চক্রান্তের মোকাবিলা, কখনও সাফল্য, আবার কোনওদিন গিয়েছে তথাকথিত নির্বাচনে কম আসন পাওয়া। কখনও আবার বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া, বড় সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত। প্রতিটি বছরেই এই ২১ জুলাইয়ের জনসমুদ্র আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেয়, অনুপ্রেরণা দেয়, উৎসাহ দেয়। মানুষ সঙ্গে না থাকলে কোনও বড় কাজ করা যায় না। ২১ জুলাই তৃণমূল পরিবার আর সাধারণ মানুষ বারবার পাশে থাকেন। যুগে যুগে রাজনীতির একটি নিজস্ব প্রেক্ষিত থাকে। প্রতিটি প্রেক্ষিতেই এই ২১ জুলাই আমার জীবনে সদাজাগ্রত। এবার এই ২০২৪ সালের সময়ের ডাকে আবার নতুন করে শপথের সময়। এবার আমাদের মনে রাখতে হবে: বাংলার উন্নয়ন অব্যাহত রাখার লড়াই। আরও মানুষকে আরও উন্নয়নে শামিল করতে হবে। বাংলাকে মা-মাটি-মানুষের দুর্ভেদ্য দুর্গ করে রাখতে হবে। বাংলার আত্মনির্ভরতা, সম্মান, অধিকার অটুট রাখতে হবে। বাংলার ঐতিহ্য, পরম্পরা, সংস্কৃতি সুরক্ষিত রাখতে হবে। বাংলার প্রতি বঞ্চনা, উপেক্ষা, অপমানের জবাব দিতে হবে।
পাশাপাশি, গোটা দেশের মানুষ বাংলার দিকে তাকিয়ে। আজ সংসদে তৃণমূলের ৪২ জন সাংসদ। দেশকে বিকল্প সরকার দিতে হবে, যা হবে ধর্মনিরপেক্ষ, সংবিধানের বার্তাবাহক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, জনমুখী নীতির ধারক, মেহনতি মানুষ, শ্রমিক, কৃষকের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বাংলা।
বাংলার বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র চলছে। নিবিড় জনসংযোগের মধ্যে দিয়ে সেসব ব্যর্থ করতে হবে। আমাদের দলের বিরুদ্ধে কুৎসা চলছে অবিরাম। এসব ব্যর্থ করে দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের তরফে কোনও ভুল থাকলে তা শুধরে নিতে হবে। মানুষ বিরক্ত হন, এমন কোনও কাজ করা যাবে না। দল শেষ কথা। আর দল মানুষের জন্যেই কাজ করে। সবার উপরে মানুষ সত্য। আসুন, এবারের ২১ জুলাইতেও আমরা শপথ নিই, মানুষের জন্য, মানুষের স্বার্থে আমরা কাজ করছি, করব। মনে রাখবেন, এই কাজ চলছে বলেই নির্বাচন হোক বা উপনির্বাচন, মানুষ আমাদের আশীর্বাদ করছেন। এবারের লোকসভা ভোটের বিপুল আসন বৃদ্ধি, উপনির্বাচনগুলিতে জয় তার প্রমাণ। এই জয় আমি শহিদ তর্পণে উৎসর্গ করলাম। পাশাপাশি এই দিনটা আমাদের উপর আস্থা, ভরসা রাখার জন্য মা-মাটি-মানুষকে ধন্যবাদ জানানোরও দিন। আমি আবারও মা-মাটি-মানুষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে আমাদের দায়দায়িত্ব আরও বাড়ছে। লক্ষ্য, আদর্শে অবিচল থেকে সেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।
আরও পড়ুন-ভাতের হোটেল
জয় হিন্দ।
জয় বাংলা।
তৃণমূল কংগ্রেস জিন্দাবাদ।