গোটা দেশ জুড়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আগ্রাসনকে প্রশ্রয় দিতে ভারতবাসীর খাদ্যাভ্যাসকে নিরামিষবাদের নিগড়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা নতুন নয়। এই প্রেক্ষিতে প্রখ্যাত অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কবি এবং সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর লেখা ‘‘‘নিরামিষ’ হিন্দু ভারত, ‘আমিষ’ সেকুলার ভারত’” (ব্ল্যাকলেটার্স থেকে প্রকাশিত, জানুয়ারি ২০২৫), বইটি ভারতবর্ষের খাদ্যাভ্যাসের উপর প্রামাণ্য বইয়ের তালিকায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এ-বইয়ে আমরা পাব প্রাচীন ঋগ্বেদের যুগ থেকে আমাদের সমকাল অবধি ভারতের বিভিন্ন জনজাতি, ধর্ম ও শাস্ত্রে উল্লিখিত ভোজনবিলাসের কথা। অজস্র পদ, রসনা, আহার-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ, ভোজনাচার, খাবার নিয়ে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন নিদান, সমস্ত কিছু সম্পর্কেই রয়েছে অজস্র তথ্য ও পরিসংখ্যান। নিছক গ্রন্থিত অপরীক্ষিত তথ্যের সমাহার নয়, বরং সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণালব্ধ এ-বই লেখকের অধ্যবসায় ও রাজনৈতিক চেতনা সম্পর্কে পাঠকের মধ্যে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে।
আরও পড়ুন-৬ বছর মেলেনি বেতন, শিক্ষিকার আত্মহত্যা সিপিএম শাসিত কেরলে
‘তৈত্তিরীয় আরণ্যক’ থেকে ‘আমি অন্ন এবং আমিই সেই অন্ন ভক্ষক’ এপিগ্রাফ ধার করে লেখক শুরুতেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন, খাদ্য-খাদকের বিজ্ঞানসম্মত সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রে স্বীকৃত। এরপর কখনও মনুসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের কথা বলছেন, প্রতিদিন ভক্ষ্য প্রাণীসকল ভক্ষণ করে ভোক্তা পাপের ভাগী হন না, বিধাতাই ভক্ষ্য প্রাণী ও ভক্ষকগণকে সৃষ্টি করেছেন; কখনও-বা মনে করিয়ে দিয়েছেন বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পত্রিকার প্রাণপুরুষ হিমাংশু স্মৃতিতীর্থের কথা : শ্রাবণমাসে মৃগমাংস খাওয়া হিতকর। আবার বইয়ের ‘পুনশ্চ’ অংশে এসে দেখছি স্বামী বিবেকানন্দও ভারতবাসীকে, বিশেষত যুবসম্প্রদায়কে পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘তমোভাবাপন্ন’ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে এবং রজোঃগুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে গেলে অবশ্যই মাংস খাওয়া জরুরি৷
এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগে, প্রাচীন ভারতীয় সন্ত-মনীষী থেকে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত সবাই যখন ‘আমিষ’ ভোজনের সমর্থনে কথা বলছেন (এবং তাকে আবশ্যিক বলে মনে করছেন) তখন অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন জম্মুর উধমপুরে দলীয় প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কেন বলতে হল, শ্রাবণ মাসে আমিষ খাওয়া ‘মুঘল মনস্তত্ত্ব’? নিরামিষবাদের সঙ্গে ‘পবিত্র’, ‘সাত্ত্বিক’ হিন্দু নাগরিক বা প্রধানমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষিত ‘হিন্দু ভারতরাষ্ট্র’-এরই বা কী সম্পর্ক? কীভাবেই বা নিরামিষ এবং আমিষ খাওয়ার ভিত্তিতে গড়ে তোলা হল ‘ভাল’ ও ‘খারাপ’ ভারতীয়ের বাইনারি? ব্রাত্য এসব কথা বলতে বলতেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘প্রাকৃতিক রুক্ষতা নিরামিষাশী তৈরি করে।’ অর্থাৎ, নিরামিষাশী হওয়ার সঙ্গে হিন্দু হওয়া বা না হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং একাধিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ, শাস্ত্র এবং মহাকাব্য, বা এককথায় ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম যা বিজেপির হিন্দুত্ববাদ প্রচারের স্তম্ভ, তার সমগ্রাংশেই শুধু মাংস খাওয়ার নজিরই নেই বরং নির্দেশও মেলে।
আরও পড়ুন-ডেরেকের প্রশ্নে দিশাহারা কেন্দ্র
ঋগ্বেদ, চরক সংহিতা, ব্রত সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা, বাল্মীকির রামায়ণ, শতপথ ব্রাহ্মণ, মনুস্মৃতি থেকে মাংস ভক্ষণের অজস্র সবিশদ নিদর্শন উল্লেখ করছেন ব্রাত্য বসু। সুশ্রুত সংহিতার পরিকামসম, উল্লুপলামামসম, পিষ্ট, প্রতপ্ত, রেষবার, মাংসভূতোদন কিংবা চরক সংহিতার শেয়ালের লেজের সুরুয়া, শজারুর কাঁটার হালকা ঝোল, ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ গোরুর মাংস খাওয়ার কথা (বিশেষ করে ‘অঘ্ন্যা’ বা গাভীর মাংস, যাকে বলা হয়েছে ‘সসাগরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার’) উল্লেখ করা হয়েছে। আবার ‘অজা-পঞ্চান্দম সূক্ত’-এ পাচ্ছি ‘আয়াস’, ঘোড়া কেটে রান্না করার ‘পূত কড়াই’-এর কথা। রয়েছে আমিষভোজে বলিপ্রদত্ত ঘোড়ার স্বর্গলাভের সংকল্প। এমনকী এ-ও জানতে পারা যাচ্ছে, ঋক্-বৈদিক এবং তার পরবর্তী যুগে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ব্যবহৃত তৈজসপত্রাদি গণ্ডারের হাড় দিয়ে তৈরি হত।
শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, ‘আপস্তম্ব বৌধায়ন ধর্মসূত্র’ এবং মৌর্যযুগ এবং মৌর্যপরবর্তী বৌদ্ধগ্রন্থ ‘মিলিন্দপঞহ’-এ শুয়োরের মাংস সম্পর্কে বলা হয়েছে, নরম, মনোরম, স্বাদে পরিপূর্ণ এবং হজমের পক্ষে চমৎকার। লেখকের সবচেয়ে বড় সাফল্য এটাই যে তিনি ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী আত্মাকে এই কৃশকায় বইয়ে ধরতে পেরেছেন। ভারত শুধু হিন্দুদের দেশ নয়। এ-দেশ হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন সবার। সেজন্যই তো, লেখক ব্রাত্য বসু এনেছেন ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ, জরাথ্রুষ্ট্রবাদী পার্শি, ইবন বতুতা, আবুল ফজল এবং অল-বিরুনির প্রসঙ্গ, আকবরের মধ্যাহ্নভোজনের সঙ্গে সমস্বরে এনেছেন হিমালয়বাসী কালিকানন্দ স্বামীর ভোজনবিলাসের অনুষঙ্গ।
আরও পড়ুন-ব্রিটেনের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশই লুঠ করেছে অবিভক্ত ভারতের অর্ধেক সম্পদ
কখনওই পাঠকের উপর নিজের মতাদর্শ চাপিয়ে দেননি ব্রাত্য। নির্মোহভাবে মনে করাতে চেয়েছেন, ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙদের চোখে ছিল ‘বৌদ্ধধর্মের রঙিন চশমা’, তাই অনেক সময়ই তাঁদের দেওয়া বিবরণ রঞ্জিত, অতিরঞ্জিত। তাই ব্রাত্য নিজের নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান নিয়ে সদাসতর্ক। ভারতবর্ষের আঞ্চলিক বিচিত্রতার প্রতি মর্যাদা একবারের জন্য না খুইয়েও কিন্তু লেখক হিন্দুধর্মের প্রতি সহনশীল এবং শ্রদ্ধাশীল। হিন্দুপুরাণ নিয়ে তাঁর অধ্যবসায় এবং সতর্কতা এর প্রমাণ। গাভীরা কবে, কেন ‘অদিতি’রূপে পূজিত হত, ‘মনুস্মৃতি’র কোন্ ৫৪টি শ্লোকে নিষিদ্ধ মাংসের দীর্ঘ তালিকা আছে প্রভৃতি অংশে হিন্দু তথা সমস্ত ধর্মের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র (IKS) এবং ফুড, গ্যাস্ট্রোনমি, কালিনারি স্টাডিজ্ নিয়ে মানববিদ্যায় চর্চার এ-যুগে ব্রাত্য বসুর এ-বই এক অমূল্য গবেষণার দলিল।
মাত্র ক’দিন আগেই উত্তরাখণ্ডের শংকরাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ প্রধানমন্ত্রী মোদিকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অবিলম্বে গোরুকে রাষ্ট্রমাতা ঘোষণা করতে হবে। এই অনুষঙ্গে ‘‘‘নিরামিষ’ হিন্দু ভারত, ‘আমিষ’ সেকুলার ভারত’” বইটির ‘পুনশ্চ’ অংশে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে গো-ধন রক্ষা সমিতির আর্য সদস্যের আলাপের পর্বটি মনে পড়বে। স্বামীজি জিজ্ঞেস করেন, গোরুদের নিধন থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি এত তৎপর কেন? উত্তরে সে-ই আর্য বলেন, ‘কারণ, গোরুই আমাদের মাতা।’ স্বামীজি উত্তর বলেন, ‘সে তো আপনাদের দেখাই বোঝা যাচ্ছে।’ যারা দেশের আর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে ভুলে জনসাধারণের খাদ্যাভ্যাসে বিধিনিষেধ আরোপ করায়, গোরুকে রাষ্ট্রমাতা ঘোষণায় ব্যস্ত, তাদেরকে বোধহয় লেখক ব্রাত্য বসুও স্বামীজির কথাটাই বলতে চাইবেন।