রবিবারের গল্প
প্রদীপ দে সরকার
এই মুহূর্তে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার। কী করা উচিত ঠিক বুঝতে পারছি না। হাঁটতে হাঁটতে সুতপাকে ফোন করলাম। ব্যাপারটা ওকে জানানো দরকার। ফোনে গোটা ঘটনাটা যতটা সম্ভব সংক্ষেপে জানিয়ে বলে রাখলাম, ‘মা যেন কোনও ভাবেই এটা জানতে না পারে। জানলে কেলেঙ্কারি হবে।’
হ্যাঁ, কেলেঙ্কারি হওয়ার মতোই ঘটনা। একটু আগে যা জানলাম সেটা মিডিয়ার ভাষায় ব্রেকিং নিউজ। যা হওয়ার হয়ে গেছে ভেবে আমরা সামলে নিলেও মায়ের পক্ষে এটা হজম করা একেবারেই সম্ভব নয়। তাই সুতপাকে সাবধান করে রাখলাম। স্কুটারে চাপার আগে মনে হল আজ এখানে না এলেই হয়তো ভাল হত।
আজ সকালে মা আর সুতপার যৌথ চাপে একরকম বাধ্য হয়েই স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। সক্কাল সক্কাল রান্নঘর থেকে বাসন মাজার যে আওয়াজ পাচ্ছিলাম সেটা অন্য দিনের চাইতে বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। বুঝতে পারছিলাম পারদ চড়ছে। অবশ্য সেটা এই মুহূর্তে খুব অস্বাভাবিক নয়। চার দিন ধরে সুতপার ওপর দিয়ে কম ধকল যাচ্ছে না। মা যতটুকু পারে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মায়েরই বা সময় কোথায়! সারাদিনের বেশিরভাগটাই কেটে যায় গোপাল আর তিন্নিকে নিয়ে।
তিন্নিটা ছোট থেকেই ঠাম্মি ন্যাওটা। এখন তো আবার স্কুল বন্ধ বলে তিন্নি প্রায় সারাক্ষণই তার ঠাম্মির আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর দু’বছর আগে বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মায়ের আরেক সঙ্গী হয়েছে গোপাল। সকাল থেকে গোপালের খাওয়া, স্নান, বিশ্রাম, ঘুম— এ সব সামলাতেই সময় কেটে যায় মায়ের। সংসারের বাকি কাজে আর সেভাবে সময় দিতে পারে না। আমরাও চাই না মা এই বয়সে শারীরিক পরিশ্রম করুক।
আরও পড়ুন-অন্য এক ৩ অক্টোবর
মা বোধহয় আজকের পরিস্থিতিটা আন্দাজ করতে পারছিল। আমাকে ডেকে বলল, ‘তুই একবার খোঁজ কর। চার দিন হতে চলল।’
রান্নাঘর থেকে সুতপার গলা ভেসে এল, ‘লাভ নেই মা। মাসের শুরুতেই টাকাটা নিয়ে কেটে পড়েছে।’
‘আঃ! তপা, তুই থামবি? রাগের মাথায় বাজে বকছিস। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল আমাদের এখানে কাজ করছে। কোনওদিনও বেচাল দেখেছিস? হয়ত কোনও বিপদ-আপদ …’
কথা বলতে বলতে সুতপা রান্নাঘর থেকে মায়ের ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তুমি ওসব বুঝবে না মা। এইভাবেই ওরা আস্তে আস্তে ঘাঁটি গাড়ে, তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মারে। তা-ই হয়েছে। আমারই ভুল। চাওয়ামাত্র অতগুলো টাকা দিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি।’
না, সুতপা যেমন বলছে তেমন চাওয়ামাত্র দেওয়া হয়নি। অনেক যোগ-জিজ্ঞেস করে, মাইনে থেকে কেটে নেওয়ার হিসেব আগাম বুঝিয়ে দিয়ে তবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা হলেও টাকাটা নেহাত কম নয়। পনেরো হাজার। অন্য সময় হলে তা-ও খানিকটা মানিয়ে-গনিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু এই লকডাউনের বাজারে এখন সেটা আমার কাছে লাখ টাকার সমান। সপ্তাহে একদিন সশরীরে অফিস যেতে হচ্ছে আর বাকি দিনগুলি ওয়র্ক ফ্রম হোম চলছে। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি। মাইনেটা দিচ্ছে এটাই অনেক। কিন্তু অফিস যেতে না হলে টিএ, ডিএ মার যায়। আর যেটুকু মাইনে পাই সেই টাকার ওপর নির্ভর করে সংসার চলে না। টিএ-ডিএটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের কাজ করে। এখন বাধ্য হয়ে সেটা ছাড়াই টেনেটুনে চালাতে হচ্ছে। মায়ের পেনশনের সামান্য ক’টা টাকা এখন সংসারের ফুটো-ফাটা সামলাচ্ছে। তার মধ্যে এই ধার।
আর টাকাটা ধার নেওয়ার পরের দিন থেকেই আর কাজে আসছে না আশা। প্রথম দিন ফোন করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে ফোন সুইচড অফ। আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়? তাই স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আরও পড়ুন-সেজে উঠেছে কলেজ স্ট্রিট
নেপালগঞ্জেরহাট পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে নাকি আশাদের বাড়ি। আমাদের পাশের বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করে সেই শ্যামলীর কাছ থেকে এইটুকুই জানতে পেরেছে সুতপা। ওইটুকু তথ্য নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম।
নেপালগঞ্জেরহাট পেরিয়ে প্রথম যে রাস্তাটা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে সেই মোড়ের মাথায় একটা চায়ের দোকান। দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই আশা মণ্ডলের বাড়িটা দেখিয়ে দিল। সিমেন্টের গাঁথনির ওপর টিনের চাল দেওয়া ঘর। এত সহজে পেয়ে যাব ভাবিনি। দরজার সামনে গিয়ে হাঁক পাড়তেই এক মহিলা বেরিয়ে এল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আশা মণ্ডল থাকে এখানে?’
মহিলা অবাক গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই আশা মণ্ডল। কী ব্যাপার?’
খানিকটা চমকালেও সামলে নিলাম। আশা মণ্ডল নামে একই এলাকায় দু’জন থাকাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। বললাম, ‘না, আপনি নন, আমি অন্য আরেক আশাকে খুঁজছি। চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করায় ভুল করে আপনার বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছে। আসলে আমি যাকে খুঁজছি সে আমাদের বাড়িতে কাজ করে। ক’দিন ধরে কাজে যাচ্ছে না। ফোন করলেও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই খোঁজ করতে এসেছি।’
মহিলা আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আশাকে কেমন দেখতে একটু বলবেন। আর আপনাদের বাড়িটা কোথায়?’
আশার চেহারার সামান্য বর্ণনা দিতে গিয়ে মনে হল আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার মতোই গড়ন তার। রোগা, কালো, উচ্চতা পাঁচ ফুটের কাছে। বললাম, ‘অনেকটা আপনার মতোই চেহারা।’ তারপর নিজের আর পাড়ার নাম বললাম। সঙ্গে সঙ্গেই মহিলা একগাল হেসে বলল, ‘আসুন আমার সঙ্গে। এই তো কাছেই ওর বাড়ি। শুনেছিলাম কয়েকদিন আগে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে অটোয় ধাক্কা মেরেছিল। হাতে-পায়ে চোট পেয়েছিল। কাজে বেরচ্ছে না মানে এখনও বোধহয় সেরে ওঠেনি।’
আশার অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে একটু চিন্তা হল। একটা দুশ্চিন্তাও অবশ্য দূর হল যে, যাক টাকা মেরে দেওয়ার প্ল্যান করেনি। স্কুটার সেখানেই রেখে মহিলার পিছু-পিছু হাঁটা দিলাম। কয়েকটা বাড়ি ছাড়িয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মহিলা। এই বাড়িটাও ইট-সিমেন্টের গাঁথনির ওপর টিনের ছাউনি। তবে টিনগুলোর জীর্ণদশা। চতুর্দিকে ভেঙে পড়ছে। এই টিন বদলানোর জন্যই তো ধার করেছিল। মনে মনে হিসেব মেলাচ্ছিলাম। এখনও পর্যন্ত গরমিল হয়নি।
আরও পড়ুন-আজ জিতলেই প্লে-অফ পাকা বিরাট-বাহিনীর
ঘরের সামনে একফালি বারান্দা মতন। তারই এক কোণে একটু আড়াল দিয়ে রান্নাঘর। বছর বারো-তেরোর একটা বাচ্চা মেয়ে, তিন্নির চাইতে বছর দুয়েকের বড় হবে হয়ত, স্টোভ জ্বেলে কী যেন রান্না করছে। আশা নামের সেই মহিলা বাচ্চা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মা কী করছে রে? এখন কেমন আছে?’
মেয়েটি করুণ স্বরে বলল, ‘মা ভাল নেই গো। কোমরে, পায়ে, হাতে খুব ব্যথা। গায়ে জ্বর।’
মহিলা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘সে কী রে? এখনও ব্যথা কমেনি?’ কথা বলতে বলতেই মহিলা হাতের ইশারায় আমাকে বাইরে দাঁড়াতে বলে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। আমি খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক দেখলাম। বাড়ির লাগোয়া সামান্য জমিতে তিনটে পেঁপে গাছ, একটা নারকেল আর একটা পেয়ারা গাছ। দুটো কাঠবিড়ালি পেয়ারা গাছের ডালে-ডালে ছুটোছুটি করছে। এরপরে চোখ গেল বাচ্চা মেয়েটির দিকে। দেখি রান্না করতে করতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইস্স। আগে জানলে দুটো টফি নিয়ে আসতাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কী খুকি?’
বাচ্চা মেয়েটা খুন্তি নাড়তে নাড়তেই বলল, ‘ফতেমা’।
আমি যেন আচমকা ধাক্কা খেলাম। উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার মার নাম কী?’
ইতিমধ্যে আশা নামের সেই মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফতেমা কিছু বলার আগেই নিরুত্তাপ গলায় সেই মহিলা বলল, ‘আপনি যার খোঁজে এসেছেন তার নাম আশা নয়, আয়েশা মণ্ডল। আমার আশা নামটা ধার করেই ও ভদ্দরলোকেদের বাড়িতে কাজ নিত। আমার সঙ্গে চেহারার মিল আছে বলে আপনারা কাগজ চাইলে আমারই আধার কার্ডের জেরক্স দিত। আপনার বাড়িতেও হয়ত ওভাবেই কাজ নিয়েছে। কিন্তু ওর যা অবস্থা তাতে মনে হয় বেশ কিছুদিন কাজে যেতে পারবে না। হাতে-পায়ে মনে হচ্ছে ভালই চোট পেয়েছে। দেখি লোকজন জোগাড় করে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।’
এরমধ্যে দেখি খোঁড়াতে খোঁড়াতে দেওয়াল ধরে ধরে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের এতদিনের চেনা আশা যে কিনা আসলে আয়েশা। করুণ স্বরে বলল, ‘বিশ্বাস করুন দাদাবাবু, আমি শুধু পেটের দায়ে নাম বদলেছি। কোনও বদ মতলব নেই। আমার জন্য আপনাকে খুব ঝামেলা পোহাতে হল, দাদাবাবু। যদি ছাড়িয়ে না দেন আমি ঠিক কাজে যাব। টাকাটাও ঠিক সময়মতো দিয়ে দেব। বিশ্বাস করুন। একটু সুস্থ হয়ে নিই।’
আমার ভেতরে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। যার পরিচয়টাই ভুয়ো তাকে কতটুকুই আর বিশ্বাস করা যায়? গম্ভীর গলায় বললাম, ‘ফোনটা ধরলে তো আর আমাকে এখানে ছুটে আসতে হত না।’ যদিও মনে মনে ভাবছিলাম, ভাগ্যিস এসেছিলাম নইলে তো কোনওদিনই এতবড় একটা মিথ্যের পর্দাফাঁস হত না।
আয়েশা বলল, ‘অটোর ধাক্কায় ফোনটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। তাই ফোন ধরতে পারছিলাম না।’
আমি আর কোনও কথা না বলে হনহনিয়ে হাঁটা দিলাম। আমার মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল। আমরা কোথাও বেড়াতে গেলে ও আর ওর মেয়ে সেই ক’টা দিন আমাদের বাড়িতে এসে থাকত মায়ের সঙ্গে। একসঙ্গে থাকা-খাওয়া। আচ্ছা, তিন্নি যেমন অনেক সময় মায়ের গোপালকে কোলে নিয়ে আদর করে ফতেমাও হয়ত ঠিক সেভাবেই মায়ের হাত থেকে তুলে নিয়ে খেলা করেছে গোপালের সঙ্গে। কত বিশ্বাস করে দোল, জন্মাষ্টমী কিংবা রাস পূর্ণিমার আগে গোপালের বাসন মাজতে দিত ওকে। আর ভাবতে পারছি না। ছিঃ! এইভাবে ঠকাল! সুতপাকে ঘটনাটা জানিয়ে বলে রেখেছি মাকে যেন শুধুমাত্র অ্যাক্সিডেন্টের খবরটুকুই দেয়। সব জানলে মা সহ্য করতে পারবে না।
দুপুরের খাওয়া সেরে বারান্দায় বসে খবরের কাগজটা পড়ছি। মনের ভেতরটা তিতকুটে হয়ে আছে। মা এসে বসল পাশের চেয়ারে। বলল, ‘অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে বললি। তা ওর একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করলি না?’
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ‘তেমন কিছু নয় মা। সামান্য চোট। পাড়ার লোকেরাই ডাক্তারখানায় নিয়ে যাবে বলল।’
‘আমাদের বাড়িতে এতদিন কাজ করছে। একটু কিছু করা যায় না?’
‘মা, ওর কথা ভুলে যাও। সুতপা পাশের বাড়ির শ্যামলীকে বলে অন্য কাজের লোক খুঁজে নেবে।’
মা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকল। তারপর খুব শান্ত স্বরে বলল, ‘ওর নাম আশা না আয়েশা এ দিয়েই কি সব বিচার হয়ে যায়?’
আমি চমকে তাকালাম মায়ের দিকে। মা বলল, ‘তুই আয়েশাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। আর ফতেমা না হয় ক’দিন আমাদের বাড়িতেই তিন্নির সাথে রইল।’
আমি খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে। মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগল। কাগজটা ভাঁজ করে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, তুমি সব জানতে, তাই না?’
মায়ের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি যেন আমার প্রতি করুণা হয়ে আটকে আছে। গ্রিলের ফাঁক গলে উন্মুক্ত আকাশের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সময় করে মাঝে-মাঝে ঠাকুরের কথামৃত পড়িস। দেখবি মন পরিষ্কার হবে। ঠাকুর বলেছেন, পূর্ণজ্ঞান হলে সবেতেই ব্রহ্মদর্শন হয়। পূর্ণজ্ঞান আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের এ-জন্মে আর হবে না। তবে এই সামান্য মানবজনমে অন্তত বিশ্ব-সংসারের সমস্ত মানুষের ভিতরে বসে থাকা আসল মানুষটাকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করি।’