হুতোমের নকশায় সেকালের চাঁদা সাধা

আজকের দিনের সারা বঙ্গে বারোইয়ারি পুজোর রমরমা। এই পুজোকে ঘিরে যে রীতিনীতি, ঐতিহ্য এর পেছনে রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। কীভাবে শুরু হয়েছিল চাঁদা দেওয়া ও নেওয়া। হুতোমের ভাষায় চাঁদা সাধা ... বারোইয়ারি পুজোর শুরুর কাহিনিই বা কী ছিল। লিখছেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, ঝিরঝির বৃষ্টি আর শিউলি নিয়ে মায়াময় শরৎ আসে। আর সবচেয়ে বড় কথা শরৎ মানেই জগজ্জননীর আগমন। তাই বঙ্গ জীবনে শরতের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। করোনার ক্রান্তিকাল কাটিয়ে, দু’বছর বাদে পৃথিবী এখন মোটামুটি সুস্থ। সেই কারণে দু’বছর পর এবার আনন্দময়ীর আরাধনার আড়ম্বর কিছুটা বেশি। প্রাণ খুলে আবালবৃদ্ধবনিতা আনন্দ উপভোগ করবে এই চারটে দিন। উঠবে চাঁদা, ষষ্ঠীতে বোধন, সপ্তমীতে অধিবাস, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজো আর নবমীর যাগযজ্ঞে চলবে মায়ের আরাধনা।
আজকের দিনে সারা বাংলায় বারোয়ারি পুজোর রমরমা। নানা শিল্প সুষমায় সেজে এই পুজো আজ গোটা বিশ্বে প্রসারিত। এর রীতিনীতি, ঐতিহ্য এর পেছনে কিন্তু রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। কীভাবে শুরু হয়েছিল বারোয়ারি পুজো? কীভাবেই বা সেই সময় নেওয়া হত চাঁদা? সর্বজনীন তকমাই বা কীভাবে পেল এই পুজো, একটু দেখে নিই।

আরও পড়ুন –স্মৃতির পাতা থেকে পুরনো কলকাতার দুর্গাপুজো

মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী চন্দ্রবংশীয় রাজা সুরথ রাজ্যপাট হারিয়ে প্রথম মাতৃ আরাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। আবার কৃত্তিবাসী রামায়ণে বলা আছে যে রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। শরৎকালের করেছিলেন অকালবোধন। সেই থেকে শারদীয়া দুর্গাপুজো। আবার বঙ্গদেশের পুজোর প্রাচীন তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহি জেলার তাহিরপুরে রাজা কংসনারায়ণ মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রথম দুর্গাপুজো করেন। তবে সে পুজোয় অংশগ্রহণে অধিকার সবার থাকত না। কেবলমাত্র আমন্ত্রিত অতিথিরাই সেখানে প্রবেশ করতে পারতেন। কথিত আছে, সে-সময় ওই রাজা জমিদারদের পুজোর অনুষ্ঠানের গেটে হাতে চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত দারোয়ান। কেউ ঢোকার চেষ্টা করলেই চাবুক মারা হত। অথচ সাহেব সুবোদের জন্য ছিল অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা। এরপরেই সূচনা হয় গুপ্তিপাড়ার বারোয়ারি পুজোর। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের এই জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন –আলো নিভে গেল

গুপ্তিপাড়ায় সেই সময় থেকে শুরু হয় পুজোর চাঁদা নেওয়া। চাঁদা চাওয়া ও দেওয়া নিয়ে নানা ঘটনার উল্লেখ আমরা পাই উনিশ শতকের কলকাতার অন্যতম সমাজ চিত্রী হুতোমের বর্ণনা থেকে।
‘‘মহাজন’ গোলদার দোকানদার ও হেটোরাই বারোয়ারি পুজোর প্রধান উদ্যোগী। সংবৎসর যা যত মাল বিক্রি ও চালান হয় মনপিছু এক কড়া, দু’কড়া বা পাঁচ কড়ার হিসেবে বারোইয়ারি খাতে জমলে মহাজনদের মধ্যে বর্ধিষ্ণু ইয়ার গোছের শৌখিন লোকের কাছে ওই টাকা জমা হয়। তিনি বারোয়ারি পুজোর অধ্যক্ষ হন। অন্য চাঁদা আদায় করা, চাঁদার জন্য ঘোরা ও বারোইয়ারি সং ও রং তামাশার বন্দোবস্ত করায় তাঁর ভার হয়।”
চাঁদা বিষয় হুতোমের কথায় আরও পাই, ‘‘কানাইবাবু বারোয়ারি বই দিয়ে না খেয়ে বেলা দুটো অবধি নানা স্থানে ঘুরলেন, কোথাও কিছু পেলেন, কোথাও মস্ত টাকা সই মাত্র হল। কোথাও গলাধাক্কা তামাশা ও ঠোনাটা ঠানাটাও সইতে হল।’’

আরও পড়ুন –বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান ঘোষণা রাজ্য সরকারের

কেউ অতিরিক্ত বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, কেউ খুশি হয়েই দিয়েছেন। কেউ আবার সাধ্যের বাইরে গিয়ে অতিরিক্তই দিয়েছেন চাঁদা।
চাঁদা আদায় ব্যাপারটা সে-সময়ও খুব সহজ ছিল না। উদ্যোক্তারা সকাল থেকেই দরজায় দরজায় হানা দিতেন। হাতে থাকত কাপড়ের ঝুলি অথবা কাঠের বাক্স। অনেকেই আবার টাকার বিকল্প হিসাবে চাল ডাল তরকারি ফলমূল দিতেন। বহুক্ষণ অপেক্ষার পর দারোয়ানি ঠাট্টাও জুটত।
হুতোম লিখেছেন, ‘‘বারোইয়ারি অধ্যক্ষেরা বেনে বাবুর কাছে চাঁদার বই ধল্লে তিনি বড়ই রেগে উঠলেন, ও কোনমতে এক পয়সাও বারোইয়ারিতে খরচ কত্তে রাজি হলেন না।’’ আবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কড়কড়ে হাজার টাকাও জুটত। ‘‘হাটখোলায় গদি, দশ-বারোটা খন্দমালের আড়ৎ, বেলেঘাটার কাঠের ও চুনের পাঁচখানা গোলা, নগদ দশ বারো লাখ টাকা দাদন ও চোটায় খাটে।’’
এহেন বীরকৃষ্ণ দাঁ, মোক্তার কানাইধন দত্ত ছক্কর ভাড়া করে বারোয়ারি পুজোর চাঁদা তুলতে বেরিয়েছেন। তা গাড়ি হাঁকিয়ে এলেন তিনি আরও এক বড় মানুষের বাড়ির দরজায়। দারোয়ান মারফত খবর পাঠিয়ে সেই হুজুর স্থানীয় মানুষটির দেখা পাওয়া গেল। সেই বাবু আবার পুজোর খুব ভক্ত। তিনি পুজোর ক’দিন জামাই, ভাগ্নে, ভগ্নিপতি এবং মোসাহেব সহ বারোয়ারি তলাতেই দিনরাত পড়ে থাকেন।’’

আরও পড়ুন –বৃষ্টিতে ভাসল শহর, চলবে ঘূর্ণাবর্তের জের

একালের মতো সেকালেও চাঁদার জোরজবরদস্তিতে অতিষ্ঠ হওয়ার নানা কাহিনি রয়েছে। সে সময়ে বিভিন্ন পত্রিকা যেমন ‘সমাচার দর্পণ’, ‘এডুকেশন গেজেট’, ‘সুলভ সমাচারের’ সম্পাদকীয়তে লেখা হল, ‘‘প্রায় সকল গ্রামেই বারোয়ারি পুজো লেগেছে। পান্ডা মহাশয়েরা দুই তিন মাস পূর্ব হইতে চাঁদা আদায়ে ব্যস্ত আছেন। কোন নির্দোষী চাঁদা দিতে না পারার গুরু দণ্ডে দণ্ডিত হইতেছে। কাহাকে মারা হইতেছে, কাহার ঘটি কলসি গরু ছাগল প্রভৃতি কাড়িয়া লওয়া হইতেছে। গরীব দিগের প্রতি বাবুদের এত দৌরাত্ম্য কেন?’’ মানুষজন প্রতিবাদ জানিয়ে পত্র-পত্রিকায় চিঠিও পাঠাতেন।
সেকালে আবার একটা রেওয়াজ শুরু হয়েছিল যে যাঁরা বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও চাঁদা দিতে অরাজি থাকতেন, তাঁদের বাড়িতে শাস্তিস্বরূপ কুমোরটুলিতে পড়ে থাকা প্রতিমা ফেলে দিয়ে যেত পাড়ার ছেলেরা।
কোনও কোনও সময় চাঁদার দাবি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ডুলি পালকির মহিলা সওয়ারিদের পর্যন্ত রেহাই ছিল না।
‘‘টাকাপয়সা সঙ্গে না থাকলে ‘লজ্জাশীলা’ কুলবালারা বস্ত্রালঙ্কারাদি প্রদান করিয়া মুক্ত হতেন।’’
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এই রকম অসংখ্য ‘চাঁদা সাধা’র ইতিহাস বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। এই রকম অসংখ্য চাঁদা সাধার ইতিহাস সেকালের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন –পঞ্চায়েত দফতরের উদ্যোগে দুয়ারে মহাভোজ

সেকালের চাঁদা নিয়ে দারুণ মজার এক ঘটনা হুতোমের বর্ণনায় আমরা পাই।
‘‘একবার একদল বারোইয়ারি পুজোর অধ্যক্ষ শহরের সিংগিবাবুদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। সিংগিবাবু সে সময় অফিসে বেরুচ্ছিলেন। অধ্যক্ষেরা চার পাঁচজনে তাহাকে ঘিরে ধরে ‘‘ধরেছি’’ ‘‘ধরেছি’’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তায় লোক জমে গ্যালো— সিংগিবাবু অবাক— ব্যাপারখানা কী?


তখন একজন অধ্যক্ষ বল্লেন, ‘‘মহাশয়! আমাদের অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পুজোর মা ভগবতী সিংগির ওপর চড়ে কৈলাস থেকে আসছিলেন, পথে সিংগির পা ভেঙ্গে গ্যাছে; সুতরাং তিনি আর আসতে পাচ্চেন না, সেইখানেই রয়েছেন; আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন, যে যদি আর কোন সিংগি জোগাড় কত্তে পারো তাহলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয়, আমরা আজ এক মাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি কোথাও সিংগির দেখা পেলাম না; আজ ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেয়েচি, কোনমতে ছেড়ে দোবো না।
চলুন! যাতে মার আসা হয়, তাই তদবির করবেন।

আরও পড়ুন –জেলায় জেলায় ঘোষিত বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান

সিংগিবাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বারোইয়ারি চাঁদার বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য কল্লেন।’’
শুধু চাঁদাই নয়, বারোইয়ারি তলার পুজোর ধুমধামও কম ছিল না। হাত বিশেক উঁচু প্রতিমা হত। সোনার ফুল, পদ্ম দিয়ে তা সুসজ্জিত থাকত। এ-ছাড়া সন্ধ্যেবেলায় রোজই যাত্রা, পালা গান, সং সাজা, হাফ আখড়াই অনুষ্ঠিত হত। এ-ছাড়া খেউড়, পালা গান, সখীসংবাদ সংবাদ এসবও চলত। কখনও তা মধ্যরাত, কখনও-বা ভোররাত পর্যন্ত।
এই তো গেল চাঁদা সাধা নিয়ে হুতোমের কথা।
এবার আসি বারোইয়ারির সূচনা নিয়ে। আজ থেকে প্রায় দুশো ষাট বছর আগে সতেরোশো নব্বই সালে (মতান্তর রয়েছে) হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ যুবক প্রথম রাজবাড়ি, জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণ ছেড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে এসেছিল এই পুজোকে। যুক্তি ছিল উৎসব আনন্দ উদযাপন তো সকলের। তাহলে সেটা অভিজাতদের বা সম্ভ্রান্তদের হাতে কুক্ষিগত থাকবে কেন?

আরও পড়ুন –কৃতী ছাত্রের হাতে মাতৃমণ্ডপ উদ্বোধন

কোনও এক জমিদার বাড়িতে পুজো দেখতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসে বারোজন বন্ধু সিদ্ধান্ত নেন নতুন করে দুর্গাপুজো করার। বারোজন বন্ধু তাই তা বারোইয়ারি পুজো হিসেবে অভিহিত করা হয়। ঠিক এই ভাবেই সম্ভ্রান্ত বাড়ির আঙিনা ছেড়ে শারদীয়া উৎসব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হল বারোইয়ারিতে। একাধিক জনের উৎসবে। তবে সর্বজনীন রূপ পেতে এই পুজোর আরও এক শতক সময় লেগেছিল। প্রথমে বাড়ির পুজো, তারপর বারোইয়ারি আরও পরে সবশেষে সর্বজনীন পুজো চালু হয়। গুপ্তিপাড়ার পুজোর সময় থেকেই শুরু হয় চাঁদা তোলার নিয়ম। শুধু চাঁদাই নয়, হুতোমের নকশায় আমরা পাই সেকালের পুজোর সং দেখা নিয়ে মজাদার বর্ণনা।

আরও পড়ুন –১০ বছরে পদার্পণ করল দুর্বারের দুর্গাপুজো

‘‘ক্রমে সন্ধে হয়ে এল। বারোইরারি তলা লোকারণ্য। সহরের অনেক বাবু গাড়ি চড়ে সং দেখতে এসেচে— সং ফেলে তাঁদের দেখচে। ক্রমে মজলিসের দু’এক ঝাড় জ্বেলে দেওয়া হলো— সং এদের মাথার উপর বেল ল্যাল্ঠন বাহার দিতে লাগলো। অধ্যক্ষ বাবুরা একে একে জমায়েৎ হতে লাগলেন, নল করা, থেলো হুকো হাতে ও পান চিবুতে লাগলো। অনেকে চিৎকার ও ‘এটা কর’ ‘ওটা কর’ করে হুকুম দিচ্চেন। শহরে ঢি ঢি হয়ে গেছে আজ রাত্তিরে অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পুজোর হাফ আখড়াই হবে।’’ উৎসবের আঙ্গিকে নানা মজাদার অনুষ্ঠানে জমে উঠত সেকালের বারোইয়ারি দুর্গোৎসব।
গ্রন্থ-সহায়তা : অরুণ নাগ সম্পাদিত ‘সটিক হুতোম প্যাঁচার নকশা’।

Latest article